ফিলিস্তিনিদের লালিত স্বপ্নের বিজয় এবং ভবিষ্যতের হাতছানি।

মেফতাউল ইসলাম
Published : 3 Dec 2012, 12:28 PM
Updated : 3 Dec 2012, 12:28 PM

২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনিদের নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যবহ দিন। এই দিন একই সাথে তাদের নিকট ট্র্যাজেডির আবার বিজয়ের দিন হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘে ব্রিটিশ শাসিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে দু'ভাগ করে এর একভাগে ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওপর ভোট গ্রহণ করা হয়েছিল। ওই সময় ইসরাঈলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পড়েছিল ও ট্র্যাজেডি রচিত হয়েছিল ফিলিস্তিনিদের জন্য। কিন্তু ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস! ৬৫ বছর পরে ওই একই দিনের ইতিহাস অন্যরূপ। ঠিক ১৯৪৭ সালের মতই ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে ফিলিস্তিনকে 'পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের' মর্যাদা দিতে ভোটাভুটি হয়। এতে বিপুল ভোট পড়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। এবারে উল্লাসিত হয় ফিলিস্তিন শিবির, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের জয়ের ইতিহাস প্রত্যাখ্যান করে ইসরাঈল। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করলে কি হবে জয় যেহেতু ফিলিস্তিনিদের হয়েছে সেহেতু তারা এখন এগিয়ে যাবেই।
স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্নদ্রষ্টা ইয়াসির আরাফাত এই ঐতিহাসিক ক্ষণটিতে বেঁচে থাকলে অত্যন্ত খুশি হতেন। কেননা আরাফাতই ১৯৬৪ সালে পিএলও গঠন করে ইসরাঈলের বিপক্ষে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। আর তার সেই দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল হল আজকের স্বায়ত্ত্বশাসিত ফিলিস্তিন। এই জয় পুরো ফিলিস্তিনিদের। আর পরাজয় সেই সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং তার তাবেদার ইসরাঈলের। এটা সুনিশ্চিতভাবে মার্কিনীদের এক ঐতিহাসিক কূটনৈতিক পরাজয়। কেননা পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের এই আবেদনের বিপক্ষে কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। বরং ভোটাভুটির ফলাফল বলে দেয় তা যুক্তরাষ্ট্রকে চপোটাঘাত করার মতই অবস্থা হয়েছে। ১৯৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৩৮টি রাষ্ট্রই প্রস্তাবের পক্ষে রায় দিয়েছে। শুধুমাত্র ৯টি দেশ দিয়েছে বিপক্ষে ভোট। সবচেয়ে বড় চমক যুক্তরাষ্ট্রের একান্ত ঘনিষ্ঠ মিত্র ফ্রান্স এবং ইউরোপের অনেক দেশই এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে।। আবার যুক্তরাজ্য, জার্মানি ভোটদানে বিরত থেকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নীরব সমর্থন জ্ঞাপন করেছে।
উল্লেখ্য যে, ২০১১ সালে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ণাঙ্গ সদস্য রাষ্ট্রের আবেদন করলে যুক্তরাষ্ট্র তাতে ভেটো দেয়। নিরাপত্তা পরিষদে ১৫ সদস্যের সর্বাধিক রাষ্ট্র সমর্থন করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধীতার কারনে তা নস্যাৎ হয়ে যায়। নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি সুরহা না হওয়ায় সাধারন পরিষদ উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভোটাভুটির ভিত্তিতে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় ফিলিস্তিন। ধারনা করা হচ্ছে এই পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ তাদের জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ফলই বয়ে আনবে। ইতিবাচক ফলাফল হিসেবে ফিলিস্তিন এখন থেকে যে সুবিধাগুলো পাবে তা হল এরকমঃ (১) ফিলিস্তিন এতদিন জাতিসংঘের অধিশেনে যোগ দেয়ার সুযোগ পেত 'পর্যবেক্ষক অঞ্চল'(এনটিটি) হিসেবে। পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়ায় ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি এখন সাধারন পরিষদের বিতর্কে অংশ নিতে পারবে, যা তারা পূর্বে পেতনা। (২) পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা ভূখন্ডের ওপর ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ মালিকানার দাবি মেনে নিয়েছে জাতিসংঘ। অর্থাৎ ফিলিস্তিনের যে সীমানার দাবি তা একধরনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল। (৩) ফিলিস্তিন এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), স্বাস্থ্যসংস্থাসহ জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাগুলোতে যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করতে পারবে। (৪) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য হতে পারলে ফিলিস্তিনিরা ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনতে পারবে। গাজায় ইসরাঈলি গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং পশ্চিম তীরে অবৈধভাবে ইহুদি বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধেও তারা এখন মামলা করতে পারবে। এর ফলে ইসরাঈলের সামরিক বাহিনীর সদস্য ও অবৈধ বসতি স্থাপনকারি ইসরাঈলিরা আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে পারেন। (৫) জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের ভোটে উন্নীত হওয়ায় ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতির দাবি আরও জোড়ালো হবে। (৬) ভোটের ফল অবশ্যই ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে দীর্ঘ বিলম্বিত আলোচনার উপর প্রভাব ফেলবে। হামাস ইতোমধ্যে জাতিসংঘে আব্বাসের সদস্যপদ লাভের প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। তারা প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পর গাজায় আনন্দ মিছিল বের করেছিল। অর্থাৎ এই বিজয় সমস্ত ফিলিস্তিনিদের একত্রিত করবে এবং অনুপ্রেরণা জোগাবে।
এই ঐতিহাসিক বিজয় ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন পূরণে অনেকটাই সফল হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও এ বিজয়ের মাধ্যমে যে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবেনা তা কোনভাবেই বলা যায়না। নেতিবাচক পরিস্থিতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ (১) জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের এই বিজয়ের ফলে ইসরাঈল আরও আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। আর তাতে লজ্জাজনকভাবে সমর্থন জোগাতে পারে একচোখা পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। (২) ইসরাঈল ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনিদের 'পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের' মর্যাদা পাওয়ার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে বসতি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ এলাকায় তিন হাজার নতুন বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা তারা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে। ইসরাঈলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র যদিও ইসরাঈলের এ সিদ্ধান্তকে 'হঠকারী' বলে অভিহিত করেছে তবুও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় তারা ইসরাঈলের পাশেই থাকবে। (৩) ইসরাঈল বিভিন্ন হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হামাসকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করবে এবং পক্ষান্তরে সে নিজ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নামে ফিলিস্তিনে নির্বিচারে আক্রমণ চালাবে। (৪) ফিলিস্তিনিরা যদি আইসিসি'র শরণাপন্ন হয় তাহলে ইসরাঈলিদের প্রতিক্রিয়া অতি রূঢ় হতে পারে। ইসরাঈল তখন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের ট্যাক্স প্রবাহ করতন এবং আমদানি রপ্তানি বাবদ শুল্ক প্রদান বন্ধ করে দেয়ার মত কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে। (৫) ফিলিস্তিন এখন জাতিসংঘের সংস্থাগুলোতে যোগ দিতে পারবে। তবে এখানেও বাঁধার প্রাচীর হয়ে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র তার আইন অনুযায়ী জাতিসংঘের যেসব সংস্থা ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নেবে, সেসব সংস্থায় তহবিল জোগানো বন্ধ করে দিতে পারে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র তার আইন পরিবর্তন না করা পর্যন্ত টানাপোড়েন থেকেই যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে জাতিসংঘ বাজেটের এক-পঞ্চমাংশ কর্তন করেছে একই কারনে।

