নারীর প্রতি সহিংসতা- একটি নির্মোহ সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

মেহেদী হাসান
Published : 14 Jan 2013, 06:18 AM
Updated : 14 Jan 2013, 06:18 AM

আমাদের এই জনপদে নারীর প্রতি সহিংসতার নিরবিচ্ছিন্ন পুনরাবৃত্তির ফলে আমরা সময়ের এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যে, এখন এগুলোকে খুব বেশী অস্বাভাবিক বলে প্রতিভাত হয় না- নারীর প্রতি অধিকাংশ সহিংস ঘটনা অন্যান্য আট-দশটা প্রাত্যহিক ঘটনার মত স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয় মানুষ। আমাদের সমাজে বহু পূর্ব হতেই নারীর প্রতি নানা ধরনের সহিংসতা চলে আসছে। নারীর প্রতি সহিংসতার উদ্ভব ঘটে সাধারনত আমাদের সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের নারী-পুরুষ বৈষম্য এবং ফলত সমাজের ভেতরে জায়গা করে নেয়া শক্তিশালী পুরুষতান্ত্রিকতার উপর ভর করে। এই পুরুষতান্ত্রিকতার অবস্থান শুধুমাত্র পুরুষের ভেতরে বললে পুরো সত্য উন্মোচিত হয় না, নারী-পুরুষ সকলের ভেতরেই পুরুষতান্ত্রিকতা কম বেশী বিরাজমান। কারন হিসেবে দেখানো যায় নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া এমন অনেক সহিংসতা যেখানে অপর কোন নারী পুরুষটিকে বিভিন্ন রকমভাবে সাহায্য-সহযোগীতা করে। সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য ও পুরুষতন্ত্রের জোরালো অবস্থানের কারনে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন ও ধর্ম এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটে বিধায়- নির্যাতিত নারী তার প্রতি সহিংসতা বন্ধের আবেদন জানিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে দাঁড়াতে সাহস পায়না।

আমাদের সমাজের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত, অবিরতভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা সংগঠিত হয়ে আসছে। এই ঘটনাগুলো অধিকাংশ সময় সমাজের উপরের স্তরে ভেসে উঠতে পারেনা। যে নারীটি সহিংসতার শিকার হয় সে যেমন পরিবারে ও সমাজে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে তেমন নারীটির পরিবারও সমাজে মুখ দেখানোর জায়গা পায়না। চিরাচরিত সমাজব্যাবস্থা মেয়েটিকে তার পরিবারসহ এক ঘরে করে রাখে। ফলে পরিবারের অন্য সদস্যদের রাগও গিয়ে পড়ে ঐ নির্যাতিতা মেয়েটির উপর। ফলে পরিবারেও নির্যাতিতা মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে আরেক দফা নির্যাতন- যা মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া মেয়েটির আর কোন গতন্ত্যর থাকেনা। সমাজের অন্যান্য পরিবারগুলো নির্যাতিত মেয়েটির সাথে এমনকি তার পরিবারের অন্য কোন ছেলে-মেয়ের সাথে বৈবাহিক বা অন্যান্য সকল ধরনের সমন্ধ পাতানো থেকে বিরত থাকে। ঐ পরিবারের আত্মীয় সমন্ধীয় পরিবার এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষগুলোও ক্রমান্বয়ে নানা অজুহাতের ধোঁয়া তুলে ঐ আপদকালীন সময়ে দূরে সরে যায়।

রাষ্ট্রীয় আইন-আদালতের দন্ডে দোষী সাব্যস্ত ব্যাক্তি একবারমাত্র দন্ডিত হয়- দন্ড ভোগ করার পর খালাস পেলে তাকে ঐ দন্ডের জের খুব বেশী বয়ে বেড়াতে হয় না। কিন্তু সমাজের সাজা বড় কঠিন সাজা। সমাজের নিকট কেউ একবারমাত্র দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে সারাজীবনধরে বার বার প্রতিনিয়ত উঠতে বসতে ঐ দন্ডটি ভোগ করে যেতে হয়। অযৌন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যাক্তি মাফ পেয়ে যেতে পারে কিন্তু অপরাধটি যদি যৌনতা সংশ্লিষ্ট হয় এবং সমাজের চোখে দোষী সাব্যস্ত ব্যাক্তিটি যদি হয় নারী(পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেকোন ধরনের যৌন সহিংসতায় নির্যাতিত নারীটিকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়) তাহলে তার কোন ক্ষমা নেই। অপরাধী সাব্যস্ত নির্যাতিত নারীটির মৃত্যুর পরেও তার উপর সমাজের দন্ড শেষ হয়ে যায় না। তার রক্ত সম্পর্কীয় উত্তরাধীদেরকেও ক্রমান্বয়ে এই দন্ড ভোগ করে যেতে হয়- বিশেষ করে নারী উত্তরাধিকারীদের ক্ষেত্রে। সুতরাং কোন ধরনের যৌন সহিংসতা ঘটলে নির্যাতিতা মেয়েটি ও তার পরিবার সমাজের সাজার ভয়ে ঘটনাটিকে প্রকাশ করা তো দূরের কথা উল্টো প্রাণপন চেষ্টা করে ঘটনাটি চেপে রাখার জন্য। সহিংসতার ঘটনাটি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে সবসময় সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। প্রায় সময়ই সমাজের কল্পিত সাজার ভয়ে নির্যাতিত নারী বা অনেক সময় তার বাবা-মাকেও আত্মহত্যা করতে দেখা যায়।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটনাগুলোকে দেখা হয় নির্যাতক পুরুষটির জয় এবং নির্যাতিত নারীটির পরাজয় হিসেবে। কোন পুরুষ কোন নারীর কাছে প্রেম, বিয়ে বা শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব রেখে প্রত্যাখ্যাত হলে, ঐ পুরুষটি তখন মনে মনে নিশ্চিত হয় সে যদি ঐ নারীর উপর যৌন সহিংসতা চালাতে সক্ষম হয় তাহলে সমাজ ঐ ঘটনায় নারীটিকে দোষী সাব্যস্ত করে তার হাতে তুলে দেবে। সমাজের আদেশ অমান্য করে নির্যাতিত নারীটির সমাজ কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা। নির্যাতিত নারীটি ঐ ঘটনার জের সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়াতে বাধ্য হবে। পুরুষটি খুব ভালো ভাবেই তুলতে সক্ষম হবে নারী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার প্রতিশোধ- বাস্তবে এমনটি ঘটতেই দেখা যায়। এমন ধরনের বাস্তব ঘটনাপ্রসূত চিন্তায় নির্যাতকরা এই ধরনের সহিংসতা ঘটানোর বৈধতা পেয়ে যায়। ঘটনাটি ফাঁস হয়ে গেলে যেহেতু নির্যাতিত নারীটি নির্যাতক পুরুষটির হাতের মুঠোয় চলে আসবে এবং সমাজে পুরুষ হিসেবে তার প্রতিপত্তি অনেকটাই বেড়ে যাবে সেই হেতু সহিংসতা ঘটানোর পরে নির্যাতক পুরুষটি সমাজের নিকট ঐ ঘটনাটি ফাঁস করে দেওয়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়। সমাজের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ঘটনাটির মীমাংসা হয়- মেয়েটি সারাজীবনের জন্যে চলে আসতে বাধ্য হয় নির্যাতকের হাতের কব্জায়।

