সুন্দরবন ডায়েরি

মনিরুল আলম
Published : 1 Dec 2017, 08:48 AM
Updated : 1 Dec 2017, 08:48 AM

সুন্দরবনের নানা জীববৈচিত্রের ছবি তুলতে এ বছরের আগষ্ট ২০১৭ মাসে সুন্দরবন গিয়েছিলাম । ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা হলো । আমাদের— দলটি বনের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি—ছবি তোলা হলো, সুন্দরবন সম্পকে আরো জানা হলো দেখা হলো—নানা জীববৈচিত্রের ।


সুন্দরবনের কটকা এলাকায় বন্যপ্রাণীর ছবি তুলতে একটা রেঞ্জে বসে অপেক্ষা করছি । ছবিটি তুলেছেন, আলোকচিত্রী ( ডকুমেন্ট্রি এবং ট্রাভেল ফটোগ্রাফার ) নুর আহমেদ জিলাল ।

সপ্তাহ জুড়ে বেঙ্গল ট্যুরের জাহাজ এমভি ডিঙি'তে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাটা ছিল অসাধারন। আমাদের প্রতিদিন ভোর রাতে অর্থ্যাৎ ৪.৩০ / ৫.০০ মধ্যে ঘুম থেকে উঠতে হতো। জাহাজ থেকে নেমে ছোট বোটে করে সুন্দরবনের ছোট খাল গুলিতে বন্যপ্রাণী দেখতে এবং ছবি তুলতে বের হতাম। জোয়ার-ভাটা বিষয়টি মাথায় রাখতে হতো। বন বিশেষজ্ঞদের মতে—সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী দেখার জন্য উত্তম সময় হচ্ছে বর্ষাকাল।

বর্ষাকালে সুন্দরবনে বন্য প্রাণী দেখার জন্য –আসলেই উত্তম সময়। আমি এই বর্ষায় সুন্দরবনে না গেলে, তার সেই সব সৌন্দর্য্যগুলো উপভোগ করতে পারতাম না! আমাদের জাহাজ তখন সুন্দরী খালে নোঙ্গর করা ছিল। দুপুরের খাবার শেষ করে; আমরা জাহাজের ডেকে বসে ছিলাম, অসল ভঙ্গীতে । তখন দেখলাম–আকাশ কালো করে বনের উপর দিয়ে মেঘের দল ছুটে যাচ্ছে– কোন এক দুরের দেশে! অসাধারন সেই ল্যান্ডস্কেপ! যদিও মাত্র কয়েক সেকেন্ড ছিল–সেই দৃশ্যকাব্য! তারপর শুরু হলো–ঝুম বৃষ্টি ! আমাদের কেউ কেউ সেই দৃশ্য-কাব্যের ছবি তোলার জন্য দৌড়ে ক্যামেরা আনতে গেলে; ততোক্ষণে তা মিলিয়ে গেছে–কোথায় ! আমি তখন অসাধারন সেই দৃশ্য কাব্যের মুহূর্তটি ধরে রাখতে চাইলাম– প্যানারোমিক ভিউতে!


বর্ষাকালে সুন্দরবনের রুপ প্যানারোমিক ভিউতে তোলা । ছবি: মনিরুল আলম

যদিও টুরিস্টদের জন্য বর্ষাকাল–সুন্দরবনে বেড়ানো জন্য উপযুক্ত সময় নয় । কারণ–কালবৈশাখী ঝড়, নিম্নচাপ, জলোচ্ছাস সহ নানা কারণে বনের পরিবেশ এবং জীবন হয়ে উঠে অন্যরকম! বনে বেড়ানো তখন ঝুকিপূর্ণ হয়ে যায়! তবে যারা বন'কে ভালোবাসে–প্রকৃতিপ্রেমী; তাদের কথা আলাদা ! কবি গুরু– রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বর্ষার রুপ দেখতে তার ছোট বোটে নিয়ে– উত্তাল পদ্মা ঘুরে বেড়িয়েছেন; দেখেছেন পদ্মা পারের সেই সব জীবন-গাঁথার গল্প।

বিকেলের অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেছে— তখন। আমাদের বহনকারী বোটটি কটকা রেঞ্জের একটি ছোট জেটিতে নোঙ্গর করা হলো। এই জেটিটির অবস্থান কটকা বন কার্যালয়ের বিপরীতে । এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। এই ওয়াচ টাওয়ারে যেতে কিছুটা পথ হাটতে হয়, যা ঝুকিপূর্ণ ! বন্যপ্রাণীর সঙ্গে সংঘাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে!

