দর্শক যা দেখতে চায় তাই দেখানো নির্মাতার দায়?

সাইফ উদ্দিন আহম্মেদ
Published : 25 Jan 2012, 06:37 AM
Updated : 15 July 2020, 11:30 AM

গ্রামের রাস্তা ধরে রিকশা করে যেতে যেতে একটা জিনিস কেনার জন্য রাস্তার পাশেই ছোট্ট একটা দোকানে দাঁড়িয়েছি কিছুক্ষণের জন্য। দোকানটির পরিসর আসলেই ছোট। প্রচলিত ভাষায় যেটাকে টং দোকান বলে, সেরকম। দোকানের পরিসর ছোট হলেও গ্রামের মানুষের প্রয়োজনীয় প্রায় সকল পণ্যই দোকানে আছে। দোকানের পাশেই একটি মাটির চুলায় চারকোল জ্বালিয়ে চায়ের কেটলি গরম হচ্ছে। এই চায়ের আয়োজনকে ঘিরে দুটি বাঁশ দিয়ে তৈরি বেঞ্চে জনা চারেক খেটে খাওয়া মানুষের আড্ডা। পণ্য কেনার স্বল্প সময়ের মধ্যেই সেই আড্ডার দুটি বাক্য আমার কানে এসে পৌঁছাল। একজন চ্যালেঞ্জ করে অন্যজনকে জিজ্ঞাসা করছে, ''তুই কোথায় শুনলি এটা''। উত্তরদাতা গর্বসহকারে উত্তর দিল, ''আমি টিভিতে দেখছি''। পণ্য কিনে রিকশায় ফিরতে ফিরতে লক্ষ করলাম আড্ডার বাকী অংশগ্রহণকারীরাও তথ্যের উৎস সম্পর্কে জেনে সন্তুষ্ট। রিকশা আবারও চলতে শুরু করল। কিন্তু লোকটির দেয়া রেফারেন্স কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছিল না। ''আমি টিভিতে দেখছি'', লোকটি কিন্তু এটাও বলেনি টিভির সংবাদে, নাটকে নাকি টকশোতে দেখেছে। অন্যরাও কিন্তু টিভির নাম শুনেই বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছে। এটা ভেবে বেশ ভাল লাগল যে, এদের কাছে গণমাধ্যমের একটা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে। উল্টো ভাবে চিন্তা করলে গণমাধ্যমের বা গণমাধ্যমের নির্মাতাদের তো তাহলে ইতিবাচক, বস্তুনিষ্ঠ, মানুষের প্রয়োজনে লাগে এমন কনটেন্ট তৈরি ও প্রচারের দায় রয়েছে অনেক।

এই মহামারীকালে গোটা পৃথিবীই স্থবির হয়ে পড়েছে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশও এই পরিস্থিতির বাইরে নয়। যার ফল হিসেবে জীবন ও কর্ম কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। স্বাভাবিক পরিণতিতেই বাংলাদেশের মিডিয়া কার্যক্রম সুনিদৃষ্টভাবে বললে নাটক নির্মাণ প্রায় বন্ধ। যদিও মাসখানেক যাবত কিছু কিছু নাটক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। তবে সেটা স্বাভাবিক সময়ের সাথে তুলনা করলে বন্ধই বলা চলে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে এই মিডিয়ার সাথে জড়িত শত শত শিল্পী-কলাকুশলী। এই কর্মহীন স্থবিরতার মাঝে একটি আলোচনা বা বিতর্ক সামাজিক মাধ্যমে বেশ বাজার দখল করেছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাজার। বিষয়টি হচ্ছে ''ওয়েব সিরিজ''। বিষয়টিকে ঘিরে দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। যেমনটি বাংলাদেশের সকল ইস্যুতেই হয়ে থাকে। এক পক্ষ অশ্লীলতার কারণে ওয়েব সিরিজকে ছুড়ে ফেলতে সময়ক্ষেপণ করতে চাচ্ছে না। তাদের সবচাইতে বড় যুক্তি আমাদের দেশে তো অশ্লীলতা শিল্পের উপাদান হতে পারে না। এটা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, কৃষ্টি-সংস্কৃতির পরিপন্থী। কারণ আমাদের এই অঞ্চলের মানুষেরা বহুকাল ধরেই বিনোদনমূলক সকল কর্মকাণ্ড পারিবারিক পরিমণ্ডল বা পুরো পরিবার একসাথেই দেখে অভ্যস্ত। মজার বিষয় অন্য পক্ষ এগুলোকে অশ্লীলতা বলতেই রাজি না। তাদের যুক্তি গল্পের প্রয়োজনে যতটুকু দেখানো দরকার ততটুকুই দেখানো হচ্ছে। যেটাকে অন্যরা অশ্লীলতা বলছে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে গল্পটি আসলে আসছে কোথা থেকে? শুধু গল্পের বাধ্যবাধকতায় যদি নির্মাতাকে অশ্লীল দৃশ্য ধারণ করতে হয়, তাহলে রচয়িতা কি নির্মাতার মতের বাইরে গিয়ে গল্পটি লিখেছেন? গল্পের প্রয়োজনে কিছু দৃশ্য যুক্ত করা নির্মাতাদেরও যুক্তি আছে। তাদের কথা বর্তমান বিশ্বায়ন আর ইন্টারনেটের যুগে সময় উপযোগী নাটক নির্মাণ করতে না পারলে বাজার ধরে রাখা যাবে না। তাই দর্শক যদি অশ্লীলতা দেখতে চায় বা গ্রহণ করতে চায় তবে সেই রকম কনটেন্ট নির্মাণ করা যেতেই পারে।

কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর উপকরণ যেমন, পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদি তৈরির ক্ষেত্রে কার্যকর যোগাযোগের একটি থিওরি মেনে চলা হয়। তাহলো, "Never Underestimate your audience"। বাংলা করলে দাঁড়ায়, কখনও এটা ভাববে না যে, তোমার দর্শক কিছু জানে না বা কিছু বোঝে না। অর্থাৎ দর্শকের চাহিদা প্রয়োজনকে বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছে। নাটক নির্মাণও এক ধরনের যোগাযোগ। কারণ এর মাধ্যমে নির্মাতা একটি গল্প দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন বা গল্পটি দর্শককে বলেন। তাই নাটক নির্মাণেও দর্শককে গুরুত্ব দেয়াটাই উচিৎ কর্ম বিবেচনা করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দর্শকের চাহিদা বলতে কি দর্শক কী দেখতে চায় তা, নাকি দর্শকের কী দেখা প্রয়োজন তাকে বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হওয়া উচিৎ দর্শকের জ্ঞান, অভ্যাস, পছন্দ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি বিবেচনা করে দর্শকের জন্য শিল্প সৃষ্টিই উত্তম শিল্প।

শিল্প বলতে গেলেই পুরনো সেই বিতর্ক সামনে চলে আসবে। শিল্পের জন্য শিল্প নাকি জীবনের জন্য শিল্প? জীবনের জন্য শিল্প হলে তো তাতে জীবন বা মানুষের ভাল, মন্দ, সুখ, দুঃখ, প্রয়োজন, জ্ঞান সকল কিছুই শিল্পে উপস্থিত থাকতে হবে। আবার শিল্পের জন্য যে শিল্প। যার জীবনের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই সেটাও কি নিছকই বিনোদন বা ভালো লাগা নাকি তার চেয়ে বেশি কিছু? সকল সফল নাট্যকারদের মধ্যে সফোক্লিস, শেক্সপিয়ার, গ্যাটে, ইবসেন, বার্নাড শ, মধুসুদন, রবীন্দ্রনাথ সকলেই বলেছেন নাটকের একটি উদ্দেশ্য থাকতে হবে। তার মানে তাকে শিল্পের চেয়েও বেশি কিছু দায় নিতে হবে। তাই শুধু দর্শকের চাওয়ার দোহাই দিয়ে যা খুশি তা নির্মাণ করার যুক্তি ধোপে টেকে না। তারমানে কিন্তু এটা নয় দর্শককে উপেক্ষা করে শিক্ষণীয় বিষয় দিয়ে নাটক বা শিল্প ভরিয়ে ফেলা। আমাদের দেশের দর্শক নায়কের পরাজয় দেখতে চায় না, কারণ অধিকাংশ বাঙালি নায়কের স্থলে নিজেকে কল্পনা করে নাটক সিনেমা দেখে। তাই কল্পনায় হলেও নিজেকে বিজয়ী দেখতে চায়। দর্শকের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়েই বাংলা সাহিত্যে শুধুর ময়মনসিংহ গীতিকা ছাড়া সকল কাহিনীতেই নায়কের জয় হয়। সমাপ্তিটা হয় মিলনাত্বক। যাকে বলা হয় ''মধুরেণু সমপায়েত''। দর্শকের এই চাওয়া কিন্তু কাহিনীতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। নায়কের জয়টাকে একটি বৈশিষ্ট্য ধরে নিয়ে প্রতিটি গল্পকারই তার নিজের মতো করে গল্প তৈরি করেছেন।

