’bKash’ ও মোবাইল ব্যাংকিং এর ভবিষ্যৎ

মেঘ
Published : 15 Nov 2014, 05:38 PM
Updated : 15 Nov 2014, 05:38 PM

প্রাচীনকাল থেকে পণ্য বিনিময় বা মুদ্রার মাধ্যমে মানুষের জীবন যাপন চলে আসছে। মুদ্রা বা টাকা একস্থান হতে অন্য স্থানে নেয়ার জন্যে মানুষ যুগে যুগে অনেক পদ্ধতির দ্বারস্থ হয়েছে।আঠারোশো থেকে শুরু হয় মুদ্রা ব্যববস্থাপনার জন্যে ব্যাংক স্থাপন। এখানে মানুষ নিজের অর্থ গচ্ছিত রাখা থেকে শুরু করে, গচ্ছিত অর্থের বিপরীতে পেতে থাকে মুনাফা এবং এরপর মানুষ মহাজন বা কাবুলীওয়ালার কবল থেকে নিজের অর্থের প্রয়োজনে হাত পাততে থাকে ব্যাংকের কাছে যার নাম হয় ঋণ বা লোন।

বতর্মানে মানুষ কর্ম উপলক্ষে এক স্খান হতে অন্যস্থানে যাচ্ছে, নিজে শহরে থাকছে, পরিবারের অন্য সদস্যরা অন্য শহরে বা গ্রামে থাকছে। পরিবারের হাতে প্রয়োজনীয় অর্থ পৌঁছানো একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় অনেকের কাছেই।

এ সমস্যার সমাধানে প্রথম ধাপে আমরা দেখি মানুষ মানি অর্ডার করছে। যে ডাক পিয়ন মানি অর্ডার আনে তার কদর অনেক, তাকে আমরা যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী আপ্যায়নও করি, সাথে যথাসাধ্য উৎকোচ তো আছেই। এ মানি অর্ডার ও প্রাপকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পোস্টঅফিস থেকে অন্য কেউ তুলে নেবার ঘটনা এই সেদিনও আমরা শুনেছি, পড়েছি।

যারা ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় তারা ল্যান্ডফোনের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে টিটি বা টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফারের সেবা গ্রহণ করেছে, ৫ থেকে ৭ বছর আগেও। ব্যাংকগুলো অনলাইন হবার পরে এ টিটির দিন শেষ।

মোবাইল ফোনের আগমন এবং এর ভূমিধ্বস ব্যবহার অর্থ আদানপ্রদানের চেহারা পাল্টে দিয়েছে আমূল। দেশে একধরনের নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে মোবাইল সহজলভ্য ব্যবহারের সুযোগে।

মোবাইল ফোন ব্যবহার করে প্রথম অর্থ আদান প্রদানের সেবা নিয়ে আসে ব্র্যাক ব্যাংক তাদের "bKash" নামক ইনস্ট্রুমেন্টটি দিয়ে। এখানে আপনার একটি মোবাইল ফোন থাকাই যথেষ্ট। আপনার নিজের না থাকলেও চলবে। মনে করুন জরিনার নিজের "bKash" একাউন্ট বা মোবাইল কোনটাই নেই। জরিনাকে রহিম সন্দ্বীপে টাকা পাঠাতে চায়, রহিম এখানে কি করবে? সন্দ্বীপে জরিনাদের এলাকায় সুমন হলো বিকাশের এজেন্ট. রহিম জরিনাকে ঢাকার আরেক এজেন্ট রাসেলের মাধ্যমে সুমেনর বিকাশ একাউন্টে টাকা পাঠালো, রহিমাকে বলে দিলো সুমনের কাছে যেতে, জরিনাকে রহিম তার বাবার ফোনে ফোন করে এ সংবাদটি দিলো, জরিনা সুমনের কাছে গিয়ে রাসেলের ফোন নাম্বার এবং তার শ্বশুরের মোবাইল নাম্বার বললো, সুমন জরিনাকে টাকা দিয়ে দিলো। এভাবে চলছে "bKash" এর অর্থ আদান প্রদান।সহজ, সময় সাশ্রয়ী এবং দ্রুত গতির টাকা স্থানান্তর।

ব্যাংকগুলোর ও রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং-আপনার মোবাইল আছে, আছে জাতীয় পরিচয়পত্র বা সনাক্তকারী অন্য কোন কাগজ ও ছবি, আপনি ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং এর আওতায় একাউন্ট খুললেন, এটি ব্যাংক একাউন্টের মতোই কাজ করবে। আপনি এখানে জমা উত্তোলন অন্যের একাউন্টে টাকা স্থানান্তর সবই করতে পারবেন।

ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং এর সাথে "bKash" এর মৌলিক পার্থক্য কি?

