চরাক্ষেত এখন কৃষকের মৃত্যুফাঁদ

মেহেদী হাসান
Published : 12 April 2018, 12:12 PM
Updated : 12 April 2018, 12:12 PM

প্রতিটি খাদ্যকণার জন্য আমরা কৃষকের কাছে ঋণী। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের জন্য ফসল ফলায়। অথচ মধ্যসত্ত্বভোগীদের কারনে ফসলের নায্য দাম পায় না কৃষক। যার ফলে তাকে সবসময় অভাব-অনটনের মধ্যে থাকতে হয়।

কৃষক শব্দটি উচ্চারিত হলেই আমাদের মনে উস্কুখুস্কু চুল, কোটরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া ঘোলাটে চোখ, ভাঙ্গা গাল ও কঙ্কালসার দেহের অবয়ব ভেসে উঠে। সমস্ত জাতির খাদ্য উৎপাদনের দায়িত্ব যাদের কাঁধে তারা কোন রকমে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচেবর্তে থাকে।

তবে বর্তমান সময়ে সেই কঙ্কালসার দেহ ও ঘোলাটে চোখের স্বত্বাধিকারী কৃষকের বাঁচার উপায়ও আর থাকছে না। বিদ্যুতখাতের কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ও গ্রামের কিছু অসৎ লোকের যোগসাজশে ইরি ধানের মৌসুমে চরাক্ষেতগুলো পরিণত হয় কৃষকের মৃত্যুফাঁদে।

হালকা বাঁশের খুঁটিতে প্লাস্টিকের আবরণহীন তারে ছেয়ে গেছে পাকুটিয়া চরাক্ষেত

কৃষকের জন্য পেতে রাখা মৃত্যুফাঁদ

পাকুটিয়া চরাক্ষেতে ঝুলছে প্লাস্টিকের আবরণহীন হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তার

গ্রামের দুর্নীতিপরায়ণ কিছু লোক বিদ্যুৎ সরবরাহের নাম করে প্রতিটা পরিবারের নিকট থেকে তিনচার হাজার করে টাকা উঠায়। আর সেচ প্রকল্পের মালিকদের কাছ থেকে নেয়া হয় আটদশ হাজার করে টাকা। তারপর সেই টাকা গ্রামের কতিপয় অসাধু ব্যক্তি, স্থানীয় বিদ্যুত অফিসের কিছু অসৎ কর্মকর্তা, আর গুটিকয়েক দালাল শ্রেণির লোক নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়।

বিদ্যুৎ সরবরাহের নাম করে গ্রামের কৃষকমজুরদের কাছ থেকে টাকা তোলার এই প্রক্রিয়া পুরোপুরি অবৈধ। এভাবে টাকা তোলার কোন আইন বা নিয়ম বাংলাদেশে আছে বলে আমার জানা নেই। তবে কোন উপায়ান্তর না দেখে বিদ্যুৎ সরবরাহের নামে টাকা তোলার এই অবৈধ প্রক্রিয়া গ্রামের মানুষ খুব স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছে। তারা শুধু চায় বিদ্যুৎ সরবরাহ হবে উন্নত মানের এবং নিরাপদ।

যাহোক, গ্রামের জনসাধারণের কাছ থেকে শুধু যে একবারই টাকা তোলা হয় তা নয়। কয়েক বছর অন্তর অন্তর গ্রামের বিদ্যুৎ সরবরাহে সামান্য বিপত্তি দেখা দিলেই নতুন ট্রান্সফরমার আনা এবং নতুন করে বিদ্যুৎ সরবরাহের নামে পুনরায় টাকা তোলা হয়। টাকা তোলার সময় গ্রামবাসীদেরকে বলা হয় প্লাস্টিকের আবরণযুক্ত বৈদ্যুতিক তার এবং সিমেন্টের খুঁটির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে। তবে নতুন করে যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তখন দেখা যায়, পুরাতন ট্রান্সফরমার, বাঁশের খুঁটি আর প্লাস্টিকের আবরণহীন নিম্ন মানের বৈদ্যুতিক তার।

কাদা ক্ষেতের মধ্যে গেড়ে রাখা হালকা বাঁশের খুঁটির মাথায় কোন রকমে লাগিয়ে রাখা হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারে পুরো চরা ক্ষেত ছেয়ে যায়। আর যে সামান্য কয়েকটা সিমেন্টের খুঁটি থাকে সেগুলোতেও প্লাস্টিকের আবরনহীন নিম্ন মানের বৈদ্যুতিক তার খুব হালকাভাবে লাগানো থাকে। এই কাল বৈশাখী ঝড়ের সময়ে সামান্য বাতাসের ঝাপটাতেই নড়বড়ে বাঁশের খুঁটি প্লাস্টিকের আবরণহীন হাইভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তার সহ নীচে পড়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। শুধু তাই নয় সিমেন্টের খুঁটিতে কোন রকমে লাগিয়ে রাখা হাই ভোল্টেজের প্লাস্টিকের আবরণহীন বৈদ্যুতিক তারও ছিড়ে নীচে পড়ে যায় খুব সহজেই।