সুতরাং ফিলিস্তিনিদের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা প্রাপ্তি তাদের জন্য কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে আশার বিষয় এই যে সময়ের বিবর্তনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেক্ষেত্রে ইসরাঈল ও যুক্তরাষ্ট্র যদি ফিলিস্তিনিদের প্রতি রূঢ় আচরণ প্রকাশ করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই দু'রাষ্ট্রের প্রতি আরও বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে মিত্রহীন করে ফেলতে পারে। তাই এ মুহুর্তে তারা কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেনা বলেই ধারনা করা হচ্ছে। তবে ফিলিস্তিনিদেরকেও সংঘবদ্ধ হতে হবে। হামাস ও ফাতাহ এর মধ্যে যে বিরোধ তা মিটিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে। আর প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর উচিৎ হবে ফিলিস্তিনিদের সর্বাত্মক সহায়তা করা। ইসরাঈল যাতে কোনভাবেই ফিলিস্তিনিদের উপর চড়াও হতে না পারে তার নিশ্চয়তা প্রতিবেশি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকেই দিতে হবে। মনে রাখতে হবে ঐক্যবদ্ধতার ভিত্তিতে এবং পরিকল্পিত সফল কূটনীতির মাধ্যমে যদি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একই প্লাটফর্মে দাড়াতে পারে তাহলে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান সহজেই করা সম্ভব হবে।