আরেকটি বিষয়ও খুব স্পষ্টভাবে ধরা দেয়- পুরুষ নারীর উপর শুধু মাত্র তার শারীরিক সম্ভোগ চরিতার্থতা করার জন্য যৌন সহিংসতা চালায় না। কারন হিসেবে দেখানো যায়, যে সমস্ত পুরুষ নারীর উপর যৌন সহিংসতা চালায় তাদের অনেকেই যেমন বিবাহিত তেমনি আমাদের সমাজে বর্তমানে যৌনকর্মীর অভাব পরিলক্ষিত হয় না। বিভিন্ন পাড়ায়, মহল্লায়, রাস্তা-ঘাটে, ঝোপে-জঙ্গলে, শহরের আবাসিক হোটেলগুলোতে ও তাদের জন্যে গড়ে উঠা নির্দিষ্ট যৌনপল্লীতে অনেক যৌনকর্মী আছে। তাদের অনেকেই আবার যথেষ্ট আবেদনময়ী ও বিভিন্ন ধরনের যৌনকলায় দক্ষ, ফলে পুরুষকে পুরোপুরি শারীরিক সম্ভোগ দানে সক্ষম। যৌনকর্মীরা কোন ধরনের শর্তারোপ না করেই নাম মাত্র মূল্যে যেকোন ধরনের খদ্দেরের নিকট শরীর বিক্রি করে থাকে। পুরুষের শারীরিক সম্ভোগের প্রয়োজন হলে সে নির্দ্বিধায় যৌনকর্মীদের নিকট গমন করতে পারে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের যৌন কর্মীদের নিকট গমন খুব সহজভাবেই মেনে নেয়- এই বিষয়টি পূর্বেও কখনও অবৈধ ছিল না, এখনও নয়। সুতরাং বোঝা যায় নারীর প্রতি পুরুষের যৌনসহিংসতা পুরুষ তন্ত্রের হাজার বছরের পথ চলায় নারীকে তার চেয়ে হীন মনে করার কারনে, পুরুষ হিসেবে নারীর উপর সমাজে তার বিজয় গর্ব প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে একধরনের পাশবিক প্রবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।

নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া খুব সামান্য কিছু সহিংসতা তার মাত্রারিক্ত ভয়াবহতায় অনেকবেশী প্রকটিত হয়ে যাওয়ার কারনে বাধ্যতামূলক ভাবেই সমাজের অনেক উপরের স্তরে ভেসে উঠে। সহিংসতার ভয়াবহতার মাত্রা যখন অনেক বেশী হয়ে যায় তখন ঘটনাগুলোকে আর চেপে রাখা যায় না বা সমাজের রুদ্ধদ্বার বৈঠকেও আর এগুলোর সমাধান কুলিয়ে উঠেনা; বর্তমানের প্রযুক্তি বিপ্লবের ফলে অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে যাওয়া নানা ধরনের মিডিয়ার কল্যানে সারা দেশব্যাপী মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তখন সমাজের কিছু মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষ, সচেতন তরুন ছাত্র-ছাত্রী, বুদ্ধিজীবি ও নানাধরনের সরকারী-বেসরকারী সংগঠন ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে দাঁড়িয়ে নির্যাতকের শাস্তির দাবীতে দৃঢ় অবস্থান গ্রহন করে এবং যথারীতি কিছুদিনের মধ্যে ভুলেও যায়। অপেক্ষা করতে থাকে সহিংসতার ভয়াবহতার অতিমাত্রার কারনে এবং মিডিয়ার কল্যানে সারাদেশ ব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নারীর উপর আরেকটি সহিংস ঘটনার। শুধুমাত্র সত্যিকার প্রগতিশীল কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন ও জনগনের সাথে অধিকমাত্রায় সম্পৃক্ত কিছু বুদ্ধিজীবী নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা ও পুরুষতান্ত্রিকতার উচ্ছেদকল্পে বিভিন্ন ধরনের প্রচার-প্রচারনা ও মননশীল কাজ ধারাবাহিক ভাবে চালিয়ে নিয়ে যায়।

সহিংসতার ঘটনাটি পুরোদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে এবং নির্যাতক ব্যাক্তিটি তাৎক্ষনিক ভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে প্রেরিত হলেও নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারের সমাজের নিকটে অপাংক্তেয় হয়ে যাওয়ার ভয়টি দূরীভূত হয় না। কারন রাষ্ট্র হয়ত সাময়িকভাবে নির্যাতককে দোষী সাব্যস্ত করে কারাগারে প্রেরণ করেছে এবং অনেকেই নির্যাতকের ফাঁসির জন্যে রাজপথে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে তবুও তারা স্পষ্টভবেই জানে পুরুষতন্ত্রের ধারায় সমাজের একপেশে রায়টি যেকোন মূল্যে তাদের বিপক্ষেই যাবে। এজন্যে দেখা যায় নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারের লোকজন মিডিয়ার সামনে আসেনা বা মিডিয়াতে তাদের নামধাম প্রকাশের অনুমতি দেয় না। অনেক সময় নির্যাতিত নারীর ঘনিষ্ঠ কেউ মিডিয়াতে কথা বললেও ঘষা কাঁচের আবরনে ঐ ব্যাক্তিটির মুখ ঢেকে রাখা হয়। একসময় দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার কথা নির্যাতিতা, তার পরিবার এবং তাদের চারপাশের সমাজের লোকজন ব্যতীত সবাই ভুলে যায়। নির্যাতিতা ও তার পরিবার ভুলে যেতে পারেনা কারন সমাজ তাদেরকে সবসময় মনে করিয়ে দেয়। সমাজের দায় থাকে তাদেরকে মনে করিয়ে দেওয়ার এবং অবিরতভাবে তাদের দন্ড চালিয়ে নেওয়ার স্বার্থে। অল্পকিছুদিনের মধ্যেই নির্যাতক ব্যক্তিটি আইনের ফাঁক ফোকর গলে বিজয় গর্ব মুকুট মাথায় তুলে সদম্ভে সমাজে পদার্পন করে। এসেই নির্যাতিত নারী এবং তার পরিবারের লোকজনকে হুমকি ধামকি দিতে থাকে এবং আরো সহিংসতা ঘটানোর জন্য প্রস্তুত হয়। নির্যাতকের এই জয় পুরুষতন্ত্রের জয় হিসেবেই সূচিত হয় এবং মানবিক বোধ সম্পন্ন কিছু মানুষ ও গোষ্ঠীর অগোচরে সমাজের ভেতরে নারীর প্রতি আরো সহিংসতা ঘটার প্রস্তুতি চলতে থাকে পুরোদমে।