এর মাঝে খানিকটা উঁচু হয়ে উঠা ধান গাছের ভেতরে বিষাক্ত সাপের মত ঘাপটি মেরে থাকা হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তার মেরামত করার উদ্যোগ নেয় না কেউ। স্থানীয় বিদ্যুত অফিস ও গ্রামের সেই অসৎ ব্যক্তিদের (যারা টাকা তুলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে) সকলেই এই ব্যাপারে থাকে পুরোপুরি উদাসীন। এই সব কিছুর ফলে পুরো চরাক্ষেত পরিণত হয় কৃষকমজুরদের মৃত্যুফাঁদে।

হালকা বাতাসের ঝাঁপটায় চরাক্ষেতে পড়ে থাকা হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারে স্পৃষ্ট হয়ে নিজের ক্ষেতের আলে মুখথুবড়ে পড়ে থাকে কৃষকের নিথর দেহ! যতক্ষণ পর্যন্ত না খোঁজ মেলে লাশের ভেতর দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে প্রবাহিত হয় হাই ভোল্টেজের বিদ্যুৎ।

উপরে যে চিত্র বর্ণিত হল তা বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামের সাথে কোন না কোনভাবে বা কিছু না কিছু অংশ মিলে যায় বলেই আমার বিশ্বাস। তবে চিত্রটি পুরোপুরি মিলে যায় টাংগাইল জেলার ঘাটাইল থানার ৭ নং দিগড় ইউনিয়নের পাকুটিয়া নামক একটা ছোট্ট ঠাসবুনট গ্রামের সাথে।

এই ছিঁড়ে পড়া প্লাস্টিকের আবরণহীন হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারে স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় সুমনের ফুলজান বেগম।

বাঁশের খুঁটিতে লাগানো প্লাস্টিকের আরণহীন হাইভোল্টেজের তারে সেচ প্রকল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ।

সিমেন্টের খুঁটিতে হালকাভাবে লাগিয়ে রাখা অত্যাধিক উচ্চ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তার। ছিড়ে পড়া এরকম একটা তারেই বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়া দুই পাকুটিয়া গ্রামের ফুলজান বেগম।

গোলাম মোস্তফা আর আজমত আলী ওরফে পাঙ্গাশ(পরস্পরের চাচাত ভাই)- এই দুই দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির নেতৃত্বে এইবার ইরি ধানের চারা রোপণ শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে নতুনভাবে বিদ্যুত সরবরাহের নামে গ্রামের প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে তিনহাজার করে টাকা তোলা হয়। আর সেচ প্রকল্পের মালিকদের কাছ থেকে নেয়া হয় সাতআট হাজার করে টাকা। সকলকে বলা হয় এবার বিদ্যুৎ সরবরাহ হবে সিমেন্টের খুঁটি আর প্লাস্টিকের আবরণ যুক্ত তারের সাহায্যে। তবে নতুন করে বিদ্যুৎ সরবরাহের পর দেখা যায় সমান্য কয়েকটা সিমেন্টের খুঁটি আর সামান্য কয়েক জায়গায় প্লাস্টিকের আবরণযুক্ত তার বাদে চরা ক্ষেতের সর্বত্র বাঁশের খুঁটিতে লাগানো হাইভোল্টেজের প্লাস্টিকের আবরণহীন বৈদ্যুতিক তার। সেচ প্রকল্পের মালিকরা সিমেন্টের খুঁটি দাবী করলে প্রত্যেক খুঁটি বাবদ অতিরিক্ত ১০ হাজার করে টাকা চাওয়া হয়। যার ফলে সেচ প্রকল্পের মালিকরা তাদের দাবী থেকে খুব সহজেই সরে আসে।

এখন মূল কথায় আসিবিগত ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে সামান্য ঝড়ে সিমেন্টের খুঁটির সাথে লাগানো হাইভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তার শফিকুল ইসলাম শফির সেচ প্রকল্পের (মেশিন ঘর) নিকটে ছিঁড়ে নীচে পড়ে যায়। স্থানীয় (ওয়াপদা)বিদ্যুৎ অফিস, গ্রামের দুই অসাধু ব্যক্তি গোলাম মোস্তফা আর আজমত আলী ওরফে পাঙ্গাশ – এরা সকলেই ছিঁড়ে পড়ে থাকা তারের প্রতি থাকে পুরোপুরি উদাসীন। কোন পক্ষ থেকেই মেরামতের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নি। যদিও গ্রামের বেশ কয়েকজন শঙ্কিত হয়ে শফিকুল ইসলামকে ছিড়ে পড়ে থাকা তার মেরামত করার তাগাদা দেয়। তারটি সাথে সাথে বা এমনকি দুই দিন পরও যদি মেরামত করা হত তাহলে নিচে যে ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিব তা ঘটত না।

