সংকটে তারুণ্য: আত্মউন্নয়ন ও জাতীয় স্বার্থে অংশগ্রহণ জরুরী

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 14 Feb 2012, 10:28 AM
Updated : 1 August 2021, 03:06 PM

কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে গত দেড় বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে অনেক গবেষণা ও আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চলমান রাখার যে প্রচেষ্টা তার কার্যকারিতা, দিনের পর দিন বাসায় আটকে থাকায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এবং পাশ করা শিক্ষার্থীদের চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯-এর প্রভাব সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বেশি কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষাকার্যক্রমের বর্তমান স্থবির অবস্থা যে আমাদের সমাজব্যবস্থা এবং শিক্ষাব্যবস্থা উভয়েরই একটি বিশেষ দুর্বল দিককেও প্রকটভাবে প্রকাশিত করেছে, যা আলোচনার টেবিলে উঠে আসছে না। এটি হলো, বাংলাদেশে ১৮ বছর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষ পর্যন্ত, অর্থাৎ ২৩/২৪ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা তাদের পরিবারের ওপর অপরিসীম নির্ভরশীল এবং তারা স্বাবলম্বীভাবে বড় হয়ে উঠছে না, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য মোটেও সুসংবাদ নয়।

কিছুদিন আগে গণমাধ্যমের একটি খবরে চোখ আটকে গিয়েছিল। লকডাউনের কারণে সংসার চালাতে ব্যর্থ হয়ে মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক নিজের কিডনি বিক্রি করে দিতে চাইছেন। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্তদের মধ্যে 'নতুন দরিদ্র' বলে একটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে যারা লকডাউনের কারণে আয় হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে গেছেন। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু ঐ সংবাদটি পড়ে বেশি আফসোস লেগেছে এ কারণে যে, ওনার দুটো ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কর্মক্ষম বয়সী এবং যথেষ্ট পরিমাণ লেখাপড়া জানা সত্ত্বেও এই সন্তানরা দুঃসময়েও বাবার একক আয়ের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক সংকটে থাকা এ রকম আরও অনেক পরিবারে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তানরা অভিভাবকের আয়ের ওপর মুখাপেক্ষী হয়ে অলস সময় কাটাচ্ছে। কবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে, কবে পড়ালেখা শেষ করে একটা ভালো চাকরি পেয়ে বাবা-মায়ের দুঃখ ঘোচাবে– এই আশায় অলস সময় কাটাচ্ছে তারা। অন্যদিকে গত দেড় বছর ধরেই আমরা, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ নয় এমন পরিবারের ১৮ থেকে ২৩/২৪ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে যারা শহরাঞ্চলে থাকে তাদের বড় একটা অংশকে পাড়ার মোড়ে আড্ডা মারতে দেখছি। প্রচুর ছেলেমেয়ে নিয়মিত রেস্টুরেন্ট, শপিংমলে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের অধিকাংশের মুখে মাস্ক থাকে না, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতেও দেখা যায় না তাদের। অথচ, দেশের এই সংকটকালে সদ্য কৈশোর পার হওয়া এবং যৌবনে পদার্পন করা যুবসমাজেরইতো মানবিক সহায়তা কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে আসার কথা। তারা করোনাভাইরাসকে ভয় পাবে না, বরং দরিদ্র মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌছে দেবে। আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হতে বা অক্সিজেনের সাপ্লাই পেতে সহায়তা করবে– এটাইতো যৌবনের ধর্ম হওয়ার কথা। অথচ এসব কার্যক্রমে এই বয়সী ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। বর্তমান পরিস্থিতি তাই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের সমাজ এবং শিক্ষাব্যবস্থা কোনোটিই শিক্ষার্থীদের স্বাবলম্বী হয়ে বড় হয়ে উঠতে দেয় না। তাদেরকে সচেতন নাগরিক হিসেবে আচরণ করতে উৎসাহিত করে না। বরং, দেশের সংকটকালে তাদের বড় অংশটিই নিজেদের নিয়ে ডুবে আছে। তারা এবং তাদের অভিভাবকরা বিশ্ববিদ্যালয় খোলা এবং সময়মতো পাশ করে তাদের চাকরিতে ঢোকা নিয়ে চিন্তিত। চলমান অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে যুব জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত স্কিল অর্জন, পার্টটাইম কোনো কাজ করা বা মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো নিশ্চিত করা নিয়ে তারা তেমন চিন্তিত নন।

