আরব বসন্তে ইউরোপীয় নীতি (পর্ব-৩)

মেফতাউল ইসলাম
Published : 22 Nov 2012, 05:24 AM
Updated : 22 Nov 2012, 05:24 AM

দেশে দেশে গণবিপ্লব

লিবিয়াঃ
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফি বিরোধী বিক্ষোভ এবং লড়াই শুরু হয়। ১৭ই ফেব্রুয়ারি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। একটি থানার নিকট শত শত জনতা এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। এসময় সহিংসতায় বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী নিহত হয়। এ দিনটিকে 'দ্যা ডে অব রিভোল্ট' বলা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারিতে বিদ্রোহীরা বেনগাজি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর দুপক্ষের মধ্যে বেশকিছুদিন লড়াই চলতে থাকে। ১৯মার্চ পশ্চিমাবিশ্ব গাদ্দাফির পতনের লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করে।

গাদ্দাফি ক্ষমতায় আসীন হয়েই লিবিয়ার তেল কোম্পানিগুলোকে পশ্চিমাদের প্রভাবমুক্ত করেছিলের এবং পশ্চিমাপন্থী কর্মচরীদের পদচ্যূত করেছিলেন। ফলে তেল সম্পদ সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রনে চলে এসেছিল এবং পশ্চিমাবিশ্ব লিবিয়ার তেলসম্পদ থেকে কোন সুবিধা নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই পশ্চিমা দেশগুলো অনেক আগে হতেই গাদ্দাফিকে হটানোর জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল এবং লিবিয়ার এই গণজোয়ারে বিদ্রোহীদের সাপোর্ট দিয়ে তারা গাদ্দাফি বিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে থাকে। পশ্চিমাদের সাথে পেয়ে বিদ্রোহীরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এ বছরের ২৭শে ফেব্রুয়ারীতে বিদ্রোহীরা ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল(এনটিসি) গঠন করে। পশ্চিমারা তেল সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়াতে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আশায় এনটিসি কে সমর্থন দান করেন এবং তাদের স্বার্থেই এ বছরের ২৬শে ফেব্রুয়ারী নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ১৭ই মার্চ লিবিয়াতে 'নো ফ্লাই জোন' কার্যকরসহ শুরু হয় সেখানে ন্যাটোর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের বিমান হামলা। এর নাম দেয়া হয় 'অপারেশন অডিসি ডন"। একের পর এক বিমান হামলায় গাদ্দাফি বাহিনী ধীরে ধীরে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। এটাকেগাদ্দাফি লিবিয়ার প্রতি পশ্চিমাদের অন্যায় আগ্রাসন বলে আখ্যা দেন এবং এই আক্রমণের কঠোর জবাব দেবেন বলে ঘোষনা দেন। তিনি লিবিয়ার জনগণকে এই আক্রমণ প্রতিহত করার কথা বললেও জনগণ উল্টো বিদ্রোহীদের সহায়তা করতে থাকে। এভাবে একগুয়েমিতার কারণে ধীরে ধীরে বেনগাজী, ত্রিপোলি ও বাব আল আজিজিয়া বিদ্রোহীদের দখলে আসে। ২২আগষ্ট বাব আল আজিজিয়া হতে আতœগোপনের পর আর তাকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি। এরপর বিদ্রোহীরা তার খোঁজে তার জন্মশহর সিরতের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এবং ২০অক্টোবর সেখানেই বিদ্রোহীরা গাদ্দাফিকে মারাতœক আহত অবস্থায় জীবিত আটক করেন ও কিছুক্ষণ পরেই তিনি মারা যান বলে জানা যায়। এভাবে গাদ্দাফির দীর্ঘ ৪২ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।

গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়াঃ

গাদ্দাফির পতনের পর 'ন্যাশনাল ট্র্র্যানজিশনাল কাউন্সিল'(এনটিসি) ক্ষমতা গ্রহণ করে। কয়েকমাস ক্ষমতায় থাকার পর এনটিসি ৮ আগষ্ট, ২০১২ নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এনটিসি প্রধান মুস্তফা আবদেল জলিল রাজধানী ত্রিপোলীতে ২০০ সদস্যের জাতীয় পরিষদের প্রবীণতম সদস্য মোহাম্মদ আলী সেলিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এ ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যে দিয়ে এনটিসি বিলুপ্ত হয়। জাতীয় পরিষদ ক্ষমতা গ্রহণের পর বৈঠকে বসলে মোহাম্মদ ইউসুফ আল মাগরিফকে জাতীয় পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। আবার জাতীয় পরিষদ মুস্তাফা আবু শাগুরকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন। জাতীয় পরিষদের দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটিতে মাত্র দুই ভোটের ব্যবধানে আবু শাগুর মাহমুদ জিবরিলকে পরাজিত করেন। অবশ্য প্রথম দফার ভোটে মাহমুদ জিবরিল বিজয়ী হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, চলতি বছরের ৭ জুলাই লিবিয়ার ইতিহাসে প্রথম অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জনগণের ভোটে জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যরা নির্বাচিত হন। অবশ্য এই ভোটে কোন রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিলনা।

পশ্চিমা শক্তির লিবিয়ার আগ্রাসনের কারণঃ

• বিশাল তেল সম্পদের লুণ্ঠন।লিবিয়া বিশ্বের ১০ম তেল সরবরাহকারী দেশ। ইউরোপের তিনটি দেশ লিবিয়ার তেল সম্পদের ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল, যেমন ইতালি ২৯ ভাগ, ফ্রান্স ১৪ ভাগ এবং স্পেন ১০ ভাগ। এই কারণেই ন্যাটোর নেতৃত্বে যারা লিবিয়ায় হামলা চালায় তাদের মধ্যে অগ্রগামী দেশ হল ফ্রান্স, ইতালি এবং যুক্তরাজ্য।
• গাদ্দাফির পতন ঘটানোই ছিল লিবিয়ায় ইউরোপীয়দের আগ্রাসনের প্রধান লক্ষ্য, কেননা সে পশ্চিমাদের স্বার্থবিরোধী অনেক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছিল। লকারবি বিমান হামলাকারীদের গাদ্দাফি সহায়তা করেছিলেন বলে পশ্চিমা বিশ্ব অভিযোগ করে।
• লিবিয়ায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে সেখানে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসানো ছিল লিবিয়া আগ্রাসনের অন্যতম কারণ।
• লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে গাদ্দাফি বিরোধীদের প্রভাব বেশি ছিল, আর পশ্চিমাঞ্চলে গাদ্দাফির সমর্থকদের প্রভাব বেশি ছিল। লিবিয়ার বেশিরভাগ তেলকূপ রয়েছে পূর্বাঞ্চলে। আর এই অঞ্চলেই ইতালি, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো কাজ করছিল। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের সুবিধার স্বার্থে প্রয়োজনে লিবিয়াকে দু'ভাগ করতেও প্রস্তুত ছিল। আসলে লিবিয়া এখন কার্যত দু'ভাগে বিভক্ত। লিবিয়াকে দু'ভাগে ভাগ করা হতে পারে মূলত কয়েকটি কারণে। ক. ইতিমধ্যে পশ্চিমাশক্তি সুদানকে দুভাগে ভাগ করেছে, এতে তাদের ডিভাইড এ্যান্ড রুল পলিসির মাধ্যমে দেশটিকে দুর্বল করা হয়েছে। নতুন দেশ দক্ষিণ সুদান হতে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চলছে। আবার নিজেদের দুর্বলতার সুযোগে দক্ষিণ সুদানও বাধ্য হবে তাদের অনৈতিক দাবি মেনে নিতে। আর লিবিয়াকে বিভক্ত করা গেলে ঠিক একই ধরনের নীতি গ্রহণ করা যাবে। খ. লিবিয়াকে দুভাগে ভাগ করলে তাদের জাতিসত্তাকে দুর্বল করা যাবে এবং এ সুযোগে তেল সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। গ. বিভাজিত লিবিয়াতে পুতুল সরকার বসিয়ে মিসর ও তিউনিসিয়াসহ পুরো সাব সাহারা অঞ্চল পশ্চিমাদের কব্জায় আনা যাবে।
• পশ্চিমা আদর্শ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যও এ আগ্রাসন চালানো হতে পারে।