আরব বসন্তে ইউরোপীয় নীতি (পর্ব-১)

মেফতাউল ইসলাম
Published : 6 Nov 2012, 04:48 PM
Updated : 6 Nov 2012, 04:48 PM

ভূমিকাঃ

গণতন্ত্রের দাবিতে আরব বিশ্বের জনগণ ২০১০ সালের শেষের দিকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। প্রথমে তিউনিসিয়ায় এ আন্দোলন শুরু হয়ে তা সমগ্র আরব দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে তিউনিসিয়ার বেন আলী, মিসরের হোসনি মোবারক, ইয়েমেনের আলী আব্দুল্লাহ সালেহর পতন ঘটে। বিদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন গাদ্দাফির মত লৌহমানব। সিরিয়ার জনতার অগ্নিকণ্ঠ এখনও বাশার সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। আন্দোলন পরবর্তী কয়েকটি দেশে ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক শাসকরা ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। প্রতিটি দেশেই ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। এই আন্দোলনে ইউরোপীয়রা লাভবান হয়েছেন না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তার হিসাব এখন অনেকেই কষছেন। তবে অনেকেই ভাবছেন ইসলামপন্থী দলগুলো ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় পশ্চিমাদের স্বার্থ যতটুকু রক্ষিত হওয়ার কথা তা আর হবেনা। কেননা সিএনএন কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে গণজাগরণ পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মতামতকে আর তেমন প্রাধান্য দিচ্ছেনা। হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর ব্যঙ্গচিত্র এবং মুসলমানদের সমালোচনা করে 'ইনোসেন্স অব মুসলিম' নামক একটি মার্কিন চলচিত্র নির্মিত হওয়ায় আরব বিশ্বে এর বিরদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে যা আরব বিশ্বে পাশ্চাত্যদের প্রভাব আরও কমাতে পারে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যে তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন,' এই বিক্ষোভে ইসলামপন্থী শাসকদের হাত থাকতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র ইসলাম শাসক চালিত মিসরকে তার শত্রুও মনে করেনা আবার বন্ধুও মনে করেনা।' অর্থাৎ পরিবর্তিত আরব বিশ্বে পশ্চিমারা কোন ধরনের নীতি অবলম্বন করবে তা এখনও তারা নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই এ গণআন্দোলনে ইউরোপীয়ান দেশগুলো যে খুব বেশি লাভবান হয়েছে তা বলা যায়না। তবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এবং গৃহযুদ্ধকে উসকে দিয়ে তারা লিবিয়ার তেল ভান্ডার দখল নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে পারে বলে অনেকেই ধারনা করছেন।

আরব বসন্ত কীঃ

আরব রাষ্ট্রসমূহের জনগণ ২০১০ সালের শেষের দিকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পতনসহ বিভিন্ন দাবিতে যে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু করে তাকে বলে আরব বসন্ত বা আর-রবিউল আরাবী। এর আরেক নাম আরব গণজাগরণ। পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে আত্মাহুতি প্রদানকারী তিউনিসিয়ার নাগরিক মোহাম্মদ বুয়াজিজির মৃত্যুর মাধ্যমে ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ সালে এটি শুরু হলেও ক্রমেই তা মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এই আরব বসন্তের জন্ম দিয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আরব রাষ্ট্রসমূহের বিদ্যমান রাজতন্ত্র, মানবাধিকার লংঘন, অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন আরব দেশসমূহে শ্রমিক শোষণ চলছিল। যার ফলে ভেতরে ভেতরে আরও অনেক আগেই মৃদু প্রতিবাদ দানা বেঁধে ওঠে।