তারমানে আমি এটাও বলছি না, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের এখন পূর্ণকালীন কাজে যোগ দিতে হবে। আমি বলতে চাচ্ছি, আমার ছেলে বা মেয়ে অনেক পড়ালেখা করে তারপর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার হবে– এই চিন্তা করে বাংলাদেশে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ২৩/২৪ বছর বয়স পর্যন্ত তুলোর পুতুল বানিয়ে রাখেন, মুখে তুলে খাইয়ে দেন, যা এই ছেলেমেয়েগুলোর জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে। বাবা-মায়েদেরও দীর্ঘসময় ধরে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালানোর চাপ বহন করতে হচ্ছে। অথচ উন্নত বিশ্বে ১৬ বছর বয়স থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি ছেলেমেয়েরা পার্টটাইম চাকরি করে। অর্থ উপার্জন করার কষ্ট এবং আনন্দ দুটোই তারা উপলব্ধি করে। পাশাপাশি, সদ্য কৈশোর পেরুনো যে পশ্চিমা ছেলে বা মেয়ে কোনো দোকানে কাজ করে, সে শেখে সুন্দরভাবে কাস্টমারের টেবিলে খাবার সার্ভ করার নিয়ম, ছোট-বড়, ধনী-গরিব, বৃদ্ধ, শারিরীক প্রতিবন্ধী– দোকানে যেই আসুক, সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা। এভাবেই অল্প বয়স থেকেই ওরা সৎ পথে উপার্জন করা, সবার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার ও সদাচারণ করাসহ অন্যান্য মানবিক গুণাবলীর পাঠ নেয়। ওয়েটারের কাজ করা থেকে শুরু করে অন্যের বাড়ির লন পরিষ্কার করা– কোনো কাজকেই ওরা ছোট করে দেখে না। অথচ আমাদের অধিকাংশ বাসায় বাবা-মায়েরা তাদের কৈশোর পেরুনো সন্তানদের পানিও ঢেলে খাওয়ান। ছেলেমেয়েরা বড় ভাইদের পুরনো নোট মুখস্থ করে, গাইড বই পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বিশাল চাকরি করবে, এটাই বাবা-মা এবং সন্তান উভয়েরই স্বপ্ন। তাই, আমাদের দেশে পার্টটাইম কাজ করার সুযোগ নেই কথাটা আসলে পুরোপুরি সঠিক নয়। আমরাই কাজকে ছোট-বড়, গরীব-ধনী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত– এ রকম নানা রকম শ্রেণিভেদ করে অপশন কমিয়ে রেখেছি।

এই পরিস্থিতির মধ্যেও মাঝেমাঝে পত্রিকার পাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী গ্রামের বাড়িতে অলস বসে না থেকে খামার গড়ে তুলেছেন, কৃষিকাজ করছেন– এরকম খবর আমাদের নজরে আসছে। শাকিল আহমেদ নামের নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বসতবাড়িতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবজি চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে শহরে চাকরি না খুঁজে গ্রামে শষা, তরমুজ ইত্যাদি চাষ করতে দেখে গ্রামের মানুষ নাকি তাকে পাগল বলেছিলেন। এখন এই মানুষগুলোই সবজিচাষ বিষয়ক পরামর্শের জন্য তার কাছে আসছেন। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী জাহিন তার গ্রামের বাড়িতে গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি এখন স্বপ্ন দেখছেন খামারটিকে অনেক বড় করবেন। গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। এই তরুণরাই আমাদের আশার আলো। কাজের মধ্যে তারা শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা ধনী-গরীবের ভেদাভেদ করেননি। বরং রীতিমতো লাভজনক এন্টারপ্রাইজ গড়ে তুলেছেন। এদের কাছ থেকে তাদের সমবয়সী শিক্ষার্থী ও তাদের বাবা-মায়েদের অনেক কিছু শেখার আছে। মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রেও অনেক শিক্ষার্থী চমৎকার কাজ করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয় সরকারসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সামাজিকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আওতায় তরুণদেও অধিক হারে সম্পৃক্ত করে পাড়া-মহল্লায় প্রায় ৫০০টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিগুলো সামাজিক দূরত্ব মানা এবং অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে মানুষকে উৎসাহিত করছে। ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে। অন্যদিকে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তানভীর হাসান সৈকত নামের এক শিক্ষার্থী এবং তার বন্ধুদের উদ্যোগে দরিদ্রদের খাদ্য সহায়তা প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়। দলটি এখন এই এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষদের করোনাভাইরাসের টিকার রেজিস্ট্রেশন করতেও সহায়তা করছে। সারা দেশজুড়েই শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে আরও নানারকম মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেশের মানুষ সেগুলোতে অর্থসহায়তা প্রদান করাসহ নানাভাবে অংশগ্রহণ করছেন। তরুণরা সঠিক মানুষের কাছে সেই সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছে। এটাইতো স্বাভাবিক। এ রকমইতো হওয়ার কথা। তবে দুঃখজনক হলো অলস সময় না কাটিয়ে স্বউদ্যোগে আত্মউন্নয়ন করছে বা মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর হার তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং পত্রপত্রিকার খবর অন্তত তাই বলে।

এই পরিস্থিতিতে, যে সব শিক্ষার্থীরা লকডাউনের সময়ে নিজের আত্মউন্নয়ন এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের কাজে ব্যয় করছেন তাদের সাফল্যগাথাকে সারাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও তাদের বাবা-মায়েদের কাছে পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। তাদেরকে যুবসমাজের আইডল হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। বাবা-মা এবং সন্তান উভয় পক্ষকেই বোঝাতে হবে যে সন্তান পড়াশোনা করছে তারমানে এই নয় যে তাকে শিশুর ন্যায় লালনপালন করতে হবে, বরং আশেপাশে কোথায় কোন সুযোগ আছে যেটা ব্যবহার করে ছেলেমেয়েরা নিজের উন্নয়নে বা সমাজের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারে তা তাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে পড়াশোনাই জীবনের সব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আশায় বসে থাকার চেয়ে কোনো কাজে জড়িত হয়ে যাওয়াটাই বরং অনেক আনন্দের এবং সম্মানের। সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা করোনার এই সময়টা কীভাবে কাটাচ্ছে তার ওপর বিস্তারিত গবেষণা করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। এখান থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ালেখার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হওয়া, বাবা-মায়ের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমানো এবং মানবিক গুণাবলী অর্জন করার সংক্রান্ত শিক্ষাক্রম সংযুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের পরিবার এবং সমাজব্যবস্থাতেও কেমন করে এই বিষয়গুলোকে সংযুক্ত করা যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।