ইরানের নতুন মিত্র হতে যাচ্ছে মিশর

মেফতাউল ইসলাম
Published : 20 Feb 2013, 09:07 AM
Updated : 20 Feb 2013, 09:07 AM

ইরান এবং মিসর মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দুই প্রভাবশালী রাষ্ট্র। বিভিন্ন কারণে মুসলিম বিশ্বের এই রাষ্ট্রদ্বয় এখন বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ইরানের পারমানবিকিকরণ নিয়ে বিশ্বে আলোচনা সমালোচনার অন্ত নেই। আবার পশ্চিমা বিশ্বের কঠোর সমালোচনাকারী হিসেবেও দেশটি বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বিশেষত, মাহমুদ আহমেদিনেজাদের বিভিন্ন বলিষ্ঠ পদক্ষেপের জন্য পশ্চিমাবিশ্ব ইরানকে তাদের হুমকি হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে আরব গণজাগরণ শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের মত মিসরেও বিপ্লবের হাওয়া বইতে শুরু করে। সেই হাওয়ায় মাত্র ১৮ দিনের ব্যবধানে পতন ঘটে মিসরের লৌহ মানব খ্যাত হোসনি মোবারকের। তারপর বিভিন্ন অস্থিতিশীলতার মাঝে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ইসলামপন্থিদের জয় হয়। ড.মোহাম্মদ মুরসির নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন গণতান্ত্রিক সরকার। সরকারের সথে সামরিক পরিষদের দ্বন্দ্বে আবার সেখানে কিছুদিন নাটক চলে। সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত মিসর মাঝে মাঝেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। অবশ্য মুরসি সেগুলো কাটিয়ে দেশ শাসনে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন বটে। কিন্তু মাঝে মাঝে এই অস্থিতিশীলতার কারণে বিশ্ব মিডিয়ার খোরাকে পরিণত হয়েছে আজকের মিসর।
ইরান ও মিসর দুটি মুসলিম রাষ্ট্র হলেও তাদের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের ইতিহাস বেশ লম্বা। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর দুদেশের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। ১৯৭৮ সালে ইসরাইলের সাথে মিসরের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এবং ইরানে ইসলামি বিজয়ের পর ইরানের পলাতক স্বৈরশাসক রেজা শাহ পাহলভীকে মিসর রাজনৈতিক আশ্রয় দিলে তেহরান কায়রোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তারপর দীর্ঘ ৩০ বছর এ দু'দেশের মাঝে সম্পর্কে ভাটা পড়েছিল। এই দীর্ঘ সময়ে কোন দেশই সম্পর্ক উন্নয়নে কোন জোড়ালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কিন্তু মিসরের স্বৈরাচারী শাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর সেখানে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন হবে বলে অনেকেই ধারনা করেছিলেন। সেই ধারনা মিথ্যা নয় বরং সত্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা বর্তমানে দু'দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যথেষ্ঠ উপাদান রয়েছে।
গত বছরের আগষ্টে ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে মোহাম্মদ মুরসি ইরানে গিয়েছিলেন। এটা ছিল প্রায় তিন দশক পর কোনো মিসরীয় প্রেসিডেন্টের প্রথম ইরান সফর। এই সম্মেলনে যোগ না দিতে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলের পক্ষ থেকে মুরসিকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুরোধ ধোপে টেকেনি। তখন থেকেই বিশ্বের পরাশক্তি আমেরিকা বুঝে নিয়েছে এবারের ডানপিটে মিসরের কথা তাকে নতুন করে ভাবতে হবে। ইসরাইলও নিয়মিত দুস্বপ্ন দেখেছিল এই জন্য যে, মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র মিত্র মুসলিম রাষ্ট্রটিকে তারা কখন হারিয়ে ফেলে। যাহোক, এই সম্মেলনে যোগ দিয়ে ইরান মিসরের মাঝে সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা দেখা গিয়েছিল সিরিয়া ইস্যু নিয়ে। ইরান চায় সিরিয়ায় বর্তমান আসাদ সরকার ক্ষমতায় আসীন থাকুক। কারণ ইরান সিরিয়াকে তার পরীক্ষিত বন্ধু বলে মনে করে। বিশেষত, ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় যখন প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো ইরাককে সমর্থন দিয়েছিল তখন ইরানের পেছনে একমাত্র সিরিয়াই সমর্থন অব্যাহত রেখেছিল। তাই ইরান মনে করে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হচ্ছে তা পশ্চিমাদের একধরনের ষড়যন্ত্রের ফল। কিন্তু ইরানের ধারনার সাথে মিসরের ধারনার কোন মিলই নেই। মিসর বরাবরই আসাদ সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সেখানে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন সরকার গঠনের আহবান করে যাচ্ছে। এমনকি মিসর আসাদকে স্বৈরাচারী শাসকের দোষর বলে মনে করে। সুতরাং সিরিয়া ইস্যু নিয়ে দু'দেশের মাঝে বিভেদ অত্যন্ত প্রকট।