পূর্বেই বলা হয়েছে, নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারন নারী-পুরুষের মাঝে বিরাজমান নানা ধরনের বৈষম্য এবং সমাজের ভেতরে অবস্থিত শক্তিশালী পুরুষতান্ত্রিকতা। মূলত নারী-পুরুষের মধ্যে নানা ধরনের বৈষম্যের ফলশ্রুতিতেই বাধ্যগতভাবেই তৈরী হয় পুরুষতান্ত্রিকতা। এরা আবার একে অপরের পরিপূরক, পরস্পরের হাতে হাত ধরে চলে এবং এদের একটি অপরটিকে সমাজের ভেতর ডাল-পালা বিস্তার করতে সাহায্য করে। একমাত্র আদিম গোষ্ঠীভিত্তিক কৌমসামজে কেবল নারী-পুরুষ বৈষম্য এবং পুরুষতান্ত্রিকতার অস্তিত্ব ছিল না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পৃথিবীর কোন কোন জায়গায় রক্তসম্পর্কীয় গোষ্ঠী ভিত্তিক আদিম কৌমসমাজে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। আদিম কৌমসমাজে অবাধ যৌনতার রীতি প্রচলিত ছিল বিধায় গোষ্ঠীর সন্তান-সন্তনীদের পিতৃপরিচয় জানা দুরূহ বা অনেকটা অসম্ভব ছিল। সন্তান-সন্ততিদের মাতৃপরিচয় কিন্তু সহজেই নির্ধারিত করা যেত। আদিম কৌমসমাজে যেহেতু রক্তসম্পর্কের প্রাধান্য ছিল সেহেতু সন্তান-সন্তনীরা সকলেই মাতৃপরিচয়ে বেড়ে উঠত। বয়স্ক ও অধিক সন্তান-সন্ততি আছে এমন কোন নারী নির্বাচিত হত গোষ্ঠী প্রধান হিসেবে। আদিম কৌমসমাজে খাবার ও মৌলিক চাহিদা পরিপূরনের অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী উদ্বৃত্ত হত না বলে উত্তরাধিকারের কোন প্রশ্নও সেখানে ছিল না। ধীরে ধীরে যখন মানুষের মধ্যে শ্রমের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হতে থাকে, শ্রমের হাতিয়ারগুলো উন্নত হয়, পশুপালন পালন বিদ্যা মানুষের আয়ত্তের মধ্যে চলে আসে, শুরু হয় শ্রম বিভাজন এবং সমাজ এগিয়ে যেতে থাকে কৃষির দিকে, তখন মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের বাইরেও খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পরিপূরনের বাদ-বাকী জিনিস পত্র উদ্বৃত্ত হতে শুরু করে। যখন মানুষের উদ্বৃত্ত কিছুই থাকত না তখন তার কাছ থেকে কোন কিছু কেড়ে নেয়া মানে তাকে প্রকারান্তরে মেরে ফেলা। যখন থেকে উদ্বৃত্ত হতে শুরু করল তখন খুব বেশী ক্ষতির কারন না ঘটিয়েও খাদ্যদ্রব্য বা অন্যান্য জিনিস পত্র কেড়ে নেয়া যেত। এভাবেই আরো নানা সামাজিক জটিলতায় শুরু হল মানুষের উপর মানুষের শোষণ প্রক্রিয়া। এই উদ্বৃত্ত দ্রব্য সামগ্রী এবং শোষন টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষের প্রয়োজন হল নিজস্ব উত্তরাধিকার তৈরীর। এই উত্তরাধিকার তৈরী করার অনিবার্য কারনবশত শুরু হল নর-নারীর একবিবাহ প্রথা। অবাধ যৌনতার রীতি থেকে এক বিবাহ প্রথায় আসতে অবশ্য পার হয়ে আসতে হয়েছে জুড়ি বিবাহের স্তর। জুড়ি বিবাহে নারী-পুরুষ তার বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরেও শারীরীক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো- সমাজে এর বৈধতা ছিল। উদ্বৃত্তের পরিমান বেড়ে যাওয়াতে যখন শোষণ প্রক্রিয়া আরো দ্রুততর হল তখন অনিবার্যভাবেই উত্তরাধিকারে আরো বেশী করে রক্তের শুদ্ধতা আনার প্রয়োজনে জুড়ি বিবাহ আস্তে আস্তে স্থানান্তরিত হল এক বিবাহ প্রথায়। এই এক বিবাহ প্রথায় বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে শারীরিক সম্পর্ক অবৈধ ঘোষিত হল। এই অবৈধ ঘোষনা বাস্তবায়িত হল শুধু নারীর ক্ষেত্রে কিন্তু পুরুষের বেলায় এটা খাটলনা উপরন্তু আরো বেড়ে চলল কারন ইতিমধ্যেই উৎপাদনের সমস্ত উপায়ের মালিক পুরুষ। আর এই একবিবাহ প্রথার কারনে খুব সহজেই সন্তান-সন্ততির পিতৃপরিচয় জানা সম্ভব হল। আর এদিকে জন্মনিয়ন্ত্রনের কোন পদ্ধতি জানা না থাকায় বছরের পর বছর ধরে নারী ব্যাস্ত রইল সন্তান ধারনের কাজে। নারী হয়ে রইল গৃহবন্দী-আর পুরুষ নিজেকে বাহিরের উৎপাদনের কাজে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করল। অনিবার্যভাবেই পুরুষ হয়ে উঠল সমাজের সমস্ত উৎপাদনের উপায়ের মালিক ও সমাজের কর্তাব্যাক্তি। উৎপাদনের উপায়ের মালিক হওয়ার সাথে সাথে নারী ও তার শ্রম শক্তির উপর শুরু হল তার শোষণ প্রক্রিয়া। এখানে বলে রাখা দরকার মানুষের উপর মানুষের শোষণ প্রক্রিয়ায় সর্বপ্রথম শুরু হয় নারীর উপর পুরুষের শোষণ। নারী-পুরুষের মাঝে তৈরী হল অর্থনৈতিক বৈষম্যের দুর্ভেদ্য দেয়াল।

একটি সমাজের থাকে দুইটি স্তরঃ মূলকাঠামো বা বনিয়াদ ও উপরিকাঠামো। সমাজের ভেতরে মানুষের পারস্পারিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই তৈরী হয় তার বনিয়াদ এবং বনিয়াদের ফলশ্রুতিতে প্রতিষঙ্গী হিসেবে গড়ে উঠে উপরিকাঠামো। সুতরাং নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলশ্রুতি হিসেবে তৈরী হল উপরিকাঠামোগত নানা ধরনের সামাজিক বৈষম্য। সমাজের নারী-পুরুষের নানা ধরনের বৈষম্যের মিলিত রূপ হিসেবে আবশ্যিকভাবে জন্ম হল পুরুষতন্ত্রের আর নারী আক্রান্ত হতে লাগলো নানা ধরনের সহিংসতায়। আদিম কৌম সমাজব্যবস্থার পর মানবজাতি ইতিমধ্যে ইতিহাসের কয়েকটি কালপর্ব বা ঐতিহাসিক গঠনরূপ(দাসতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা) অতিক্রম করে এসেছে। কিন্তু উৎপাদনের উপায়ের মালিকানার তেমন কোন হেরফের হয়নি বরঞ্চ পুরুষের মালিকানার ভিত্তি আরো মজবুত হয়েছে। আমাদের বর্তমান পুঁজিতান্ত্রিক সমাজেও উৎপাদনের উপায়ের মালিকানায় নারীর কোনধরনের শরীকানা তৈরী হয়নি। ফলে এই সমাজেও আছে নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও এর কারনে তৈরী হওয়া অন্যান্য নানা ধরনের সামাজিক বৈষম্য টিকে আছে। এর মধ্যে পুরুষতন্ত্র তার হাজার বছরের পথ চলায় নিজেকে অনেক শক্তিশালী ও টেকসই করার প্রয়াস পেয়েছে।