আলোচনা এদিকে এগুতে থাকলে 'ধান ভানতে শীবের গীত' গাওয়া হবে। লেখাটা শুরু হয়েছে ওয়েব সিরিজের কনটেন্ট নিয়ে। সেদিকেই মনোযোগী হওয়া যাক। এই পর্যায়ে আমার লেখাটির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দর্শক নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক। যদি তাদের যুক্তিটাই মেনে নেই যে, দর্শক যা চাইবে আমরা তাই বানাব। তাহলে প্রশ্ন আসে দর্শক আসলে কী চায় এটা আমরা জানছি কীভাবে? এক্ষেত্রে টিআরপি নামক যে সার্কাসটি চালু আছে সেটা নিয়ে মোটেই আলোচনা করতে আমি অন্তত রাজি নই। যে বিষয়টি কোনোভাবেই পরীক্ষা করবার বা যাচাই করে দেখবার সুযোগ নেই, সেটাকে কোনো তথ্য বা ফলাফল হিসেবে আমি মানতে পারব না। আমি অবাক হই এটা ভেবে, যে দেশের মানুষ ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে ইভিএমএ ভোট প্রদানে সন্দেহ প্রকাশ করে সেই দেশের মানুষ টিআরপি রেটিং পয়সা দিয়ে কেনে। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি। আমাদের দেশে টেলিভিশন দর্শকের প্রত্যাশা বা চাহিদা নিরূপনের কোনো উদ্যোগই কখনও নেয়া হয়নি। সরকার, টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞাপন দাতা, বিজ্ঞাপনী সংস্থা আর বিশাল বিশাল সংখ্যা নিয়ে গড়ে ওঠা টিভি নাটকের পেশাজীবীদের কোনো সংগঠন, কেউই উদ্যোগী হয়নি দর্শকের মনের কথাটি জানতে। দর্শকের মতামত জানবার প্রয়োজনই বা কী? আমরাই তো জানি দর্শক কী চায়। টিভি চ্যানেলে বসে থাকা কর্তাব্যক্তিরা নির্দ্বিধায় বলে দিচ্ছে, ''দর্শক এটা খাবে না। এই নায়ককে নেন ওর চাহিদা আছে।" বিজ্ঞাপন দাতারা বলছেন, ''এই নাটকে বিজ্ঞাপন দেয়া যাবে না। থ্রিল নাই। এটা হিট হবে না।" নির্মাতারা গর্ব করে বলছে, ''বস গল্পটা পড়ে দেখেন দর্শক এটা খুব খাবে।" দর্শকের কথাগুলো আমরা সকলেই বলে দিচ্ছি। কিন্তু এই বলাবলি মধ্যে দর্শকের বলবার সুযোগ একেবারেই নেই।