গত বছরের আগষ্টে মুরসির তেহরান সফরের পর ওআইসি'র ১২তম শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ কিছুদন পূর্বে কায়রো সফরে করেছেন। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর এই প্রথম কোনো ইরানি প্রেসিডেন্ট মিসর সফর করলেন। এ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু'দেশের জন্যই। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক সংহতি তৈরি করতে হলে দু'দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ মধ্যপ্রাচ্যে শত্রুর মোকাবেলায় ইরান মিসরের মধ্যে শক্তিশালী জোট গঠনের আহবান জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, কোন সীমাবদ্ধতা ছাড়াই মিসরের সঙ্গে সবক্ষেত্রে সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য ইরান প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া তিনি ইরান ও মিসরকে 'কৌশলগত মিত্র' বলে উল্লেখ করেন। অপরদিকে মিসরের প্রেসিডেন্ট বলেন, ইরানকে বাদ সিরিয়া সঙ্কটের সমাধান হতে পারেনা এবং ইরানের ভূমিকাকে এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাছাড়া মুরসি দু'দেশের মধ্যে নতুন ধরনের সহযোগীতার সম্পর্ক গড়ে তোলার আভাষ দেন। এবং উভয় নেতাই স্বীকার করেন, ইরান ও মিসর যদি জোট গঠন করে তবে শত্রুরা এই দেশ দুটির কোন ক্ষতিই করতে পারবেনা। আবার এ অঞ্চলের ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের পথ খুঁজে বের করতেও দুই দেশের মাঝে সমন্বয়ের বিকল্প নেই। মোটকথা, পারস্পরিক আঞ্চলিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই তাদের এই মুহুর্তে একই প্লাটফর্মে আসা উচিৎ।
মিসরে বর্তমানে রাজনৈতিক সংকট লেগেই আছে। হোসনি মোবারকের পতনের পর হতেই সংকট যেন মিসরের পিছু ছাড়ছেনা। বিরোধী দলগুলো প্রেসিডেন্ট মুরসিকেও হোসনি মোবারকের মত স্বৈরাচারী ভাবতে শুরু করেছেন। তাদের ধারনা মুরসিও মোবারকের মত ক্ষমতা পাকাপাকি করতে বিভিন্ন সংস্কার চালাচ্ছেন। এসব কারণে আজও আমরা মিসরে ঐক্যের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিনা। বর্তমানে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে মিসরে সব ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে আছে। অর্থনীতিও প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় ইরান মিসরকে ঋণ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তাছাড়া ইরান মিসরের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রকল্পে ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।
আবার এই মুহুর্তে ইরানও রয়েছে কঠিন সংকটে। বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করে যাচ্ছে। ইরানের কথিত পরমাণু অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা নিঃশ্বেষ করতে যুক্তরাষ্ট্র আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটির উপর। বর্তমান নিষেধাজ্ঞার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ছাড় গ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ইরান যে ৯টি দেশে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রি করছে, সেসব দেশ থেকে বিক্রিলব্ধ অর্থ ইরানের কাছে সরাসরি যেতে পারবেনা। ওইসব দেশেই তা জমা রাখতে হবে। বিক্রিলব্ধ অর্থ শুধু ওইসব দেশ থেকে পণ্য কেনার ক্ষেত্রেই ইরান ব্যবহার করতে পারবে। এমনিতেই পূর্বের নিষেধাজ্ঞাগুলোর কারণে গত ৯ মাসে দেশটির তেল বিক্রি থেকে আয় ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরান আরও সংকটে পড়বে বলে ধারনা করা হচ্ছে। কিন্তু এসব নিষেধাজ্ঞা শর্তেও ইরান তার পরমাণু কর্মসূচী চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। কেননা ইরান বলছে এনপিটি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশই শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরমাণু কর্মসূচী চালিয়ে যেতে পারবে। আর ইরানের পরমাণু কর্মসূচী শুধুমাত্র বিদ্যুৎ এবং চিকিৎসা খাতের উন্নয়নে অর্থাৎ সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে। সুতরাং ইরান মনে করে তার পরমাণু কর্মসূচী পরিচালনার যথেষ্ঠ যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইরান-মিসর দু'দেশের শাসকগোষ্ঠীই এখন অনেকটা আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীন চাপের মধ্যে রয়েছেন। তাই কৌশলগত স্বার্থেই কায়রো-তেহরান কূটনৈতিক সম্পর্ক জোড়দারে আগ্রহী দু'দেশ। কিন্তু তাদের এ মেশামেশি খুব ভালোভাবে দেখছেনা পশ্চিমাবিশ্ব। মধ্যপ্রাচ্যের এ দুটি রাষ্ট্র যাতে কোনভাবেই সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারে সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন-ইসরাইল পশ্চিমাগোষ্ঠী। আবার মিসরের কিছু সুন্নী জনগোষ্ঠী শিয়া ধর্মাবলম্বী ইরানকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকে। আহমেদিনেজাদের সফর সম্পর্কে সুন্নী নেতা এবং আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যান্ড মুফতি আহমেদ আল তায়িব বলেছেন, বাহরাইন তথা উপসাগরীয় দেশগুলোর অভ্যন্তরীন বিষয়ে ইরান যেন নাক না গলায়। তিনি বরং ইরানের সংখ্যালঘু সুন্নীদের অধিকারের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়ার জন্য ইরানকে আহবান জানান। উল্লেখ্য যে, ইরান অভিযোগ করে আসছে, বাহরাইনের রাজপরিবার সুন্নী ও শিয়াদের মধ্যে দ্বন্দ্ব উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
সুতরাং শিয়া ও সুন্নী বিভেদ নিয়ে দেশদুটির মাঝে সামান্য বিতর্ক থাকলেও তা সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে প্রতিপন্ন হয়না। বরং বলা যায় সিরিয়া ইস্যু ব্যতীত এই মুহুর্তে তাদের মধ্যে কোন সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা নেই। মিসরে বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইরান এখন কায়রোর সঙ্গে তার নানা অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে প্রস্তুত রয়েছে। আবার মুরসিও শাসনক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে ইরানের গৃহীত পদক্ষেপে সাড়া দিয়ে আসছে। সুতরাং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আঞ্চলিক সংহতি বৃদ্ধি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।