সমাজগঠনের মূল একক পরিবারের মধ্যেই অবোধ শিশুরা নারী-পুরুষ বৈষম্যের কবলে পড়ে। শুরু হয়ে যায় খাবার-দাবার থেকে শুরু করে পোশাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষাগ্রহনের অধিকার, অন্যান্য নানা সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত নারী-পুরুষ বৈষম্য। এমনকি পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যান্য বায়োজ্যোষ্ঠ সদস্যদের নিকট হতে প্রাপ্ত আদর-ভালবাসায়ও নারী-পুরুষ বৈষম্য প্রকটিত হয়ে উঠে। নারীশিশু জন্মগ্রহন করেই নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়। এমনকি তাদের জন্মটাও যেন অনেকটা অপ্রত্যাশিত। এখনো পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে নারী শিশুকে জন্মমাত্র তাকে মেরে ফেলার নিয়ম প্রচলিত আছে।

নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় যা হয়ে দাঁড়ায় তা হল উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষ অসম বন্টন। আমাদের সমাজে নানা ধরনের ধর্মমতের আইনে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বন্টন হয়। ইসলাম ধর্মমতে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর পাবার কথা পুরুষের প্রাপ্য সম্পত্তির অর্ধেক। কিন্তু সমাজের অভ্যন্তরের নানা সামাজিক বৈষম্য ও অসুবিধার কারনে নারী তার এই প্রাপ্যভাগটুকুও নিতে পারেনা। কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী তার "ফরায়েজী" নামক প্রবন্ধে নারীর বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা আলোচনা করে দেখিয়েছেন কোন কোন কারনে নারী উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে ধর্মমত কর্তৃক অসমবন্টনের প্রাপ্য ভাগটুকুও নিতে অসমর্থ হয়। আর হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী কোনভাগই পায়না। ফলে নারী তার সারাটা জীবন সম্পূর্ণ সহায়-সম্পত্তিহীন অসহায় অবস্থায় পার করে। সম্পত্তিহীন নারী তার প্রথম জীবন পার করে পিতার দায় হয়ে, দ্বিতীয় জীবনের দায় তার স্বামীর উপর এবং শেষজীবনের দায় গ্রহন করে তার সন্তান-সন্ততি। নারীর কোন নিজস্ব বসত-বাড়িও থাকেনা। পিতার বাড়ি, স্বামীর বাড়ি, এবং শেষ-মেষ পুত্র-কন্যার স্বামীর বাড়িতে সে আশ্রয় লাভ করে। সারাজীবন ধরে নারী বঞ্চিত হয় তার নিজের পরিচয়টুকু থেকেও। পিতার বাড়িতে অমুকের মেয়ে, স্বামীর বাড়িতে অমুকের বউ, সন্তানের বাড়িতে অমুকের মা- এধরনের পরিচয় তাকে সারাজীবন ধরে বহন করে যেতে হয়।

বর্তমান সময়ে নারী শিক্ষাগ্রহনের কিছুটা অধিকার পেলেও এক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ বৈষম্য এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে। পুরুষতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন আমাদের পিতা-মাতারা মনে করে, শিক্ষা-দীক্ষায় তার কন্যার কোন দরকার নেই; শিক্ষাকে বাস্তব কাজে লাগানোর প্রয়োজনে নয়- একজন সুপাত্র পাওয়ার জন্য যতটুকু শিক্ষা-দীক্ষার প্রয়োজন ততটুকুই তার জন্য যথেষ্ট। আর যে ধরনের শিক্ষাকে নারীর ক্ষেত্রে তার পিতা-মাতা অনেক বেশী প্রয়োজনীয় বলে মনে করে তা হল -রান্না-বান্না, কাপড় কাচা, ঘর ঝাট দেওয়া, সন্তান পালন ইত্যাদি নানা গার্হস্থ সংক্রান্ত শিক্ষা। আমাদের রাষ্ট্রও শুধুমাত্র নারীদেরকে গার্হস্থ শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করার জন্যে গার্হস্থ অর্থনীতি বিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রেখেছে। যেখানে নারীর অধিকার একচেটিয়া-পুরুষের কোন ধরনের প্রবেশাধিকার নেই। নারী যত বড় শিক্ষিতই হোকনা কেন বিনা বেতনের একঘেয়েমী গার্হস্থ শ্রম থেকে তার নিস্তার নেই। আর একজন পুরুষ যতই অকর্মন্য হোক না কেন গার্হস্থ কাজে নারীর সামান্য সহযোগীতা করতে গেলেও তার পৌরুষে আঘাত লাগে। অবমাননাকর স্ত্রৈণ বিশেষণটি তার নামের সাথে লেগে যায়।

