তৈমুর আলমের নির্বাচন বর্জন: শঙ্কায় জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যত

ধ্রুবতারা
Published : 30 Oct 2011, 09:08 AM
Updated : 30 Oct 2011, 09:08 AM

নারায়নগঞ্জ সিটি কার্পোরেশন নির্বাচন। একের পর এক নাটকীয়তার জন্ম দেয়া এই নির্বাচন জাতীয় ইস্যু না হলেও অনেক কারণে দীর্ঘ দিন থেকে এটি জাতীয় আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাত্র সাত ঘণ্টা আগে রাত একটা ত্রিশ মিনিটে প্রধান প্রতিদ্বন্দী তিনজন প্রার্থীর মধ্যে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার এর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা নির্বাচনের সব হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু সবচাইতে ভয়ের কথা হচ্ছে এই বর্জনের মাধমে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা যে এখন প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করেছে তা কারো জন্যই সুখকর নয়। যদিও আওয়ামি লীগের এক তরফা পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়ার লালসা আর বিএনপির চিরাচরিত অনড় অবস্থানে ইতোমধ্যেই জাতি তার ভবিষ্যত দেখতে শুরু করেছে।

বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামিলীগের ক্ষমতা গ্রহণ থেকে শুরু করে সরকারের অব্যাহত স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ আর বিএনপির অসহযোগী অবস্থান শুরু থেকেই এক দিকে যেমন দেশের অবস্থা শোচনীয় করে তুলছিল অন্যদিকে ভবিষ্যত সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনাকে করছিল ক্রমশ অনিশ্চিত। এমনি প্রেক্ষাপটে দেশের সুশীল সমাজ থেকে শুরুকরে অধিকাংশ রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ এমনকি নিজদলীয় নেতাদের মতামত কে পর্যন্ত উপেক্ষা করে আওয়ামিলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বাতিল করে দিলেন তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, ঘোষণা করলেন নির্বাচন করতে হলে তাদের অধিনেই করতে হবে এবং বিএনপি সহ সকল দল কে সেই নির্বাচনে আসতে হবে। স্বৈরতান্ত্রিক এমন ঘোষণা বাংলাদেশর মানুষ ইতোপূর্বে শুনেছে বলে জানা যায় না।

একই সাথে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধণী বাতিলের পাশাপাশি ইতোপূর্বের কয়েকটি সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে মুক্তি যুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, দেশপ্রেমিক রাষ্ট্র নায়ক জিয়াউর রহমান এর বিরুদ্ধে সর্বাত্বক কুত্‍সা রটনার পথ বেছে নেয়। এখানেই শেষ নয় বিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও মত কে চির তরে শেষ করে দেওয়ার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিরোধী রাজনৈতিক মত কে দমন করার সংস্কৃতি যদিও বাংলাদেশে নতুন নয়, কিন্তু এ সরকারের সাথে পার্থক্য এটাই যে এরা শুধু বিরোধী দল-মতকে দমন করেই ক্ষান্ত নয় বরং সে গুলিকে বাংলাদেশ থেকে চির তরে বিদায় করে দেওয়ার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সর্বোপরি জনগণের দেওয়া ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দলীয় ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার সব সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

সংখাগরিষ্ঠ বিরোধী জনগণের নেত্রী, তিন বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কে যখন স্বয়ং সরকার প্রধান চোর বাটপার বলে গালি দেন তখন বিরোধী দল ও মত কে সরকার কতটা নিষ্প্রয়োজন মনে করে তা ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন হয় না। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ প্রত্যংগে অভূতপূর্ব দলীয়করণ, নির্বাচন কমিশনের আইন সংস্কার ও নিয়গে বিরোধী মতামত কে উপেক্ষা, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষেত্রে সর্বাত্বক দলীয় করণ গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে অসম্ভব করে তুলেছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে অতি সহজে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনকে চিনতাই করার সর্বশেষ হাতিয়ার হিসাবে সব রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক মত কে উপেক্ষা করে ইভিএম ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবস্থা চালু করেছে। যার উদ্ভাবকরা পর্যন্ত এতে কচুপি সম্ভব বলে মত দিয়েছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, পূর্ববর্তী ব্যবস্থায় কারচুপি হলে যদিও তা উদঘাটনের কিছু উপায় ছিল কিন্তু এতে সে ধরনের কোনও উপায়ই থাকছেনা। তবে আশার কথা এই যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে তিন বছরে বাংলাদেশের কোনও ডিজিটাল অগ্রগতি সাধন করতে না পারলেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে কারো টের পাওয়ার আগেই কিভাবে বড় বড় চুরি সাধন করা যায় তার যথাযথ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন। উন্নত বিশ্বের ডিজিটাল দেশ গুলি যেখানে ইভিএম এর উপর আস্থা রাখতে পারছেনা সেখানে আমরা এতটাই ডিজিটাল হয়ে উঠেছি যে ইভিএম ছাড়া নির্বাচন করাটাই যেন এখন অসন্মানের।

