পাকিস্তানের রাজনীতি কোন পথে?

মেফতাউল ইসলাম
Published : 28 Jan 2013, 05:31 PM
Updated : 28 Jan 2013, 05:31 PM

দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন চাপে জারদারি সরকার আজ হাঁপিয়ে উঠেছে। দেশের ভেতরে একের পর এক বোমা হামলা, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনায় অতীষ্ঠ তার সরকার। আবার কানাডা ফেরত তাহির-উল-কাদির দেশে প্রত্যাবর্তন করেই বিশাল সমাবেশ ও লংমার্চের মাধ্যমে সরকারকে আলটিমেটাম প্রদান এবং একই সময়ে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট সেদেশের প্রধানমন্ত্রির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি আদেশ জারি করায় নতুন করে বিপাকে পড়েছে পিপিপি সরকার। এর উপর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদি কার্যক্রম সরকারকে আরও চাপের মধ্যে রেখেছে। অন্যদিকে কাশ্মীর সীমান্ত নিয়ে ভারতের সাথে যুদ্ধ পরিস্থিতি জারদারি সরকারকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে পাকিস্তানে কি ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে একধরনের উচ্ছাস কাজ করছে বিশ্ববাসীর মাঝে।

বেশ কিছুদিন পূর্বে কাশ্মীরে ভারত ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে গোলাগুলির একপর্যায়ে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হলে নতুন করে দু'দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে দেশদুটির মধ্যে যে পারস্পারিক সহযোগিতার সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল সেটা আবার ভেস্তে যেতে বসেছে। ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে সীমান্ত উত্তেজনা এবারই প্রথম না হলেও বর্তমান উত্তেজনাটি এমন একটি পর্যায়ে ঘটেছে যখন দেশ দুটি সহযোগিতামূলক চুক্তি সম্পাদনে একমত হচ্ছিল। তাই নতুন এই উত্তেজনা উপমহাদেশে পারস্পারিক সহযোগীতার পথে আর একটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।

ভারতের সাথে এ বিবাদের মধ্যেই গত ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানে আবার ঘটে এক নারকীয় সিরিজ বোমা হামলা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তান প্রদেশের প্রধান শহর কোয়েটা ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের মিঙ্গোরা শহরে এ বোমা হামলায় প্রায় ১২৫ জন নিহত হয়। মারা যাওয়া অধিকাংশ জনগনই শিয়া গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। এ হামলার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সুন্নী জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-জাংভি। লস্কর-ই-জাংভির মত আরও বিভিন্ন শিয়া জনগোষ্ঠী বিরোধী জঙ্গি সংগঠনের ক্ষমতা পাকিস্তানে দিনদিন বেড়েই চলেছে। এ বিষয়টি দেশটির জন্য ভীতিকর হয়ে উঠেছে। জঙ্গিদের মোকাবিলা করার বিষয়টিই এখন পাকিস্তানে শান্তি এবং অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ের অন্যতম 'ভাগ্যনিয়ন্তা' হয়ে দেখা দিয়েছে। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানে ২০০৪-০৫ সাল থেকে শিয়াবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে থাকে। বেলুচিস্তানে শিয়াদের 'হাজারা' সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। বেলুচিস্তানের স্থানীয় সরকারের তথ্যমতে, ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বেলুচিস্তানে শিয়াদের উপর হামলায় ৭৫৮ জন নিহত হয়েছে। তবে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলে ধারনা করা হচ্ছে। মূলত সত্তরের দশকে ইরানে শিয়া বিপ্লবের পরই পাকিস্তানে শিয়াবিরোধী মনোভাব তীব্র হয়।

তাই পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এসব জঙ্গি সংগঠনকে নির্মূল করাই সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, পাকিস্তান সরকার ইচ্ছা করলেই এসব জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু কোন সরকারই সেই ইচ্ছা ব্যক্ত করেনা। এর পেছনে অনেক কারণ জড়িত রয়েছে। তবে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে স্থানীয়-জাতীয় নির্বাচনে ভোটের হিসাব-নিকাশ। সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফের আমলে তারই পৃষ্ঠপোষকতায় পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান প্রদেশে লস্কর-ই-জাংভি ফুলেফেঁপে উঠেছিল। শুধুমাত্র ভোট এবং সমর্থন পাওয়ার স্বার্থে মোশাররফ এমনটি করেছিলেন। মূলত সব রাজনৈতিক দলগুলোই ভোটের জন্যই লস্কর-ই-জাংভি বা এমন জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর উপর নীরব সমর্থন পোষণ করে। আবার আন্তর্জাতিকভাবে চাপের সময় বেলুচিস্তানে এই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর পশ্চিমাবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ কাজে লাগায় পাকিস্তান সরকার। অন্যদিকে অস্থিতিশীল আফগানিস্তান হতে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পাকিস্তান এদের বেশি ব্যবহার করছে। আর এসব কারণেই সরকারের নীরব সমর্থনের জন্য এই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো আজ প্রকাশ্যে বোমাবাজি করতে এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাতেও ভয় পাচ্ছেনা। তবে জঙ্গিগোষ্ঠীদের এসব অনৈতিক কার্যক্রম পাকিস্তান সরকারের ঘুম ভাঙ্গাতে না পারলেও আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েই চলেছে পাকিস্তানের ওপর। এতে জারদারি সরকারের নিষ্ক্রিয়তার চিত্রই ফুটে উঠছে।