আপাতদৃষ্টিতে দেখে এবং পাড়া-প্রতিবেশীর টিভি দেখার অভ্যাস বিচার করলে এই ধারণাটাই স্পষ্ট হয় যে, আমাদের বাংলাদেশের বিশ্বমান উপযোগী ধুম-ধারাক্কা কনটেন্ট এর চাইতে তারা প্রতিবেশী দেশের বাংলা চ্যানেলে প্রচার হওয়া পারিবারিক সেকেলে গল্পের নাটকই বেশি দেখে। প্রতিবেশী দেশের চ্যানেল দেখার বিষয়টি আমাদের চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরাও বিশ্বাস করেন। তার প্রমাণও আছে বিস্তর। চ্যানেলের পক্ষ থেকে সেই দেশের লোক এনে নাটক নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অভিনয়শিল্পী নিয়ে গিয়ে সেই দেশেও নাটক নির্মাণ করা হয়েছে। এইসব নির্মাণের ফলাফল নির্ণয় করা আমার কাজ নয়। আমার সে সামর্থ্য বা সুযোগও নেই। এক্ষেত্রে আমার একটি অবজারভেশন হচ্ছে শুধু কনটেন্ট নয় বিজ্ঞাপনও দর্শকের চ্যানেল পছন্দ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। যেসব চ্যানেল বেশি দেখছে বলে আমরা মোটামুটি সবাই একমত সেইসব চ্যানেল বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে যে কাজটি করে তা হলো, নাটক শুরু হলে তার মূল গল্পটা দর্শকের কাছে পৌঁছানোর আগে কোনো বিজ্ঞাপন বিরতি দেয় না। যখন কোনো দর্শকের নাটকের কাহিনীর প্রতি একরকম কৌতুহল তৈরি হয় তখনই তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিজ্ঞাপন বিরতি দেয়। দর্শক কিন্তু অপেক্ষায় থাকে এরপর কী হয় দেখি? তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ দর্শক জানে কতক্ষণ পরে বিজ্ঞাপন শেষ হয়ে আবার নাটক শুরু হবে। বিপরীতে আমাদের চ্যানেলে এমনও হয়, নাটকের অভিনয় শিল্পীর নাম সবে দেখানো হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপন! যে দর্শককে আপনি নাটকের কাহিনীর কিছুই জানতে দিলেন না, সে কিসের আকর্ষণে আপনার চ্যানেল ধরেই বসে থাকবে? তাও আবার এই অনিশ্চয়তাসহ যে এই বিজ্ঞাপন বিরতি ৫ মিনিটের নাকি ১৫ মিনিটের তা কেউ জানে না।

দর্শকের অভিব্যক্তি জানা ও নাটকের জনপ্রিয়তা জানার আরও একটু অদ্ভূত উপায় আছে, যার নাম ইউটিউব। এই ইউটিউবের ভিউ থেকে ঠিক করা হয় কোন নাটকটি দর্শক গ্রহণ করছে বা বেশি দেখছে। যেখানে বুস্টিং করে বা একটুখানি ডিজিটাল দক্ষতা দেখিয়েই যেকোনো নাটক বা পোষ্টের ভিউ প্রকৃত ভিউ এর চাইতে অনেক বেশি দেখানো সম্ভব। আবার অর্গানিক ভিউ, যেটা কোনোরকম বুস্টিং ছাড়া প্রকৃত ভিউ সেটাও কি আসল ভিউ? একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এক সেকেন্ডের জন্য ভিডিওটিতে ক্লিক করলেই সেটাকে ভিউ হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই এক সেকেন্ডর ক্লিক যদি একজন নির্মাতার নাটকের মান বিচারের নির্ণায়ক হয় তবে তার নাটক নির্মাণ বন্ধ রেখে ইন্টারনেটে কারসাজী করার কৌশল শেখা প্রয়োজন। যদি ধরেই নেই এই ইউটিউবের যা কিছু সবই সত্যি। কিছু কিছু কমেন্টস যখন দেখা যায় তাহলে কিছু লোক দেখছে তো বটেই। কিন্তু আমি একটা উত্তর খুঁজে পাই না, চ্যানেলগুলো কেন ইউটিউবে নাটক পোস্ট করে? আমার তো মনে হয় তাদের উচিৎ ইউটিউবে যাতে তার ক্রয় করা নাটক কোনোভাবেই যেতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। যারা অবাক হচ্ছেন তাদের জন্য ভেঙ্গে বলছি। ধরুণ, একটি ধারাবাহিক নাটক অথবা কোনো নির্দিষ্ট নাটক আমি দেখব বলে ঠিক করলাম। তো আমি কোথায় দেখব টেলিভিশনে নাকি ইউটিউবে? আমি অবশ্যই ইউটিউবে দেখতে চাইব কারণ টেলিভিশনে দেখতে হলে ঐ নির্দিষ্ট সময়েই একগাদা বিজ্ঞাপন বিরতিসহ ৪০ মিনিটের নাটক ৭০ মিনিট ধরে দেখতে হবে। আর সেই একই নাটক আমি আমার সুবিধাজনক সময়ে মাত্র ৪০ মিনিট সময় ব্যয় করে দেখতে পারব। এবার ভাবুন বিজ্ঞাপনদাতারা যে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিতে আগ্রহী নয় এতে তাদের দোষটা কোথায়। চ্যানেলগুলো যদি নিশ্চিত করতে পারে তার নাটকটি তার চ্যানেল ছাড়া আর কোথাও দেখা যাবে না। তাহলে আমি ওই নাটকটি দেখতে নির্দিষ্ট সময়ে ওই চ্যানেলেই তাকিয়ে থাকব। আর দর্শকের চ্যানেল দেখা নিশ্চিত করতে পারলে বিজ্ঞাপনদাতা অবশ্যই লাইন ধরবে। যেমনটি একটা সময় বিটিভির ঈদ নাটকের জন্য বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো ৪/৫ দিন ধরে লাইনে পালাক্রমে লোক দাঁড় করিয়ে রাখত।