এমনি এক প্রেক্ষাপটে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনকে স্বাভাবিক ভাবেই সবাই উত্‍সাহের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করেছে। কিন্তু ক্ষমভালোভী সরকার এটিকেও জনগণের হাতে ছেড়ে দিতে পরলোনা। তাদের দলের জনগণের পছন্দের প্রতিনিধি আইভি কে বাদ দিয়ে তারা সন্ত্রাসের গডফাদার শামীম উসমানকে সমর্থন করলেন। কারণ হিসাবে যা ধারনা করা হচ্ছে তা হচ্ছে বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে গায়ের জোরে নির্বাচনে জিতার ক্ষমতা আইভির নেই, কিন্তু সেখানে তাদের দলের মেয়র তো করতেই হবে। দ্বিতীয়ত নির্বাচনে জিতলেও পুরো এলাকায় নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি রক্ষা করা, বিরোধীদল কে দমন করা আর আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে পুরো নারায়নগঞ্জ এলাকায় নিজেদের দলীয় সব প্রার্থী কে গায়ের জোরে জিতিয়ে আনার ক্ষমতা আইভির নেই। ওদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সাধারণ জনগণ আর অধিকাংশ প্রার্থীর আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েনের অনুরোধ জানায়। কিন্তু আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য কর গেল যে সরকার সংবিধান, আইন-কানুন, নির্বাচন কমিশন, সাধারণ জনগণ এমনকি প্রার্থীদের আবেদনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন থেকে বিরত থাকলো। দুঃখের বিষয় এই যে বিষয় টি আমাদের গৃহ পালিত নির্বাচন কমিশন কেও নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত জানতে দেওয়া হলনা। তাই না পারতে সিইসি মহোদয় দুখঃ আর ক্ষোভ দমিয়ে রাখতে পরলেননা। এর মধ্যে নির্বাচনে সরকারের মনোনীত নায়ক শামীম ওসমান সাহেব জঙ্গি হামলার সম্ভাবনার নতুন তত্ত্ব তুললেন। যেন শুধু নিঃশব্দ কারচুপির মাধ্যমেই নির্বাচন জিতা সম্ভব না হলে কোনও কেন্দ্রে হামলার প্রয়োজন পড়লে সেটাকে পরবর্তীতে জঙ্গি হামলা হিসাবে চালিয়ে দেয়াও যায়।অথচ বেরসিক সরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বতা তাত্‍খনিক বুজতে সমর্থ হলেননা। নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হচ্ছেনা তথ্যটা প্রকাশ হওয়ার পর পরই আমাদের নায়কের বাহিনী মাঠে নেমে তাদের দায়িত্ব যথাযথ দায়িত্বশীলতার সাথেই পালন করা শুরু করলেন। এমতাবস্থায় খেলা শুরু হওয়ার আগেই যখন খেলার ফলাফল পাবলিশ হয়ে গেল তখন অন্ততপক্ষে খেলার আগেই ওয়াকআউট করে বাকি সন্মান টা রক্ষা করার চেষ্টা করলেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার।

এতো গেল ছোট এক খেলার কাহিনী। অপেক্ষা বড় কোনও খেলার! অপেক্ষা আমাদের নিয়তির। যে খেলার টেস্ট ম্যাচের স্বরূপ হয় এমন সে খেলার ফাইনালের ভবিষ্যত অনুমান করা যায় কিন্তু ভাবা যায় না কতটা ভয়াবহ হতে পারে সেটা। কারণ ভাবতে গেলে যাদের হার্ট একটু দুর্বল তারা আর কষ্ট করে খেলা দেখার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবেনা তার আগেই জীবনের ফাইনাল খেলা সেরে যাবে। আর যাদের হার্ট একটু শক্ত আছে তারা নাহয় ভাবতে থাকুন আর অপেক্ষা করতে থাকুন ট্রাজেডিক এক ফাইনাল ম্যাচের।