পুরুষের তৈরী করা ধর্ম নারী-পুরুষ বৈষম্যেকে বৈধতা দান ও টিকিয়ে রাখতে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। এ জন্যে সে যেমন তৈরী করেছে নানা ধরনের ধর্মীয় রীতি-নীতি তেমনি অন্যান্য পূর্ববর্তী পুরুষতান্ত্রিক নৈতিকতাকে সে করেছে আয়ত্তীকৃত। ধর্মভিত্তিক সমাজে ঈশ্বরের দোহাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় দোহাই, সেখানে কোন যুক্তি-তর্ক খাটেনা। মধ্যপ্রাচ্যে উত্থিত হওয়া ধর্মগুলো মানুষ সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ইতিহাস খুব খেলোভাবেই উপস্থাপন করল; কোন ধরনের যুক্তি তর্কের দোহাই না দিয়েই আকস্মিকভাবে ঘোষণা করে বসল-নারীকে তৈরী করা হয়েছে পুরুষের পাজরার একটি হাড় থেকে। প্রথম তৈরী করা হয় পুরুষকে এবং নারী তৈরীর কোন ইচ্ছাই নাকি ঈশ্বরের ছিলনা। পুরুষ তৈরী হওয়ার পর তার নিঃসঙ্গতা দূর করা, তাকে মনোরঞ্জন দান, এবং তার কাম প্রবৃত্তি নিবৃত্ত করার মানসে ঈশ্বর নাকি অনেকটা বাধ্য হয়ে নারীকে তৈরী করলেন। ধর্ম আরো ঘোষণা করলো নারী হচ্ছে আদি-পাপী। নারীই পুরুষকে তার কাম কলার সাহায্যে ফুসলিয়ে ফুসলিয়ে পাপের পথে টেনে এনে, তাকে নিষিদ্ধ ফল গন্ধম খাইয়েছে। এই আদি পাপের শাস্তি স্বরূপই নাকি তাকে পেটে দশ মাস সন্তান ধারনের প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে সারা জীবন ধরে। এই হচ্ছে পুরুষ সৃষ্ট ধর্ম যে নাকি সন্তান ধারনকে আদি পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে ঘোষনা করে! ধর্ম এসেই নারীর শারিরীক যৌন অস্তিত্ব-পুরুষের ভোগের বস্তু ও সন্তান ধারনের যন্ত্র(নারীর আদি পাপের ফল)শুধুমাত্র এসকল বিষয় স্বীকার্যের মধ্যে এনে তার অন্যন্য সকল ধরনের শারীরিক-মানসিক অস্তিত্বকে ঝেড়ে ফেলে দিল। সুতরাং পুরুষসৃষ্ট ধর্মমতে নারীর একমাত্র কাজ পুরুষের মনোরঞ্জন, তাকে শরীর দান এবং তার উত্তরাধিকার তৈরী করা। পূর্ব থেকেই চলে আসা বাল্যবিবাহ ও পুরুষের বহুবিবাহকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিল এই ধর্ম। ইসলাম ধর্মের প্রধান প্রবর্তক সাত বছরের বালিকা থেকে শুরু করে ষাট বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত চৌদ্দটি বিয়ে করে একসাথে বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহের পারাকাষ্ঠা দেখালেন। এই বাল্যবিবাহে পুরুষের তুলনায় নারীর ক্ষতি অসামান্য-বাল্যবিবাহের কারনে খুব তাড়াতাড়ি একজন নারীর শরীর ভেঙ্গে পড়ে, অকাল গর্ভধারনে তৈরী হয় নানা রকম শারিরীক-মানসিক জটিলতা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তান প্রসবের সময় নারীটিকে অকাল মৃত্যু বরন করে নিতে হয়। আআইনত আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ হলেও বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় ট্যাবু ও বাল্যবিবাহে নারীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতা বিষয়ক অসচেতনতার ফলে পূর্বের মতই বাল্যবিবাহ ঘটে আসছে। সনাতন হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান প্রবর্তক কৃষ্ণ একবারে ষোলশত গোপীকার সাথে যৌথ সঙ্গম করে পুরুষের যৌনক্ষমতার দাপট দেখালেন। হিন্দু ধর্মের অনুসরীরা এটাকে কাম-লীলা হিসেবে অভিহিত করে থাকে- এভাবেই বিভিন্ন ধর্মের প্রবর্তকগন নারীর প্রতি পুরুষের যৌনাচরনের পথ দেখিয়েছেন। ধর্ম এখানেই ক্ষান্ত হয়নি- যুদ্ধবন্দী নারীদেরকে গনিমতের মাল হিসেবে পুরুষকে যথেচ্ছ ভোগের অধিকার যেমন দিয়েছে তেমনি এক্ষেত্রে নারী অনিচ্ছুক হলে তাকে ধর্ষন করার অনুমতিদানেও এতটুকু পিছপা হয়নি। ধর্ম প্রবর্তকগন এগুলো সবই নাকি করেছেন সৃষ্টিকর্তা মহান ঈশ্বরের আদেশে। আবার এসব ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব ভেদ করলে দেখা যায় ধর্মপ্রবর্তকগনই আসলে ঈশ্বর, মানব বেশে পৃথিবীতে এসেছে মানব সমাজ দেখতে এবং মানবীদের সাথে সঙ্গম করে তাদের যৌনকামনা নিবৃত্ত করতে। শরীর-মনের উপর নারীর যে সামান্য স্বাধীনতাটুকু ছিল পরকালের ভয় দেখিয়ে ধর্ম সেটুকুও নিল কেড়ে। নারীকে চার দেয়ালের অভ্যন্তরে পায়ে লোহার শিকল বেঁধে বন্দী করে ফেললো। নারী ঘরের বাহির হলেই নাকি নিষ্পাপ পুরুষের মধ্যে কাম উত্তেজনা জাগিয়ে সমাজ ব্যাভিচার বিশৃংখলায় ভরিয়ে তুলবে। নারীর উপর ধর্মের মহান নির্দেশ জারি হল- পুরুষের দাসত্ব কর- এটাই এখন থেকে তোমার একমাত্র কাজ। তাহলেই নারী পরকালের চিরসুখের জীবন লাভ করবে-এর সামান্য একটু ব্যাতিক্রম হলেই তাকে দোজখের আগুনে পুড়ে মরতে হবে। ধর্মের হোতা কোন এক পুরুষ দোজখ ঘুরে এসে জানিয়েছে সেখানে শুধু নারীতে ভর্তি- পুরুষদের নাকি সেখানে খুঁজে পাওয়াই অনেকটা দুষ্কর।

বিজ্ঞানের উন্মেষ হওয়ার সাথে সাথেই পুরুষ নারীকে পদানত রাখতে বিজ্ঞানকেও বিকৃত করতে শুরু করে। জীববিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে সে বলতে শুরু করে নারী-পুরুষের চেয়ে প্রকৃতিগতভাবেই শারীরিক ও মানসিকভাবে হীন। সমাজের উৎপাদনের উপায়ের একমাত্র মালিক পুরুষ কর্তৃক নারীর শ্রম শক্তি অবিচ্ছিন্নভাবে হাজার বছরের শোষণের ফলে নারীর শ্রমশক্তি কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়েছে। নারী-পুরুষের এই বৈষম্যমূলক সমাজে নারীর সঠিক সুযোগ সুবিধা না পাবার কারনে সে ঠিকমত বিকশিত হয়ে উঠতে পারেনা। এই সুযোগে পুরুষ প্রকৃতি ও জীববিজ্ঞানের দোহাই পেড়ে উচ্চস্বরে ঘোষনা করতে শুরু করে- নারী পুরুষের চেয়ে শারীরিক মানসিকভাবে হীন হওয়ার কারনে নারী রাজনীতি-সংগঠন- জনপ্রশাসন-অফিস-আদালত-রাষ্ট্র পরিচালনা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, দর্শন-চিন্তা, আইন, শিল্প-সাহিত্য চর্চা ও ভারী শারীরিক শ্রম ইত্যাদি আরো অনেক বাহিরের কাজে কোন ধরনের ভূমিকা রাখতে অক্ষম। তার পক্ষে শুধু সম্ভব সন্তান পালন, অসুস্থ মানুষের সেবা-যত্ন ও বাড়ি ঘরের অন্যান্য পুনরাবৃত্তিমূলক গৃহস্থালী কাজ সম্পন্ন করা। আরো বলা হল নারী নাকি প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে নাটক-সিনেমায় অভিনয়, নৃত্যকলা ও গান-বাজনায় খুব সহজেই দক্ষতা অর্জন করতে পারে। আসলে পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য নারীকে দিয়ে এ ধরনের কাজ করানোর তার দরকার ছিল। জীববিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে সে আরো বলতে শুরু করলো প্রকৃতিগতভাবেই নাকি নারীর কাম প্রবৃত্তি পুরুষের চেয়ে কয়েকগুন বেশী। সুতরাং পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য তাকে কিছুটা বাইরে বের হতে দিলেও তার লাগামের রাশ খুব শক্ত হাতে টেনে ধরতে হবে। যাতে করে নারী তার কয়েকগুন বেশী কামপ্রবৃত্তির তাড়নায় সমাজে ব্যভিচারের বিষ বাষ্প ছড়াতে না পারে। অথচ প্রকৃতি ও জীববিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে পুরুষ কর্তৃক সৃষ্ট এই ধরনের অসঙ্গতিমূলক অনুসিদ্ধান্ত গুলো বিজ্ঞান তার অগ্রগতির সাথে সাথেই ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। সাধারন মানুষ যারা বিজ্ঞানের চর্চা করেনা বা ধর্মবিশ্বাসী মানুষজন- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সকল সুফল অনায়াসে ভোগ করেও যারা বিজ্ঞানের প্রতি আস্থাশীল নয় তাদের জ্ঞাতার্থে বলা যায়- উপযুক্ত বিকাশের সুযোগ পেলে নারী পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকল ধরনের কাজ করতে সক্ষম। চোখ-কান খোলা রেখে বাইরের দিকে তাকালে দেখা যায় পুরোবিশ্বব্যাপী বিকাশের সুবিধা প্রাপ্ত নারী- রাষ্ট্র, নানা ধরনের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংঠন, জনপ্রশাসন, অফিস-আদালত পরিচালনা থেকে শুরু করে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, দর্শন-চিন্তা, শিল্প-সাহিত্য চর্চা ইত্যাদি নানা কাজ পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করে চলছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অবদানে জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি চালু হওয়ার কারনে নারীকে আর আগের মত বছরের পর বছর সন্তান উৎপাদনের কাজে ঘরের মধ্যে পড়ে থাকতে হয়না। কম্পিউটারের সামনে বসে এবং ইলেক্ট্রিক সুইচে আঙ্গুলের একটি আলতো ছোঁয়ায় অনেক ভারী ভারী কাজ যন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই করে ফেলা যায়। ফলে নারী সন্তান পেটে নিয়েও নানা ধরনের কাজ করে যেতে সক্ষম। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যানে নারীকে সন্তান ধারনের কাজটি না করলেও চলবে। মানুষের অন্যান্য অনেক কাজের মত প্রযুক্তি এই কাজটিও হয়তো নিজের কাঁধে তুলে নিবে।