ছোট এই সরু পথের দুইপাশে ঘন বন— মাঝে মাঝে হেতাল গাছের ঝোপ আর হুদোর বন! বাঘ মামার লুকিয়ে থাকার জন্য এসব আদর্শ স্থান। বিশেষ করে শিকার ধরার জন্য সে এসব জায়গায় ওঁত পেতে থাকে। আমাদের গাইড সিরাজ ভাই, সবাইকে আবারও সর্তক করে দিলেন, এলাকাটি যেন আমরা সাবধানে পার হই। যদিও আমাদের দলের সঙ্গে একজন বনবিভাগের গার্ড অস্ত্র নিয়ে সর্তক রয়েছেন সর্বক্ষণ। তারপরও—বাঘ মামা বলে কথা!

ওয়াচ টাওয়ারটি প্রায় ৪০ ফুট উঁচু হবে। আঁকাবাঁকা হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে,অনেকটা। কাঠের তৈরি এই ওয়াচ টাওয়ারের উপরে উঠলে; বনের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। এই টাওয়ারটিতে উঠে সুন্দরবনের এক অসাধারন অনন্য সৌন্দর্য দেখলাম। প্রকৃতি তার নিজস্ব রুপে ঢেলে সাজিয়েছে যেন এখানে। এখান থেকে বন্য প্রাণী দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে— তা একদম চুপচাপ হয়ে। বিশেষ করে হরিণের পাল এখানে দলে দলে ঘুরে বেড়ায়, ঘাস খায়— মনের আনন্দে। মানুষের আওয়াজ পেলে— তারা গহীণ বনে লুকিয়ে পরে। ভাগ্য ভালো হলে—বাঘ মামার দেখা মিলতে পারে! আমরা এই ওয়াচ টাওয়ারটিতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম । সঙ্গে থাকা আমার ক্যামেরা দিয়ে প্রকৃতির সেই সব সৌন্দর্য ধরে রাখতে চাইলাম । প্রায় ঘন্টা খানিক অপেক্ষার পর হরিণের বেশ কিছু অসাধারন মুডের ছবি পেলাম । ওয়াইল্ড লাইফের ভালো ছবি পেতে হলে অবশ্যই ভালো মানের একটি টেলি লেন্স থাকতে হবে— সঙ্গে ট্রাইপড থাকাটা জরুরি।

কটকা রেঞ্জ এলাকায় ওয়াচ টাওয়ার থেকে তোলা হরিণের ছবি। ছবি: মনিরুল আলম

আমরা এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে হরিণের পাল, গুইসাপ, প্রচুর পাখি আর প্রজাপতি দেখলাম। ছবি তোলা হলো সেগুলোর। আমার কাছে এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে বনের ল্যান্ডস্কেপটি অসাধারন লাগলো—বিশেষ করে হেতাল গাছের ঝোপ, হুদোর বন সহো জানা-অজানা সেই সব গাছগুলো।

ওয়াইল্ড লাইফের ছবি তুলতে এসে একটা বিষয় আমার কাছে মনে হলো—টেলি লেন্স দিয়ে শুধু মাত্র বন্যপ্রাণীর ক্লোজআপ ছবি তোলাই নয়, বনকে বা বনের পরিবেশকে সংযুক্ত করে ছবি তুলতে পারলে, অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি— তা নান্দনিক হয় বটে। এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য—কটকা বন কার্যালয় . . .।

(চলবে)