সেতার হাতে মুক্তিযোদ্ধা পন্ডিত রবি শঙ্কর

মেহেদী হাসান
Published : 5 Jan 2013, 05:10 AM
Updated : 5 Jan 2013, 05:10 AM

যন্ত্র ছেড়ে কথা কেন?- এমনটাই অভিমত ছিল বিশ্বপ্রখ্যাত সেতার বাদক ও সুরস্রষ্টা পন্ডিত রবি শঙ্করের। তাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও মুখ দিয়ে কোন কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেননি। ফিরে গেছেন তার আত্মার প্রনয়ী সেতারের কাছে- তার বক্ষ থেকে ঝরিয়েছেন সুরের লালিত্য। সাথে রেখেছেন সরোদ, সন্তুর, তবলা, বেহালা ও প্রাশ্চাত্য গীটার এবং তাদের প্রেমিকদের। বাংলার মুক্তিকামী মানুষ যেমন হাতে তুলে নিয়েছিলেন গর্জে ওঠা রাইফেল তেমনি মুক্তিযোদ্ধা রবি শঙ্কর সেতারের সুক্ষ তারে "বাংলার ধুন" নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন বিশ্ব-বিবেকের সামনে। তার সেতারের এক ঝঙ্কারেই আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল বিশ্বের তাবৎ মানবতাবাদী-প্রগতিশীল মানুষ। তাদের অন্তরের গহীনে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন- বাংলার মাটিতে পাকিস্থানী হায়েনাদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, মা-বোনের ইজ্জ্বত লুন্ঠন, বাড়ি-ঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া, আরো নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের কথা- ৭১ এর পহেলা আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত "কনসার্ট ফর বাংলাদেশ" এর সুরের তরীকে আশ্রয় করে- যখন খোদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলার সংগ্রামী জনতার মুক্তি আকাঙ্ক্ষার বিরোধীতা করছিল। সাথে ছিল গীটার হাতে লম্বা-লম্বা দাড়ি-চুলের আরেক মুক্তিযোদ্ধা মার্কিন নাগরিক বিখ্যাত সঙ্গীত ব্যান্ড দ্য বিটলস এর ভোকাল জর্জ হ্যারিসন। সেতার ও গীটার হাতে এই দুই মুক্তিযোদ্ধার সুরের উৎক্ষিপ্ত জ্বলন্ত লাভায় বাংলায় বিজয় আসার আগেই বৈশ্বিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেন অনেকটা জিতে গিয়েছিল। আরেকটি কনসার্টের কথা বাংলার মানুষ প্রায় ভুলেই গিয়েছে- "কনসার্ট ফর বেনিফিট"। রবিশঙ্করের আদি পিতৃভূমি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন আগে সত্তর সালের প্রলঙ্করী জ্বলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করার জন্যে সেই গীটার হাতে মানব দরদী জর্জ হ্যারিসনকে সাথে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রেই আয়োজন করেছিলেন এই কনসার্টের।

সঙ্গীতকে আশ্রয় করে সুরের মধ্যে ডুবে থেকে তার জীবনের একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী সেতার হাতে নিয়েই কেটে গেছে তার বৈচিত্রময়-বর্ণিল জীবনের বিরানব্বইটি বছর। সুর-সঙ্গীতকে মানব আত্মার ধর্ম মেনে সেই শিশুকাল থেকেই- যখন অন্যান্য শিশুরা বিভিন্ন ধরনের খেলা-ধূলা, হৈচৈ, কোলাহলে নিজেদের মহা আনন্দে ব্যাস্ত রাখত তখনও ছোট্ট রবি শঙ্কর সারা দিন নির্জনে গান শুনে শুনে কাটিয়ে দিত। মহান সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ অপত্যস্নেহে পিতৃহারা রবি শঙ্করকে সেই ছোটবেলা থেকেই সুরের উত্তাল তরঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন। বাবার মতই তার সেই সঙ্গীত শিক্ষক যিনি বাংলাদেশের মানুষ, এমনকি কলকাতার ভাষাতেও তাকে কখনো কথা বলতে দেখা যায়নি- রবি শঙ্কর দেশীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে ভালোবাসার অফুরন্ত প্রেরণাও সম্ভবত পেয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য থেকেই।

সাধারন মানুষ তার সুর শুনে, তাকে ভালোবেসে দেবতার স্থান দিয়েছে। কিন্তু পন্ডিত রবি শঙ্কর দেবতার ঘেরাটোপ ব্যূহ ভেদ করে রক্ত-মাংশের মানুষের কাতারে নেমে আসতে পারলেই যেন স্বস্তি বোধ করতেন। উঁচু পিড়িতে বসে শ্রদ্ধা পাবার অভিলাষ তাকে ঘায়েল করতে ব্যার্থ হয়েছে বার বার। এজন্যেই বোধ হয় নিজের জীবনের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটির কথা বলতে একটুও কার্পণ্য বোধ করেননি কোথাও।