যেকোন সমাজের জন-জীবনের বৈশিষ্ট্য তার নিজস্ব ভাষায় প্রতিফলিত হয়। নানা ধরনের নারী-পুরুষ বৈষম্য ও ফলত পুরুষতান্ত্রিকতা আমাদের ভাষায়ও তার নিজের বিকৃত ছায়া ফেলেছে। অন্যান্য দেশের ভাষাতত্ত্ববিদগন সচেতন হয়ে নারী-পুরুষ বৈষম্য মূলক শব্দগুলো তাদের ভাষা থেকে ধীরে ধীরে ছেঁটে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এজন্যে তাদের ভাষা একাডেমী থেকে নানা রকম প্রজ্ঞাপন জারি চলছে। কিন্তু আমাদের দেশের ভাষাতাত্ত্বিকরা বিষয়ে এখন পর্যন্ত তারা সচেতন হয়ে উঠতে ব্যার্থতার পরিচয় দিচ্ছে কারন পুরুষতান্ত্রিকতার অবস্থান এখনো তাদের মনে অনেক বেশী পোক্ত। আমাদের ভাষায় নারীবাচক অনেকগুলো শব্দ রয়েছে যার প্রত্যেকটি নারীর দূর্বলতা জ্ঞাপক ও কাম সম্পর্কিত অশ্লীল শব্দার্থ বহন করে এবং প্রকারান্তরে পুরুষতান্ত্রিকতা ও নারী-পুরুষ বৈষম্যকে প্রকাশ্য স্বীকৃতি দেয়। আমাদের ভাষায় এরকম কয়েকটি শব্দ হল- অবলা(যার বল বা নিজে চলার শক্তি নেই), রমনী (রমন করার উপযুক্ত), ললনা (যাকে লালন-পালন করতে হয়), কামিনী(যার কাম প্রবৃত্তি বেশী), মহিলা(যে মহলের ভেতর বন্দী থাকে), ছিনাল(যে পুরুষকে তার শরীর দিয়ে ভোলাতে ছিনালী প্রবৃত্তির আশ্রয় নেয়), সতী( শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যার সততা নির্ধারিত হয়), সতীন(একই পুরুষের বহু স্ত্রী-যা পরুষের বহু বিবাহকে স্বীকৃতি দেয়), স্বামী-স্ত্রী(স্বামী শব্দের অর্থ মালিক বা প্রভু-এখানে নারীটি হচ্ছে স্ত্রী জাতির একজন, স্বামী নামক ব্যাক্তিটি যার মালিক) ইত্যাদি আরো নানা ধরনের শব্দ ও শব্দ জোড় আমাদের ভাষায় প্রচলিত আছে। ওদিকে পুরুষবাচক প্রত্যেকটি শব্দ হল জ্ঞান, সাহস এবং বীরত্ব ব্যাঞ্জক-স্বয়ং পৌরুষ শব্দটির মূলগত অর্থ হচ্ছে সাহস, পুরুষ হচ্ছে পৌরুষ শব্দটির বিশেষ্যণ পদ। পুরুষ বাদে অন্য কোন শব্দ আমাদের ভাষায় নেই বিধায় মানব প্রজাতির একটি অংশকে বোঝাতে এই প্রবন্ধেও পুরুষ শব্দটি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এছাড়াও মানুষের সাধারন বৃত্তিমূলক যতগুলো শব্দ বা শব্দ জোড় রয়েছে তার প্রত্যেকটি পুরুষবাচক। এই শব্দগুলোর পাশে বিভিন্ন ধরনের প্রত্যয় যোগ করে নারীবাচক করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমনঃ ছাত্র-ছাত্রী, নেতা-নেত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, মানব-মানবী ইত্যাদি আরো বহু শব্দ। আমাদের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া চোখে যদিও ভাষার এই বিষয়গুলো সহজ-স্বাভাবিক মনে হয় কিন্তু এর পিছনে অবিরামভাবে কাজ করে যাচ্ছে গোষ্ঠী ভিত্তিক আদিম কৌম সমাজের পর থেকে শুরু হয়ে যাওয়া নারী-পুরুষ বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিকতা। সমাজের জনজীবনের নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য যেমন ভাষার উপর প্রতিফলিত হয় তেমনি ভাবে ভাষাও প্রভাব ফেলে সমাজের গতিপ্রক্রিয়ার উপর। সুতরাং আমাদের ভাষায় পুরুষতান্ত্রিকতা ও নারী-পুরুষ বৈষম্যের স্বীকৃতিও আমাদের সবার অলক্ষিতে পরিনামে ওগুলোকেই বাড়িয়ে তুলছে।