ব্যাংক যেমন ভা্বেই হোক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ মোতাবেক গ্রাহকের ঠিকানা যাচাই করছে, অভ্যর্থনা বা অয়েলকাম লেটার পাঠিয়ে। আপনার লেনদেনের হিসাব অতিরিক্ত হলে বা সন্দেহজনক হলে ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সন্দেহজনক লেনদেনের তালিকা বা এসটিআর রিপোর্ট পাঠাতে পারছে।

"bKash" এ এধরনের কোন সুযোগ নেই। এজেন্টের ঠিকানা যাচাই এর সুযোগ খাকলেও এজেন্টের কাছ হতে যিনি টাকা নিচ্ছেন তার পরিচয় যাচাই বা রেকর্ড রাখার কোন নিয়ম নেই। এ যেন টাকার সেই চিরাচরিত স্লোগান "চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে" এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা।

সম্প্রতি সংঘটিত দু'একটি ঘটনা পড়লে আমরা বিস্মিত হবো যে "bKash" মানুষের পকেটস্থ টাকা কিভাবে "নিকাশ' করছে-

ঘটনা-১

জলিল সাহেব নিতান্ত বয়স্ক একজন মানুষ, প্রতি সন্ধ্যায় একি স্থান হতে পাবলিক বাসে চড়ে বাসায় আসেন এই ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ। তাকে সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় কাকলী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসের জন্য অপেক্ষারত অবস্থা থেকে মাইক্রো থেকে দুজন নেমে ছুরি ধরে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চড় থাপ্পড়ের পর জলিল সাহেবের কাছে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড দামী মোবাইল না থাকায় যতেষ্ট ভর্ৎসনাও করা হয় । এরপর চলে টাকা দেবার জন্যে নেগোসিয়েশন, এক লাখে রফা হয়। জলিল সাহেবের বাসা থেকে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সবোর্চ্চ পর্যায়ের সাথে যোগাযোগ করা হয়। জলিল সাহেবের ফোন দিয়ে কিডন্যাপাররা টানা চার ঘণ্টা জলিল সাহেবের পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখে। একলাখ টাকা বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে "bKash" করার পর জলিল সাহেবকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় রাস্তায় ফেলে যাওয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রতিটি "bKash" নম্বর সাথে সাথে দেয়া হয়।

একই ঘটনা তৌফিক সাহেবের বোনের বরের সাথেও ঘটে। তাকে প্রচন্ড মারধোরও করা হয়। এখানেও একই পদ্ধতিতে টাকা নেয়া হয় "bKash" এর মাধ্যমে।

ঘটনা-২

আরেফীন সাহেব বাজার করতে গিয়ে গাড়ী চুরির শিকার হন। ১৫ মিনিটের মধ্যে নিকটস্থ থানায় কেইস করেন। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সবোর্চ্চ পর্যায় থেকে তিনি সব চেষ্টা চালান তার গাড়িটি ফেরত পাবার জন্যে। গাড়ি চুরির পরের দিন থেকে শুরু হয় চোরদের তার মোবাইলে ফোন করা, তিনি সে নাম্বার RAB,ডিবি,পুলিশ সবাইকে দেন। চোরেরা আরেফীন সাহেবের দেয়া ইমেইল অ্যাড্রেস যা আদাতে একজন RAB অফিসারের সেখানে গাড়ীর ছবি পর্যন্ত ইমেইল করে। চোরেরা একটি মোবাইল নাম্বার দিয়ে একটানা ৬দিন আরেফীন সাহেবের সাথে কথা বলে, সর্বশেষ তারা পঞ্চাশ হাজার টাকা "bKash" এর মাধ্যমে নিয়ে সেই ফোন বন্ধ করে দেয়।

আরেফীন সাহেব গাড়ী পাননি, সংশ্লিষ্ট থানাকে দেয়া স্পীড মানি ফেরত পাননি, 'bKash' করা টাকা তো ফেরত পাবার প্রশ্নই উঠে না।

কয়েকটি সূত্রে কথা বলে জানা যায় এরকম ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। এর কোন প্রতিকার নেই। যারা পারবে নতুন গাড়ী কিনবে, যারা পারবে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে খুব বেশি বলার বা কাউকে অভিযুক্ত করার সুযোগও নেই।

আমরা সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি 'bKash' বাংলাদেশ ব্যাংক এর অনুমোদন ছাড়াই যাত্রা শুরু হয়, পরে বাংলাদেশ ব্যাংক "bKash" কে নিরাপদ রাখতে মোবাইল ব্যাংকিং নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন এনে একে জীবিত রাখে।