২৫ মার্চ রাতের ঝড়ে বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে পরে যাওয়ার ঘটনার তিনদিন পর ২৮ মার্চ সকাল দশটার সময় ফুলজান বেগম (বয়স আনুমানিক ৪৮ বছর) তাদের নিজেদের ধান ক্ষেত দেখতে চরাক্ষেতের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। ধান গাছ বেশ উঁচু হয়ে উঠায় ছিড়ে পড়া হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারটি কোথায় লুকিয়ে আছে বা তারটি মাটি স্পর্শ করার জায়গা থেকে কোন পর্যন্ত বিস্তার করে আছে তা জানা সেই গ্রাম্য কিষাণীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। যাহোক, দুই সন্তানের জননী ফুলজান বেগম আর পায়ে হেঁটে নিজের বাড়িতে ফেরত যেতে পারেনি। নিজেদের ধান ক্ষেতের অত্যন্ত সরু আল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বৈদ্যুতিক তারটি প্রথমে পায়ে লাগলে প্রচন্ড শক খেয়ে মহিলাটি তারের উপরেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। আনুমানিক সারে দশটা থেকে এগারটার মধ্যে তার মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে বলে গ্রামের মানুষের ধারণা।

প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ধরে বিদ্যুত প্রবাহিত হয়ে পুরো শরীর ঝলসে যাওয়া লাশ খুঁজে পাওয়া যায় বিকেল তিনটার দিকে। শরীরে যে সমস্ত জায়গায় বৈদ্যুতিক তারের সরাসরি স্পর্শ ছিল সে সমস্ত জায়গার মাংশ পুড়ে হাড় বের হয়ে যায়।

স্থানীয় ওয়াপদা অফিস (কালিহাতী, টাঙ্গাইল) এবং গ্রামের দুই অসৎ ব্যক্তি গোলাম মোস্তফা আর আজমত আলী ওরফে পাঙ্গাশের দুর্নীতি, অবহেলা আর গাফিলতি কারনে এই মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে। এটাকে শুধু মৃত্যু বললে ভুল বলা হবে। এটা দুর্নীতি, অবহেলা আর গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড।

এখানেই শেষ নয়। গোলাম মোস্তফা, আজমত আলী ও তাদের গুটিকতক সাঙ্গপাঙ্গ মিলে গ্রামের কয়েকজন চেতনাসম্পন্ন শিক্ষিত তরুণদের কয়েকদিন ঘর থেকে বের হতে দেয় নি পাছে তারা এই অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খোলে। বাড়িতে এসে পর্যন্ত তাদেরকে শাসিয়ে যাওয়া হয়েছে এই বলে যে, এই বিষয় নিয়ে কোন কথা বললে তাদেরকে পেটানো হবে। গ্রামের এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে এই ঘটনায় শোক ও মৃতার ছেলের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে সামান্য প্রতিবাদের সুরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে ঐ ছেলের পরিবারকে হুমকি দিয়ে সেই স্ট্যাটাস মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়।

গ্রামের সেই অসাধু ব্যক্তিদ্বয় মৃতের পরিবারকেও দিয়ে চলেছে নানা রকম হুমকিধামকি যাতে এই ঘটনা নিয়ে কোন মামলা না হয়। "আপনাদের অবহেলার কারনেই তো আমার মা মারা গেছে" এই কথা বলায় তাদের বাড়িতেই শত শত মানুষের সামনে মৃতার মেয়ে খাদিজা আক্তার( বয়স আনুমানিক ২৮ বছর) এর দিকে মারমুখী ভঙ্গীতে তেড়ে আসে আজমত আলী ওরফে পাঙ্গাশ। একই ধরনের কথা বলাতে মৃতার ছেলে সুমনের ( বয়স আনুমানিক ২৫ বছর) দিকেও গ্রামের পাশে নদীর পাড়ে একই মারমুখী ভঙ্গীতে তেড়ে আসে সেই একই পাঙ্গাশ। ওদের ভয়ে গ্রামের সাধারন মানুষ এই বিষয়ে একটা কথা পর্যন্ত উচ্চারণ করছে না।

এখন আবার যেটা শুরু করেছে তা হল: গ্রামের শিক্ষিত তরুণদেরকে ধর্মবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে এই দুর্নীতিবাজ ও তাদের ভাতিজারা মিলে ফেসবুকে অশ্লীল ভাষায় স্ট্যাটাস দিয়ে পেটানোর হুমকি দেয়া হচ্ছে।  এখানে ফেসবুকে হুমকি দেওয়া স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট তুলে দেয়া হল।

বেশ কয়েক বছর আগেও একই গ্রামের খাজা নামের এক লোক চরা ক্ষেতে বাঁশের খুঁটি থেকে পড়ে যাওয়া প্লাস্টিকের আবরণহীন হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারে স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়।

এখন প্রশ্ন হল, কৃষক-কৃষাণী কেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিজের ক্ষেতের আলে মুখ থুবড়ে মরে পড়ে থাকবে? যাদের দুর্নীতি, গাফিলতি আর অবহেলার কারনে চরাক্ষেত পরিণত হয় মৃত্যুফাঁদে তাদেরকে কেন আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে না?