লেখার শিরোনামের দিকে আর একবার দৃষ্টি দিতে চাচ্ছি। এত কিছু আলোচনা করছি এই কারণে যে, নির্মাতা হিসেবে আমার মনে হয় আমরা এই বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তার এক অসুস্থ প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়েছি। আমরা নাটক সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগই বিশ্বাস করতে শুরু করেছি অমুক নায়কের ইউটিউবে হিট বেশি তাই ওকে নিলেই নাটক বিক্রি হয়ে যাবে। গল্প-কাহিনী-চিত্রনাট্য কোনোকিছুই দরকার হবে না। আশ্চর্যের বিষয় ইদানীং দর্শকের চাহিদার দোহাই দিয়ে অশ্লীলতাকেও গ্রহণ করার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হচ্ছে। শুধু দর্শক কী বেশি দেখবে সে বিবেচনায় গেলে তো, ইন্টারনেটের যেসব সাইটকে বিভিন্ন দেশ ব্লক করে রেখেছে সেগুলোর চাহিদাই তো বোধকরি সবচাইতে বেশি। একজন নির্মাতার তার দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি কোনোকিছুর প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না? তাই যদি হয় তাহলে লেখার শুরুতে যে সত্যি ঘটনাটা বললাম তার কী হবে? বিশাল জনগোষ্ঠী যে শিক্ষার উপাদান বা উৎস হিসেবে বিশ্বাস করে বসে আছে গণমাধ্যমকে। অখণ্ডনীয় যুক্তি হিসেবে বলছে, ''আমি টিভিতে দেখছি।'' একজন নির্মাতা হিসেবে আমি তার জন্য কী নির্মাণ করছি বা করব। নাকি একজন নিছক ঠিকাদারের মতো ৬ ইঞ্চি ঢালাই এর ছাদ, ৬ সুতা রডের পিলার আর সেগুন কাঠের দরজা লাগিয়েই নির্মাতা হয়ে যাব।

এই লেখা পড়ে কারো আবার মনে হতে পারে একজন নির্মাতা লিখেছেন বাংলাদেশের টিভি মিডিয়াতে সবই খারাপ নাটক তৈরি হচ্ছে। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি কিছু ভালো নাটক কিন্তু টেলিভিশন, ওয়েব মিডিয়া উভয় জায়গায়ই তৈরি হচ্ছে। তবে সেগুলো বেশির ভাগ দর্শকের কাছে না পৌঁছে হারিয়ে যাচ্ছে অতল গহীনে।

নির্মাতাকে আসলে ভাবতে হবে দর্শক কী দেখতে চায় সেটার পাশাপাশি দর্শকের কী দেখা প্রয়োজন এ ব্যাপারেও। সেটাই দর্শকের উপযোগী করে নির্মাণ করাই তার কাজ। তা না করতে পারলে অশ্লীলতা বলুন আর অন্য উপাদান বলুন কোনো কিছু দিয়েই দর্শকের হৃদয় জয় করা যাবে না। নির্মাণ দিয়ে দর্শকের হৃদয় জয় করতে পারলে আর দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হবে না আমাদের দেশি চ্যানেল থেকে দর্শকের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণ। চ্যানেল, বিজ্ঞাপনদাতা, প্রযোজক ও নির্মাতাদের দর্শকের আসল অভিব্যক্তি জানতে হবে। তাদের প্রয়োজন বুঝতে হবে। সেই অনুযায়ী নিজস্ব সংস্কৃতিকে মাথায় রেখে মানসম্পন্ন নাটক নির্মাণ করলে ইন্ডাস্ট্রিও বাঁচবে। এর সাথে জড়িত শতশত শিল্পী কলাকুশলীও জীবিকা অর্জন করতে পারবে।