শহীদ বিতর্ক ও অনিরাপদ মাতৃভূমি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 4 Jan 2012, 02:52 AM
Updated : 14 Dec 2019, 12:32 PM
সব দেশে কিছু নিয়ম আছে। বিশেষত যেসব দেশ যুদ্ধ করে বা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীন হয় তাদের দেশের নিয়ম নীতি কিংবা ইতিহাস ঠিক হয় বিজয়ীর আদলে। বাবরের পর থেকে যতকাল মোঘল সাম্রাজ্য ছিল ততোকাল তাদের নীতিই ছিল ভারতের নীতি। পরে যখন ইংরেজ এলো আমরা ইংরেজদের নিয়মে চলতে থাকলাম। একসময় দেশ বিভাগের পর আমরা পড়লাম পাকিস্তানে। যতদিন পূর্ব পাকিস্তান ছিল ততোদিন সবাই তাদের নিয়ম মেনেছেন। উঠতে বসতে আমরা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-কে স্যালুট দিতাম। সেলাম ঠুকতাম আইয়ুব খানের ছবিতে। তারপর একাত্তর। সবাই জানেন কী হয়েছিল, আর কেন হয়েছিল। যাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ লেগেছিল বা যারা আমাদের যুদ্ধে বাধ্য করা হয়েছিল ৭১ এর ষোল ডিসেম্বরের আগে তারা জানতো তারাই দুনিয়ার সেরা ফৌজ। তাদের নাকি কেউ হারাতে পারবে না। আর এই হারা-জেতাটা বলার সময় তারা চীন বা  আমেরিকার কথা ভাবতো না। যেন দুনিয়ার একমাত্র দেশ ভারত। আর তাকে হারালেই বিশ্ব চ্যম্পিয়ন। যাক। কথা হলো সে যুদ্ধে ভারত একা জেতে নি। একা জিততে পারতো কি না তাও প্রশ্নবোধক। জিতেছিল কারণ আমরা ছিলাম সাথে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থন আর সহযোগিতাতেই পাকিস্তানের পারজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কাজেই আমাদের মানতে হবে- Victory has many friends, failure is an orphan.
ফলে বিজয়ী ও বিজিতের ভাষা বা ইতিহাস এক হবে না। গোড়া থেকেই দেখছি একমাত্র আমাদের দেশেই দেশের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ এমন কি বিজয় নিয়ে কুতর্ক আর বিবাদ চলছে। আমি ইচ্ছে করেই কম্বোডিয়া গিয়েছিলাম। তারাও আমাদের মতো দেশ। তাদের দেশেও গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। পলপটের জয় হবার পর তাকে সরাতে কষ্ট হয়েছে তাদের। কিন্তু সম্রাট আর গেরিলা বাহিনীর যুদ্ধে বিধ্বস্ত ফ্রান্সের একদা কলোনী এই দেশের জাদুঘরের চিত্রটা ভিন্ন। সেখানে তাদের দালাল রাজাকারদের মার্জনা চাওয়া মাফ চাওয়ার চিঠিগুলো বড় বড় করে দেয়ালে শোভা পায়। যেগুলোতে তারা মূল স্রোতে ফেরার জন্য আবেদন জানিয়েছিল। ভিয়েতনামও গিয়েছি আমি। উত্তর আর সাউথ ভিয়েতনামের যুদ্ধ গড়িয়েছিল আমেরিকা বনাম ভিয়েতনামের যুদ্ধে। রাশিয়া চীনসহ সমাজতান্ত্রিক নামে পরিচিত দেশগুলো উত্তর ভিয়েতনামকে সমর্থন দিয়ে জয়ী করায়। অন্যদিকে সাউথের সাথে থাকা খোদ আমেরিকা এমন সব বর্বর কাণ্ড করে যা আজো দুনিয়ার ইতিহাসে কলঙ্ক। নাপাম বোমায় ঝলসে যাওয়া নগ্ন ভিয়েতনামী নারী পুরুষের বিখ্যাত ছবিটি দেখে আমি বেশ কিছু সময় সেখান থেকে নড়তে পারিনি। এত সব বড় ঘটনার পর ও তাদের ভেতর জাতি দেশ বা ঐক্য নিয়ে ঝামেলা নাই। তাহলে আমাদের কেন আছে?