সমাজ একটি নির্দিষ্ট ঐতাহাসিক কালপর্ব থেকে আরেকটি ঐতাহসিক কালপর্বে উত্তরনের সময় অনেক প্রগতিশীল আচরণ করে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে পুজিতন্ত্রে উত্তরনের সময় সে বহন করে নিয়ে আসলো সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্বের বানী। নারীর ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হলনা- চিরঅবহেলিত নারী পেয়ে বসলো ভোটাধিকার ও শিক্ষাগ্রহনের অধিকারসহ আরো বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার যা ইতিপূর্বে তাদের ছিলনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশের সমস্ত পুরুষরা যখন বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে ব্যাস্ত তখন দেশের অভ্যন্তরে সমরাস্ত্র ও বিভিন্ন ধরনের কল-কারখানা চালু রাখার প্রয়োজনে পুরুষ নারীকে ঘরের চার দেয়ালের ভেতর থেকেও বের করে আনলো। চার দেয়ালের ভেতরে বন্দী অভিশপ্ত নারী যেন তবুও কিছুটা মুক্তি পেল। কিন্তু বুর্জোয়াশাসিত পুঁজিবাদী সমাজ যখন মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যবাদের করালগ্রাসের শিকার হল তখন পুঁজিপতিরা নিজেদের বাজার ধরে রাখার খাতিরে মেহনতীদের দাম না দেয়া শ্রম শোষন করে নানা ধরনের প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় পন্যের মাত্রারিক্ত সম্ভার যেমন গড়ে তুলল তেমনি সামাজিক মুল্যবোধ, নৈতিকতা, মানবিকতা, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, এমনকি মানুষকে পর্যন্ত পন্যে পরিনত করে তুলতে চাইলো। মানুষকে পন্যে পরিনত করার ষড়যন্ত্রে পুঁজিবাদ ও পুরুষতান্ত্রিকতার যোগসাজসে নারী পরিনত হল সবচেয়ে বড় বলীতে। ধীরে ধীরে তারা নারীকে এমন একটি পন্যে পরিনত করল যে নারী নামক পন্যের ব্যাবহার ব্যাতীত এরোপ্লেনের পাখা থেকে শুরু করে সামান্য সূচ পর্যন্ত কোন পন্যেরই বাজারজাতকরন সম্ভব হয়না। নারী পরিনত হল সবচেয়ে বড় এবং লোভনীয় ভোগ্যপন্যতে। শুধুমাত্র তার শারীরিক যৌন অস্তিত্ব ছাড়া অন্য সকল কিছুকে অস্বীকার করে বসল, প্রথম দিকে নারীর জন্য বিভিন্ন অধিকারের ফুলঝুরি হাতে নিয়ে আসা এই পুঁজিবাদ।

প্রত্যেকটি সমাজেরই থাকে একটি বনিয়াদ এবং একটি উপরি কাঠামো। এই উপরিকাঠামো সবসময় বনিয়াদের প্রতিষঙ্গী হয়ে থাকে। বনিয়াদ অনুসারে উপরিকাঠামো সবসময় পরিবর্তিত হয়। আবার এই উপরিকাঠামোর সজ্ঞান লক্ষ্য অর্জনের বিষয়বস্তু হিসেবেও বনিয়াদকে পরিবর্তিত করা যায়। মানুষের সাথে মানুষের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ধরনটি হল সমাজের বনিয়াদ এবং সকল ধরনের মননমূলক কাজ- শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃত হল সমাজের উপরিকাঠামো হিসেবে পরিজ্ঞাত। গোষ্ঠীভিত্তিক আদিম কৌমসমাজ বাদে ইতিহাসের অন্যকোন কালপর্বেই উৎপাদনের উপায়ের উপর নারীর কোন ধরনের শরিকানা ছিলনা বিধায় নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি যেমন ঘটেনি তেমনি আবশ্যিকভাবেই সমাজের অভ্যন্তরে জন্ম হয় পুরুষতন্ত্রের। ফলে পুরুষতন্ত্রের আয়োজনে চলতে থাকে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি তথা সকল ধরনের মননমূলক কাজ। উৎপাদনের সকল উপায়ের মালিক যেহেতু পুরুষ- পুরুষের শৌর্য-বীর্য, বীরত্ব, প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে রচিত হতে থাকলো- কথা-কাহিনী, কাব্য-সঙ্গীত, চিত্রকলা আর ওদিকে কেবলমাত্র নারীর শরীরের নন্দনতাত্ত্বিক সৌন্দর্য ও তার আবেদনময়ীতার স্থান কেবল নিশ্চিত হল মানুষের সকল মননমূলক কাজে। নারী যে শুধু একটা শরীর এমন প্রত্যয় তৈরী হয়ে গেল মানুষের মনে। এই পুঁজিতান্ত্রিক সমাজেও নারীকে পন্যে পরিনত করার ষড়যন্ত্রে এখনও প্রায় সকলধরনের মননমূলক কাজে নারীকে শুধুমাত্র শরীর হিসেবে দেখানোর প্রয়াস চলছে।

নারী পুরুষের চেয়ে শারীরিক মানসিকভাবে দূর্বল এই রকম একটি আজগুবী অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও প্রকৃতির দোহাই দিয়ে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা শ্রমবিভাগ তৈরী করেছে পুরুষতন্ত্র। এই প্রবন্ধে পূর্বে এই শ্রম বিভাগটির কথা উল্লিখিত হয়েছে। নারীর উপর যে সমস্ত কাজের দায়িত্ব পড়েছে সেই কাজগুলোতে নারী তার যথাসাধ্য শ্রম দিলেও শ্রমের কোন ধরনের মূল্য সে পায় না। কৃষিক্ষেত্রের কথা যদি ধরা যায় তাহলে বলতে হয়- কৃষিতে মোট শ্রমের প্রায় সত্তর শতাংশ আসে নারীর নিকট থেকে। কৃষিতে পুরুষের কাজ হচ্ছে শুধু জমি চাষ, ফসলবোনা, ফসল কাটা এবং সেগুলো বাড়িতে বয়ে নিয়ে আসে। বর্তমানে এই কাজগুলো প্রযুক্তি তার নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। এখন আগেকার মত পুরুষকে এসমস্ত কাজে উদয়াস্ত খাটতে হয়না। ফসল কাটার পর বাড়িতে আসার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় নারীর কাজের পালা, পুরুষ তখন ঘরের দেউড়িতে বসে বসে ধূমপান ও খোশগল্পে মশগুল থাকে। অবশ্য এসময় তাকে বাজারে ফসলের দামের উঠা-নামার বিষয়ে চিন্তিত থাকতে দেখা যায়। কারন ফসল বিক্রির যে টাকা তার একমাত্র অংশীদার ঐ পুরুষ কৃষকটি। নারী কৃষক ফসল মাড়াই, ফসল শুকানো, সিদ্ধ করা, গোলায় তোলা-ফসল প্রক্রিয়াজাতকরনের বিশাল কর্মযজ্ঞে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে আবার বাড়ীর রান্না-বান্না, কাপড় কাচা, ঘর ঝাট দেওয়া ইত্যাদি বহু গৃহস্থ কর্মও থেকে এ সময়েও নিস্তার পায়না। ফসল প্রক্রিয়াজাতকরনের এই কর্মযজ্ঞের শুরু অবশ্য ফসল কাটার বহু পূর্ব থেকেই শুরু হয়- উঠানের খানা-খন্দক মাটি দিয়ে ভর্তি করা, ফসল শুকানোর সময় হঠাৎ করে বৃষ্টি এসে পড়লে যাতে উঠানের মাঝখানে স্তুপ করে রাখতে পারে এবং বৃষ্টির পানি যাতে গড়িয়ে নিচের দিকে চলে যায় সেজন্য উঠানটিকে বর্তুলাকার করে তোলা- এই কাজটি খুব কঠিন একটা কাজ হলেও পুরুষের সহযোগীতে খুব একটা পাওয়া যায়না। সবশেষে ফসল প্রক্রিয়াজাতকরনে উঠানটিকে প্রস্তুত করে তোলার জন্য গোবর ও মাটি দিয়ে নিকানো। প্রযুক্তিও যেন অনেকটা পুরুষতান্ত্রিক হয়ে পড়েছে- ফসল প্রক্রিয়াজাতকরনের কাজ এখনো সে নিজের কাধে তুলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করনি। দেশের প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে দেখা যায় ফসল বোনা ও ফসল কাটার কাজটিও নারী কৃষক পুরুষ কৃষকের সাথে কাঁধ মিলিয়ে করে থাকে। কৃষিতে এত পরিশ্রম করার পরও ফসলে তার সামান্য মালিকানাও জোটেনা। বরঞ্চ ফসল প্রক্রিয়াজাত করনের সময় নারী কৃষক যদি ফেরীওয়ালার নিকট থেকে সামান্য ফসলের বিনিময়ে যদি কিছু দ্রব্য-সামগ্রী ক্রয় করে তাহলে তার ভাগ্যে জোটে চোরের অপবাদ। কৃষিতে এত পরিশ্রম করে নিজের কৃষক পরিচয়টিও নারী পায়না। আমরা যখন একটা কৃষকের মুখ কল্পনা করি তখন গাল ভাঙ্গা, মুখে মেছতা পরা, উস্কো-খুস্কো চুলের লুঙ্গি পড়া একজন পুরুষের ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে- কোন নারীর মুখ নয়।