আগে কিডন্যাপাররা সরাসরি টাকা চাইতো। গাড়ি চোরেরা টাকা চাইতো না ধোলাইখালে গিয়ে সব বিক্রি করে দিতো বা চোররাই গাড়ীর সব পরিবর্তন করে জেলা শহর বা মফস্বলে বিক্রি করতো। এখন এত কষ্টের প্রয়োজন পড়ে না। কিডন্যাপাররা যদি দেখে অধিক ক্ষমতাশালী কাউকে তারা তুলেছে তাহলে "bKash" এ আর টাকা চাইবার ঝামেলায় যায় না, একবারে মেরে ফেলে দেয়।

সময় বদলেছে মানুষ অনলাইন ব্যাংকিং এর জায়গায় রিয়েল টাইম অনলাইন অর্থাৎ রূপালী ব্যাংকের চেক দিয়ে ঢাকা ব্যাংকের কাউন্টার থেকে টাকা তুলবার সুযোগ চাইছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ অর্থ লেনদেনের বৈধ আওতায় আসুক, প্রান্তিক মানুষ সুবিধা ভোগ করুক, পঞ্চগড়ে থাকা বাবা-মা ঢাকায় গার্মেন্টস এ চাকুরী করা মেয়েটির টাকা দ্রুত পাক সেটা আমরাও চাই। কিন্তু তাই বলে এভাবে অর্থের লেনদেন? এ কি প্রাচীন মরুর যুগ, যার যেভাবে খুশি অর্থের আদান প্রদান হবে? কোথাও কোন ভেরিফিকেশন রেকর্ড থাকবে না?

এক ব্র্যাক ব্যাংক নির্বিচারে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে শত শত ক্রেডিট কার্ড ডিফল্টার তৈরী করেছে, প্রতিযোগীতায় টিকতে গিয়ে অন্য ব্যাংকগুলোও এই অসুস্থ প্রতিযোগীতায় তাল মিলিয়ে ক্রেডিট কার্ডের ডিফল্ট কালচারকে স্ট্যাবলিশ করেছে। একই অবস্থা করেছে ব্র্যাক ব্যাংক এসএমই ঋণ বা ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রেও। ব্যাংকিং এবং এনজিও এক নয়। জনগণের অর্থ নিয়ে এমন ছিনিমনি খেলার অধিকার কারো নেই। সে ব্যক্তি যদি "স্যার" উপাধিতে ভূষিত হয় তবুও নয়।

এখনই রাশ টেনে ধরতে না পারলে আমাদের মোবাইল ব্যাংকিং এর মতো একটি প্রতিশ্রুতিশীল খাতও নষ্ট হয়ে যাবে, "bKash" বলতে সবাই ছিনতাই কিডন্যাপিং চুরি জঙ্গীবাদের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমকেই বুঝবে।

আমাদের প্রস্তাবনা-

.           জাতীয় পরিচয় পত্র ইলেকট্রনিক চিপ সম্বলিত হোক

.           ব্যাংক, বীমা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পরিচয় পত্র, বা অন্যান্য সনাক্তকরণ কাগজের, মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের ডাটাবেজে নিয়ম মেনে ঢুকবার অনুমতি দেয়া হোক

.           "bKash" হতে টাকা উত্তোলনের সময় কে টাকা নিচ্ছে তার প্রকৃত তথ্য রাখা হোক, যেমন রাখা হয় ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রাম, সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে

.           আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো মাত্র সংঘটিত অপরাধের বিপরীতে প্রকৃত ব্যবস্থা নিক

.           বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং এর জন্য সুনির্দিষ্ট ও দেশোপযোগী নীতিমালা তৈরী করুক, সবোর্পরী মোবাইল ব্যাংকিং কাযার্বলী মনিটরিং এর সেল হোক।

অর্থ যতদিন থাকবে তা নিয়ে অনর্থ ও থাকবে, আমরা কি একককেন্দ্রিক ব্যক্তির হাতে বন্দী থেকে দেশের সাধারণ মানুষের জান মাল নিরাপত্তা নিয়ে হাস্যরোলে মেতে উঠব, আর বলব যাক্‌ আপনাকে একলাখে ছেড়ে দিয়েছে সেজন্য শোকর গুজার করেন, না কি যারা বিনা পুঁজিতে মাইক্রো ভাড়া করে মানুষ তুলে "bKash" এ টাকা পাবার ব্যবসা করছে তাদের রুখব, তা আমাদের সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করে, সর্বাংশে।