বিশ্বজিৎরাই মরবে

মেফতাউল ইসলাম
Published : 10 Dec 2012, 08:05 PM
Updated : 10 Dec 2012, 08:05 PM

১০ই ডিসেম্বর প্রতিদিনের মত সকালে ঘুম থেকে উঠেই পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ছবি দেখে আমার শরীর শিউরে উঠল। ছবিটিতে দেখলাম এক নিরীহ পথচারীকে পাঁচ-ছয় জন মানুষরূপী হায়েনা নির্বিচারে আঘাত করছে। আঘাতে তার শরীর থেকে প্রবাহিত তাজা রক্তে রঙ্গিন হয়ে গেছে শার্ট, কিন্তু তারপরও পাষাণের মন ভরেনি। শেষপর্যন্ত তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে নিজেরা বীরদর্পে পালিয়ে গেছে। পত্রিকা পড়ে বুঝতে পারলাম এই নিরীহ বেচারীর নাম বিশ্বজিৎ দাস। পেশায় একজন দর্জি। কোন রাজনৈতিক দলের সাথে তার যোগসাজোশ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দলের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মকান্ডের নির্মম বলি সে। বিশ্বাজিৎ একজন সাধারন দর্জি। কাস্টমারের ফোন পেয়ে টেইলার্সে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। আর এই বের হওয়াই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। মৃত্যুর মাধ্যমে সে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়ে গেল শুধু তার মত 'বিশ্বজিৎরাই মরবে'। রাজনীতির ফাক-ফোকরে শুধু বলির স্বীকার হবে নিরীহরাই। কিন্তু বিশ্বজিৎদের যারা মারল তাদের কোন বিচার হবে কি?

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি এতটাই নোংরা পর্যায়ে পৌছে গেছে যে এর মাধ্যমে শুধুমাত্র স্বার্থ হাসিলের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। আর এই স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে অকাতরে ঝড়ে যাচ্ছে কিছু নিষ্পাপ প্রাণ, যাদের রাজনীতি নিয়ে কোন মাথাব্যথাই নেই। আজকের বাংলাদেশের রাজনীতি হল গরীবের পেঠে লাথি মারার রাজনীতি। একদল হরতাল দেবে, অবরোধ ডাকবে, অন্যদল প্রতিরোধ করবে, মাঝখান থেকে দিনমজুররা উপার্জণ করতে না পেরে থাকবে অনাহারে। বিশ্বজিৎ সেই অভাগাদের একজন যে দু'পয়সা উপার্জনের আশায় ঘর থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু হায়েনারা তাকে কর্মস্থলে যেতে দেইনি, চালিয়েছে তার উপর অজ¯্র নির্যাতন। শত কাকুতি মিনতি করেও বিশ্বজিৎ রক্ষা করতে পারেনি তার প্রিয় জীবনটিকে। হায়রে রাজনীতি, হায়রে সরকারি দল, হায়রে বিরোধীদল, যে জনগণের কল্যাণের কথা বলে তারা রাজনীতি করছে সেই জনগণই হচ্ছে আজ রাজনীতির নির্মম বলি।

কিন্তু জনগণ কি এই রাজনীতি চায়? জনগণ কি এই ছাত্রসমাজকে চায় যারা নির্বিচারে তার ভাইকে হত্যা করবে? যদি জনগণের কল্যাণেই রাজনীতি হয় তাহলে দু'পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় জনগণের এই দুর্ভোগ কেন? সহিংসতার মাধ্যমে কি কল্যাণ বয়ে আনা সম্ভব? কেনই বা রাজনৈতিক দলগুলো সহিংসতার পথ বন্ধ করে সমঝোতার পথ বেছে নিচ্ছেনা? উত্তর একটাই। সেটা হচ্ছে স্বার্থ এবং আধিপত্যবাদী মানসিকতা। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা আজ আধিপত্য বজায় এবং নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যস্ত। জনগণকে সুখের গল্প শুনিয়ে ভোট আদায় করাই তাদের বিশেষ চরিত্র। আজকের রাজনীতি শুধু দলীয় আনুগত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেখানে জনকল্যাণের লেশমাত্র নেই। যে দলের জন্য চাপাবাজি করবে, যে দলের জন্য মানুষ খুন করবে, যে দলের জন্য রিভালবার, চাপাতি, হকিস্টিক ধরবে সেই হবে দলের ত্যাগী নেতা। এই হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতির বর্তমান চিত্র।

কিন্তু আমরা যারা সাধারণ আমজনতা তারা এই অবস্থার পরিবর্তন দেখতে চাই। আমরা দেখতে চাই এমন রাজনীতি যেখানে সহিংসতা না থেকে থাকবে সমঝোতা। আমরা চাই এমন রাজনীতি যাতে বিশ্বজিৎদের আর নির্মম বলির স্বীকার হতে না হয়। আমরা চাই এমন রাজনীতি যেখানে মানুষ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। রাজনীতি হতে হবে গঠনমূলক। ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের মাধ্যমে রাজনীতি পরিচালিত হলে আমাদের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হতে পারে। তাই বিজয়ের এই মাসে আমাদের উচিৎ ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পরিত্যাগ করে পারস্পরিক সমঝোতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে এমন কোন সিদ্ধান্ত এই মুহুর্তে নেয়া ঠিক হবেনা যার মাধ্যমে দেশ বিশ্ব দরবারে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হয়। সরকারি দলের উচিৎ হবে বিরোধী দলের দাবিগুলোকে সম্মান জানানো। আবার বিরোধী দলেরও উচিৎ হবে সরকারকে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনায় সহায়তা করা। দেশের জাতীয় স্বার্থগুলোতে দুই দলকে একই প্লাটফর্মে দাঁড়াতে হবে। সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে যতদিন না মতানৈক্য দুরীভূত হবে ততদিন অস্থিতিশীলতা চলতেই থাকবে, যার নির্মমতার স্বীকার হবে নিরীহ জনগণ। যেটা কোনভাবেই মেনে নেয়ার মত নয়।

***
ফিচার ছবি: ভিডিও (লিংক) থেকে নেয়া 'স্ক্রিন ক্যাপচার'