আট-দশজনের মত একজন সাধারন মানুষ হিসেবে নিজেকে দেখতে চেয়েছেন বলেই, আত্মজীবনী "রাগ-অনুরাগ" বইয়ে তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, বিভিন্ন নারীর সাথে সম্পর্ক, আশা-হতাশা, সুখ-দুঃখ-বেদনার কথা অকপট বলে গেছেন। মানব-মানবীর একান্ত ব্যাক্তিগত সম্পর্ককে সমাজ, রাষ্ট্র, প্রথার নিগড়ে না বেঁধে উন্মুক্ত করার দিকেই তার ঝোঁক ছিল বেশী। প্রণয়-প্রনয়ীর মহৎ কাজে পরস্পরকে উৎসাহ দেয়া, একে অপরের প্রতি টান ও ভালবাসাকেই সবচেয়ে বড় করে দেখেছেন তার জীবনে। পিতৃতুল্য উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মেয়ে অন্নপূর্নার সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলেও যেমন আদালতের দ্বারস্থ হননি, তেমনি প্রিয় বান্ধবী কমলাকেও মন্ত্র পড়ে বিয়ে করতেও তেমন উৎসাহ দেখা যায়নি তার মধ্যে।

পন্ডিত রবি শঙ্কর দেশ-বিদেশকে কখনো মন থেকে আলাদা করতে পারেননি। মানুষকেই সবসময় মহান করে দেখেছেন- কোন নির্দিষ্ট স্থানকে নয়। হতে পেরেছিলেন চিন্তা-ভাবনায়, মননে-মানসে, সংস্কৃতিতে পুরোমাত্রায় বৈশ্বিক একজন মানুষ। তার দশ বছর বয়সেই উপমহাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী অগ্রজ উদয় শঙ্করের দলে প্যারিস যাত্রা করেন। সেই থেকেই সমস্ত জীবনের সঙ্গীত সাধনায় প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্যকে একতারে বাঁধতে চেয়েছেন। প্রাচ্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং প্রাশ্চাত্যের ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতকে একসাথে মিশিয়ে সেতার ও অর্কেস্ট্রার মাধ্যমে নতুন নতুন সুর ও সঙ্গীতের একটি নতুন ধারা তৈরীর চেষ্টা থেকে একদিনের জন্যেও সরে আসতে দেখা যায় নি তাকে। কৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য তারে পৃথীবীর দুই প্রান্তকে একই ছন্দ, তাল, লয়, সুরে বাঁধতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন এই আজন্ম সুরসাধক। সত্যজিত রায়ের অপু-ত্রয়ী ও অন্যান্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনায়ও তিনি নিপুন হাতে এর সাক্ষর রেখে গেছেন। নতুন সুর তৈরীর নেশা তার মুখে যেমন সবসময় আবীরের ন্যায় লেগে থাকতে দেখা যেত, তেমনি তার শিল্পিত আঙ্গুল সেতার এবং অর্কেষ্ট্রার তারে তারে খেলে বেড়াত সৃষ্টির নব নব উৎসাহে। সৃষ্টিও করে গিয়েছেন বেশ কয়েকটি কালজয়ী রাগ ও সুর।
মানবদরদী গুনী এই শিল্পী তার দীর্ঘ জীবনে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। অস্কার সমতুল্য গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জেতেন তিন তিন বার। হাতে এসে যায় সুপারস্টারডাম পুরস্কারটিও- এর ফলে খ্যাতি-প্রতিপত্তি আরো বেশী করে ছড়িয়ে যায় পুরো বিশ্বময়। ভারত রত্ম খ্যাতি লাভ করেন মৃত্যুর একদশকের কিছু পূর্বে। এবছরের গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্যও তার মেয়ে অনুষ্কা সহ তার নাম মনোনীত হয়েছে। তবে সারা বিশ্বব্যাপী মানুষের কুন্ঠাহীন ভালোবাসার চেয়ে বড় কোন পুরষ্কার তার এই জীবনে জোটেনি।

আজন্ম সুরসাধক, বিশ্বখ্যাত সেতার বাদক পন্ডিত রবি শঙ্কর মহাপ্রয়ানে উত্তরাধিকার হিসেবে তার বাজিয়ে যাওয়া সুর সমস্ত বিশ্ববাসীকে, চিরদিনের সঙ্গী সেতারটি মেয়ে অনুষ্কাকে এবং বিশ্ব সঙ্গীতের ধারাটিকে অপর মেয়ে নোরা জোনসের হাতে যেন তুলে দিয়ে গেলেন।