মাতৃত্ব, কর্মজীবি নারী-ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স

মেঘ
Published : 21 Nov 2014, 07:40 PM
Updated : 21 Nov 2014, 07:40 PM

জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সাথে আয় ব্যযের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ব্যয়ের মাত্রা বাড়লেও অনেকেরই রোজগার সেভাবে বাড়ছে না বলে হরহামেশা অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়। বাজার অর্থনীতিতে মালিক পক্ষ চায় সস্তা শ্রম, কর্মীরা চায় শ্রমের মূল্যায়ন-টাকার অংকে। এ দুয়ের সমন্বয় যখন হবে না, তখন মানুষ কি করবে? তার পরিবারে আয়ের উৎস বাড়াতে সচেষ্ট হবে। কিছুদিন আগেও পরিবারগুলো আমাদের মতো দেশে একজনের আয়ে অর্থাৎ পুরুষ সদস্যের আয়ে চলে এসেছে। শহুরে জীবন যাপনে যেমন তেমনি গ্রামের জীবন যাপনেও এখন নারীর ক্ষমতায়নের হাত ধরে এ চালচিত্র অনেকটাই পরিবর্তিত। ধীরে হলেও নারীরা ব্যাপকহারে অর্থকরী বিবিধ কাজে নিজেকে নিযুক্ত করছেন। পরিবারের ব্যয় বহনের জন্যে পুরুষের পাশাপাশি তারাও সমান তালে পা ফেলছেন। কয়েকটি নির্দিষ্ট সেক্টরে নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। কর্মক্ষেত্রে নারীরা অনেক সমস্যারই সম্মুখীন হচ্ছেন। সেগুলোকে যুগোপযোগী দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধানের চেষ্টা না করে যাদের হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তারা হয় সমস্যাকে পাশ কাটিযে যাচ্ছেন কিংবা নারীকে কর্মক্ষেত্রে নেয়ার ব্যাপারে অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিচ্ছেন। কর্মজীবি নারীদের সাথে কথা বললে আমরা অভিযোগের ফিরিস্তিতে এ ব্লগ ভাসিয়ে দিতে পারব, সমাধান? অভিযোগের ধরণ থেকেই সমাধানটি বেরিয়ে আসবে না কে বলতে পারে?

পোশাক শ্রমিকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ নারী, এ নিয়ে আমাদের ইউটোপিয়ারও শেষ নেই। সেমিনার, টক শো ইত্যাদিতে আমরা তাদের অবদানের কথা দেশের অর্থনীতিতে অহরহ স্বীকার করে থাকি। একটি ১৫ বা ১৬ বছরের মেয়ে গার্মেন্টস এ যোগ দেয়, তারপর প্রাকৃতিক নিয়মে সে বিবাহিত হয়, এ পর্যন্ত স্বপ্ন সুন্দর। সে যখন সন্তানসম্ভবা হয় সেদিন গুলোও মোটামুটি কেটে যায়। সন্তান জন্মের পর শুরু হয় আসল লড়াই। নাম না বলেই বলি অনেক কারখানাই সন্তান সম্ভবা শ্রমিককে স্ববেতন রাখতে ইচ্ছুক নয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে আছে টানা হ্যাঁচড়া, শ্রম আইন অনুযায়ী ছুটি দিলেও, ৪মাসের বাচ্চা রেখে কাজে যোগদান অনেকেরই হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এত ছোট বাচ্চাকে কোথায় কার কাছে রাখা হবে এ বিষয়টি।

এ তো গেল শ্রমিকের বয়ান, প্রশাসনের মানুষের ও একটি ভার্সন আছে-তাদের অভিজ্ঞতায় তারা বলছেন অনেকেই প্ল্যান করে চাকুরীতে যোগদান করে হয়তো একবছর বা নয়মাস পরে বাচ্চা নেবে, চাকুরী করে ঐ সময়টুকু বেনিফিট নেবার জন্যে। কারখানা এমন একটি জায়গা যেখানে কোন মেশিন কর্মীবিহীন বা কাজ পেন্ডিং রাখার কোন উপায় নেই, যে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে গেল তাকে যেমন বেতন দিতে হচ্ছে তেমনি তার বিপরীতে যাকে কাজে নেয়া হয়েছে তাকেও তাদের বেতন দিতে হচ্ছে। এতে করে পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যায়। অনেকেই মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে আর কাজে যোগ দেয় না।


পোশাক খাতের মতো আরেকটি উল্লেখযোগ্য বেসরকারী খাত হচ্ছে ব্যাংকিং।
একাত্তর পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে নারীরা সরকারী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকেই যোগদান করে বেশী। বেসরকারী ব্যাংক আসে একাশি বিরাশি সালের দিকে। নারীদের ব্যাংকিং সেক্টরে যতটুকু সুযোগসুবিধা প্রাপ্তি তা বাংলাদেশ ব্যাংকের হাত ধরেই। বাংলাদেশ ব্যাংকে ত্রিশ দিন, পঁয়তাল্লিশদিন, তিনমাস, চারমাস, ছমাস এভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটি সময়ের সাথে সাথে এমেন্ডেড হয়, এক দশকের সাথে আরেক দশকের তুলনায়। বাংলাদেশ ব্যাংকেই ডে কেয়ার সেন্টার হয় সর্বপ্রথম, এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণরও আছেন একজন নারী।

তিনবছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকগুলোকে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাতুত্বকালীন ছুটি ছয়মাস করার জন্যে চিঠি দেয়, চার মাসের স্থলে। অনেক ব্যাংক তা বিষমুখে মেনে নেয়, অনেকেই চার মাস ই রেখে দেয়। এখনো চাপ আছে-এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো নীরবে যে নীতি অলিখিতভাবে নিচ্ছে সেটা হলো নারী কর্মীকে চাকুরীতে নেয়া বন্ধ করে দেয়া। অনেকেই মনে করে থাকেন নারীর আসলে চাকুরীর প্রয়োজন নেই, তারা তাদের পার্লারের খরচ, ড্রেস কেনা, বিদেশ ঘুরতে যাওয়া, সাজগোজ করা এসবের জন্যে চাকুরী করে থাকে। নারীরা কর্ম ঘণ্টা শেষ হবার পরেই বাসায় চলে যেতে চায়, কর্মক্ষেত্রে তাদের প্রোডাক্টিভিটি কম, পুরুষের তুলনায়। কাস্টোমার সার্ভিস নামক শোকেস জায়গাতেই সবাই নারীকে ঠেলে দিতে বেশি পছন্দ করেন।অধিকাংশ পুরুষ তো বটেই নারী সহকর্মীরাও ক্ষেত্রবিশেষে মনে করে থাকেন মাতৃত্বকালীন ছুটি একধরনের বিনোদনের মতো ছুটি কাটানো ছাড়া আর কিছুই নয়।

এধরনের মন্তব্য করার আগে অনেকেই ভুলে যান নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিগারেট খাওয়া, চা পান,শেয়ার বাজার পর্যালোচনা,বাজার করা এসব- কাজ করার সময় করেন না। তারা কাজের সময় পত্রিকা পড়েন না, ইন্টারনেট অফিসের প্রয়োজন ছাড়া চালান না। তাই বেলা তিনটায় এসে নারীরা দিনের কাজ করতে বসেন না।

অফিস শেষে নারীর প্রধান আকর্ষণ বাসায় তার অপেক্ষারত সন্তান, পুরুষ বাসায় শুধু অর্থের যোগানদাতা হবার কারণে, বাচ্চা রাখার ক্ষেত্রে অনাগ্রহের কারণে অফিষ আওয়ারের পরেও বাসায় যেতে উচাটন হন না। তাদের বাসায় গিয়ে রান্না করতে হয় না, বাচ্চাকে পড়াতে হয় না। তাই তারা তিনটায় কাজ শুরু করে রাত নটা পর্যন্ত অফিসে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বলে নারীদের মতামত।

সন্তান ধারণের মতো একটি অতি জরূরী কাজ করার কারণে নারীরা যেসব কমন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কর্মক্ষেত্রে তা হলো-

-গর্ভধারণের নয় মাস পূর্বের ন্যায় সমান গতিতে কাজ না করতে পারার জের ধরে মৌখিক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য শুনতে পাওয়া

-গর্ভধারণকালীন সময়ে জটিলতা দেখা দিলে ছুটি প্রাপ্তির ব্যাপারে সহযোগীতা না পাওয়া

-মাতৃত্বকালীন ছুটির শেষে কাজে যোগদানের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের আগের ডেস্কটি আর ফেরত না পাওয়া

-পদোন্নতির মতো অধিকার হতে বঞ্চিত হয়ে জুনিয়রদের সমান হয়ে যাওয়া

-কাজে যোগদানের পর ব্রেস্ট ফিডিং এর মতো আবশ্যক একটি সেবা সন্তানকে দিতে না পারা

-সন্তানকে কোথায় রাখা যাবে এ চিন্তায় চাকুরী ছেড়ে দেয়া

-আয়ত্তের ভেতরে ডে কেয়ার না থাকা
আলোচনা করতে গিয়ে আমরা জেনেছি অনেককে তাদের কর্মস্থলে বলে দেয়া হয় দুবছরের মধ্যে গর্ভধারণ করতে পারবে না এ মর্মে।
সমাধানের পথ কি? আমরা এ বিষয়ে কয়েকজন মানব সম্পদ বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হই, তাদের মতে-

–          যে কোন জায়গায় ব্যাক আপ প্ল্যান থাকতে হবে। প্রয়োজন যদি ১০ জনের হয় সেখানে সাতজন না রেখে অন্তত ৮জন রাখা

–          পরিবারে নারীর প্রতি সহযোগী মনোভাবের সাথে কর্মস্থলেও সহকর্মীরা তেমন মনোভাব পোষণ করা ও সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়া

–          প্রতিষ্ঠানের নিজের একক ক্ষমতা না থাকলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে একযোগে একটি ডে কেয়ার স্থাপন করা

–          কর্মস্থলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার রাখা

–          নারী কর্মীদের সাথে অংশীদারী ভিত্তিতেও প্রতিষ্ঠান ডে কেয়ার স্থাপন করতে পারে

সময় থেমে থাকে না, সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে। নারীর উপার্জনকে উপরি বা ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স না ভেবে ঘরে বাইরে তার ডাবল কাজ করার ধারাকে অব্যাহত রাখা সময়ের দাবী। ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্যেই একজন মা শিশু সন্তানকে বাসায় রেখে কাজে আসেন, বাচ্চার ভালো স্কুল, ভালো খাবার,উন্নত চিকিৎসা, উন্নত জীবন যাপনের কাজেই মা তার আয়টুকু ব্যয় করেন।

এ কাজকে নিরুৎসাহিত না করে সরকারী সিদ্ধান্ত ছয়মাসের ছুটির সাথে আমাদের একাত্মতা প্রকাশ করে নিজেদের মনুষ্যত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া উচিৎ। যে বা যারা নারী কর্মীদের কাজে নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন, অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করছেন, অলিখিত নিয়ম মেনে চলছেন তাদের জন্ম কোথা হতে সে প্রশ্ন করার সময় এসেছে একযোগে।