দূরে যাবার দরকার দেখি না। মোদী তো সারাজীবনই গান্ধী বিরোধী রাজনীতি করলেন। তিনি কি ভারতের জাতির জনককে নিয়ে কটূ কিছু বলেন এখন? বরং প্রায়ই দেখি মাথা নীচু করে গান্ধীজীর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পাকিস্তানিদের আমরা যত বড় বড় কথা বলি না কেন তারা জিন্নাহ নিয়ে বিতর্ক করে না। জাতি ও জাতির জনক তাদের কাছে সম্মানের। তাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়েও ঝামেলা নাই। আমাদের কেন এত সমস্যা? আমরা ধরে নিয়েছিলাম একসময় জগাখিচুড়ি পাকিধারাতেই চলবে দেশ। সে সন্দেহ মিথ্যা প্রমাণ করলো সময়। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু কন্যা তিনি পর পর কয়েকবার দেশ শাসনে আসার সুবাদে যুদ্ধপরাধীদের বিচার হলো। তখন শুনলাম আই ওয়াশ। কেউ তাদের টিকিও ছুঁতে পারবে না। রায় হলো। বলা হলো তাও লোক দেখানো। এরপর শাস্তি সর্বোচ্চ কার্যকর হলো। তখন শুরু হলো গুপ্তহত্যা। সবকিছু সময়ের হাত ধরে প্রশমিত হলেও একটা বিষয় হয়নি। যার প্রমাণ দেখলাম সম্প্রতি।
সংগ্রাম কেমন পত্রিকা বা দৈনিক তা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। দেশে নানা মতের পত্রিকা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এর নাম গণতন্ত্র। কিন্তু তার মানে কি এই মৌলিক বিষয় নিয়ে তারা বিদ্বেষ ছড়াতে পারবে? বা সরকার ও রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে? রাষ্ট্র ফাঁসি দিয়েছে কিন্তু দেশ ও জাতির হিরো এমন শহীদ কিন্তু আমাদের ইতিহাসেও আছে। যেমন- সূর্য সেন। যেমন- খুদিরাম। জহুরুল হকসহ আরো কত জন। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? তাঁদের ফাঁসি দেয়া হয়েছিল বিদেশি প্রভুদের আমলে কারণ তাঁরা বাঙালির ইতিহাস সংগ্রাম ও জাতিসত্তার হয়ে কথা বলতেন। লড়াই করতেন। আর কাদের মোল্লা? তিনি আমাদের দেশ স্বাধীন না হবার জন্য লড়াই করতেন। ষড়যন্ত্র করতেন। যুদ্ধাপরাধী ছিলেন। কাজেই তাকে শহীদ আখ্যা দেয়ার মানে কিন্তু সরকার ও রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা। যার আরেকটা অর্থ এই তাকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিয়ে মারা হয়েছিল। ঘটনার পরবর্তী অংশ আমি সমর্থন করি না। বাদ প্রতিবাদ হবে। আন্দোলনও হতে পারে কিন্তু হামলা করে পত্রিকা অফিস ভাঙচুর মানা যায় না। সেটুকু যারা করেছে তারাও অপরাধী। কিন্তু সেটা বড় করে নিয়ে আসল ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার কারণ নাই।
খবরে দেখলাম সম্পাদক মাফ চেয়েছেন। তিনি বয়সী মানুষ। খুব ভালো জানেন কোন ঘটনার জন্য মাফ চাইলে মাফ পাওয়া যায়। আর কোনটা না। কারণ এটা কোন অনিচ্ছাকৃত ভুল না। খবরটা দেখলেই বুঝবেন কতটা গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। তাও আবার কাদের মোল্লার ছবি সহকারে। কাদের মোল্লা ব্যক্তি হিসেবে কেমন ছিলেন সেটা বিবেচ্য না। এখানে সবার ওপরে দেশ ও মুক্তিযুদ্ধ। আজ এই ঘটনায় আমাদের সামনে একটা বিষয় পরিষ্কার দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি বা শাসনের লৌহ কঠিনতা যাই থাক না কেন এগুলো থামে নি। আওয়ামী লীগের সরকার অতীতের যে কোন সময়ের চাইতে শক্তভাবে ক্ষমতায় থাকার পরও যারা এমন ঝুঁকি নেয় তারা আসলে আমাদের কী বার্তা দিতে চায়? হয়তো তারা জেনে গেছে এদেশের বিশাল সংখ্যক মানুষের দিলে পাকিস্তান আর দালালদের জন্য ভালোবাসার অভাব নাই। বরং তা সুযোগ খুঁজছে। আর একটা বিষয়ে তাদের সাধুবাদ দিতে হয় তারা তাদের পথ ও মত থেকে সরেনি। সরে আসবে না। কিন্তু সেটা তো রাষ্ট্র আর জাতির জন্য ভয়াবহ ও  হুমকির সমান।
কাদের  মোল্লা শহীদ কি না সেটা যত বড় কথা তার চেয়ে বড় বিষয় লাখ লাখ মানুষের লাশ রক্ত আর ত্যাগের ওপর দাঁড়ানো বাংলাদেশের ভবিষ্যত বিজয় দিবসের প্রাক্‌কালে প্রায় পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়েও অনিরাপদ। মানুষ কি এসব নিয়ে ভাবছে আদৌ?