পুরুষ যখন হোটেল-রেস্টুরেন্টে রান্না-বান্না, লন্ড্রিতে কাপড় কাচা-ইস্ত্রি করা, অফিস-আদালত ভবন ঝাট দেওয়ার কাজ করে তখন তাকে পারিশ্রমিক দিতে হয়। কিন্তু নারী সারাজীবন ধরে এই কাজ করে কোন ধরনের পারিশ্রমিক তো দূরের কথা বিনিময়ে পায় নানা ধরনের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা এবং শিকার হয় নানা ধরনের সহিংসতার। বর্তমানে আমাদের দেশ সহ কয়েকট উন্নয়নশীল দেশে দেখা যাচ্ছে বস্ত্র শিল্প ও অন্যান্য কলকারখানাগুলোতে শ্রমিক হিসেবে নারীর অংশগ্রহন খুব দ্রুত বাড়ছে। এটা নারীর অর্থনৈতিকমুক্তির ক্ষেত্রে একধরনের আশাপ্রদ ব্যাপার হলেও একটু ভেতরের দিকে নজর দিলে দেখা যায় বর্তমান শ্রম বাজারে নারীর শ্রমের মূল্য পুরুষের শ্রমের মুল্যের চেয়ে কম হওয়ার কারনে আরো বেশী করে শ্রমিকের দাম না দেয়া শ্রম শোষনের লোভে কারখানার মালিকরা আরো বেশী শ্রম শোষনের আশায় নারী শ্রমিকের দিকে অত্যাধিক পরিমানে ঝুকে পড়েছে।

আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বহু পূর্ব থেকেই নারী-পুরুষের পারস্পারিক যৌনাচরনের ক্ষেত্রে একটি ধারনা তৈরী হয়ে আছে। সেই ধারনায় পুরুষ হচ্ছে ভোগকারী এবং নারী হচ্ছে পুরুষের ভোগের বা কামনার বস্তু। হাজার বছরের নারী-পুরুষের পারস্পারিক যৌনাচরনের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে নারীও যেন এই প্রত্যয়টি অনেকাংশে মেনে নিয়েছে। এর ফলেই আমাদের দেশে নারীর প্রতি পুরুষের যৌন সহিংসতা মাত্রারিক্ত পরিমানে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু এখানে ভোগকারী বা ভোগের বস্তু ধারনাটির কোনধরনের জীববৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এবং তা সর্বৈব মিথ্যা। আসলে নারী-পুরুষের তাদের প্রনয়ঘটিত স্বাভাবিক যৌনমিলনে নিজ নিজ যৌন-প্রক্রিয়ায় শারীরিক-মানসিক তৃপ্তি লাভ করে। পুরুষ নারীকে পদানত এবং তার যৌন মিলনে ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোম মূল্য না দিয়ে তার যথেচ্ছ ভোগের পশুধরনের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্যেই এই ভোগকারী এবং ভোগেরবস্তু ধারনাটি গড়ে তুলেছে। এই ধারনাটি গড়ে তুলতে পুরুষের তৈরী ধর্ম যে সবচেয়ে বেশী সহায়তা যোগাবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

হাজার বছরের পথ চলায় নারী-পুরুষ বৈষম্য এবং ফলত পুরুষতন্ত্র একটি শক্তিশালী আকার লাভ করেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আপাত ভদ্র মুখোশের আড়ালে অনেক পুরুষের মনেই এই নারীর প্রতি সহিংসতার প্রবৃত্তি লুকিয়ে থাকে। উপযুক্ত সময় সুযোগ পেলেই তা উলঙ্গ ভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। আমাদের সমাজে এমন নারী খুব কম আছে যে তার বেড়ে উঠার বা বয়সের কোন না কোন স্তরে সহিংসতার শিকার হয়নি। পরিবার, ঘর, বেডরুম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত মোট কথা এমন কোন জায়গা নেই যেখানে নারী সহিংসতার শিকার হয়না। স্বামী, প্রেমিকা, শিক্ষক, সহপাঠী, কার্যক্ষেত্রর সহকর্মী, চাচাতো-ফুফাতো-মামাতো ভাই, নিকট-দূর বিভিন্ন সম্পর্কের আত্মীয়, পাড়ার-রাস্তার বখাটে ছেলেরা- মোটকথা এমন কোন পুরুষ নেই যার দ্বারা একজন নারী নানা ধরনের সহিংসতার শিকার প্রতিনিয়ত না হয়।

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে সমাজ থেকে পুরুষতন্ত্রকে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। দূর করতে হবে নারী-পুরুষের সকল ধরনের বৈষম্য। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, উৎপাদনের উপায়ে নারীর শরীকানা নিশ্চিত করা, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য মূলক শ্রম বিভাজন ও শ্রম মূল্য সংক্রান্ত অসাম্য দূরীকরনের মধ্য দিয়েই নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি যেমন ঘটবে তেমনি কমে আসবে নারী-পুরুষের অন্যান্য সকল ধরনের সামাজিক ও যৌনাচরন সংক্রান্ত বৈষম্য এবং নারীকে পুরুষের চেয়ে হীন ভাবার মনোভাব। শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীর সজ্ঞান প্রয়াসের ফলে সকল ধরনের মননশীল কাজে নারীর মানসিক অস্তিত্ত্ব এবং অন্যান্য সকল ধরনের মানবিক সামর্থ্যের কথা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ধীরে ধীরে দূর হতে থাকবে মানুষের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর সকল ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। তখনই কেবলমাত্র নারীর প্রতি পুরুষের সহিংসতা দূর করা সম্ভব হবে।