পাকিস্তানের এ নাজুক পরিস্থিতিতে বেশ কিছুদিন পূর্বে 'মিনহাজ-উল-কোরআন' নামের একটি সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান তাহির-উল-কাদির দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। গত ছয় বছর তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে কানাডায় ছিলেন। দেশে ফিরে এসেই তিনি বিভিন্ন স্থানে সরকারবিরোধী সমাবেশ শুরু করেন। এরপর তিনি এক বিশাল লংমার্চেরও নেতৃত্ব দেন। কাদরির মূল দাবি পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে সামরিক বাহিনী এবং বিচার বিভাগের পরামর্শে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনের আগে 'সৎ মানুষ' জয়ী হওয়ার মত পরিবেশ সৃষ্টি করতে বেশ কিছু বিষয়ে সংস্কার আনা। দীর্ঘদিন পরে দেশে ফিরেই কাদরির এ ভূমিকায় নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষত, কাদরির লংমার্চ যেদিন ইসলামাবাদে পৌছায় সেদিনই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কাদরির সাথে সামরিক বাহিনী এবং বিচার বিভাগের আঁতাতের বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলেছে। ধারনা করা হচ্ছে কাদরিকে দিয়ে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করে আর বিচার বিভাগকে দিয়ে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রিকে আইনি মারপ্যাঁচে ফেলে আবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে সেদেশের সেনাবাহিনী।

২০১৩ সালটি পাকিস্তানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেশকে অস্থিতিশীলতার হাত থেকে বাঁচাতে না পারলে সামনে অনেক বড় দুর্যোগ ঘনীভূত হতে পারে পাকিস্তানে। এ বছরে কয়েকটি বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে পাকিস্তানে। প্রথমত, আগামি ১৬ মার্চ বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। সংবিধান অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। অবশ্য এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম কোন নির্বাচিত বেসামরিক সরকার তার মেয়াদকাল পূর্ণ করতে চলেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে আরেকটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা গেলে তা হবে পাকিস্তানে প্রথম নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের পর নতুন পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা নির্বাচন করবেন দেশের প্রেসিডেন্টকে এ বছরের সেপ্টেম্বরে। আসিফ আলী জারদারিই এ পদে থাকবেন, না অন্য কেউ তার স্থলাভিষিক্ত হবেন সেটা নির্ভর করছে পার্লামেন্ট নির্বাচনের ওপর। তৃতীয়ত, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানির তিন বছরের বর্ধিত মেয়াদ শেষ হবে এ বছরের নভেম্বরে। তাই কায়ানির স্থলাভিষিক্ত কে হবেন এবং তার ভূমিকা কি হবে নতুন সরকারের প্রতি সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চতুর্থত, দেশের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী অবসরে যাবেন এ বছরের ডিসেম্বরে। বর্তমান বিচারপতি জনগনের কাছে অত্যন্ত পরিচিত এবং জনপ্রিয়। তার নেতৃত্বের গুণাবলীতে বিচার বিভাগ বেশ স্বাধীনতা ভোগ করেছে। নতুন বিচারপতি এসে সে ধারা কতটুকু অব্যাহত রাখতে পারবেন তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।

পাকিস্তানের এ পরিবর্তনগুলোর সাথে একটা বড় ধরনের যোগসূত্র আছে। আর সেটা হল আসন্ন নির্বাচন। নির্বাচন অনুষ্ঠান যদি কোনভাবে বাধাগ্রস্ত হয় তবে এসব পরিবর্তন প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই ভবিষ্যতের পাকিস্তান কোন পথে হাটবে তা কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। সেখানে নতুন করে বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় আসীন হবে নাকি কলকাঠি নেড়ে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা হস্তগত করবে সেটা অবলোকন করার জন্য আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।