বিগত দশকে এ অঞ্চলের জীবণযাত্রার মান যথেষ্ঠ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে গণসচেতনতা সৃষ্টি হয় এবং গণজাগরণ তরান্বিত হয়। এ গণজাগরনের ফলে ১৪ই মার্চ, ২০১১ তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী বরখাস্ত হন এবং পালিয়ে সৌদি আরবে যান। এরপর ক্রমে মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন,বাহরাইন, আলজেরিয়া, লেবানন, জর্ডান, মৌরতানিয়া সুদান, ওমান, কুয়েত, মরক্কো এবং সিরিয়ায় এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন বেগবান করতে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক এবং টুইটারকে ব্যবহার করা হয়। এই আন্দোলনে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক পদচ্যূত হন এবং তার সরকার ক্ষমতা হারায় ১১ ফেব্রুয়ারি,২০১১। লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি ২০অক্টোবর,২০১১ বিদ্রোহী জনতা এবং ন্যাটো বাহিনীর দ্বারা নিহত হন। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। সিরিয়া ও বাহরাইনে সরকার পতনের অপেক্ষায় বিক্ষোভ অব্যাহত আছে। কুয়েত, লেবানন এবং ওমানে বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে সরকার বদল হতে পারে। মরক্কো ও জর্ডানে বিক্ষোভের ফলে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়েছে। মূলত গণতন্ত্র, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং স্বেরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বের জনগণ যে সাম্প্রতিক গণআন্দোলন গড়ে তুলেছে তাই আরব বসন্ত নামে পরিচিত।

আরব দেশগুলোতে ইউরোপীয় পররাষ্ট্রনীতিঃ

বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশই তার পররাষ্ট্রনীতি প্রনয়ণের ক্ষেত্রে নিজ স্বার্থকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়। ইউরোপীয় দেশগুলোতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে আঞ্চলিক গুরুত্বভেদে অনেকসময় পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্যমাত্রাগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে। আরব দেশগুলোতে ইউরোপীয়দের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্যমাত্রা হলঃ

 অধিকাংশ আরব দেশই তেল সম্পদে সমৃদ্ধ। তাদের রয়েছে অফুরন্ত তেলের ভান্ডার। তাই আরব বিশ্বের দেশগুলোর কাছ হতে এতদিন তেলের সুবিধা নেয়ার জন্য সেখানকার স্বৈরশাসকদের সমর্থন দিয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলো।

 সুয়েজ খালের গুরুত্ব মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বেশি হওয়ায় ইউরোপীয় দেশগুলো সবসময় মিসরের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়েছে। এবং দেশটিকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক সহায়তা দিয়েছে।

 তেল সমৃদ্ধ দেশ ইরানের সাথে ইউরোপের দেশগুলোর সম্পর্ক ভালো না হওয়ায় এই দেশটির প্রতি তারা সবসময় বৈরি নীতি অবলম্বন করেছে। তারা ইরানকে একঘরে করে রাখার জন্য প্রানান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে।

 সৌদি আরব তেল সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় এবং পশ্চিমাবিশ্বের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হওয়ায় তারা এই দেশটির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।

 মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাঈলকে পশ্চিমারা তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র মনে করে। ইসরাঈলের মাধ্যমেই তারা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। তাই তারা দেশটিকে অনেক সাহায্য সহযোগীতা করে থাকে এবং তাদের সমস্ত অপকর্মকে বৈধতার সার্টিফিকেট দেয়।

 ইউরোপীয় শক্তি মনে করে মধ্যপ্রাচ্য হল সন্ত্রাসের চারণক্ষেত্র। তাই এ অঞ্চলের সন্ত্রাস সম্পর্কিত ইস্যুগুলোকে তারা বিশেষ গুরুত্বের সাথে ব্যাখ্যা করে।

 তারা ধর্মনিরপেক্ষতায় কথা বলে আরব বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর নিকট হতে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে থাকে।

 মধ্যপাচ্যের দেশগুলোতে সবসময় অস্থিতিশীলতা বজায় রেখে তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মিথ্যা বুলি আওরিয়ে অস্ত্র বিক্রি করে এবং সে অনুযায়ী নীতিমালাও প্রনয়ণ করে।
চলবে…………