নির্বাচনী অপসংস্কৃতি

মেহেদী হাসান
Published : 16 Jan 2012, 02:47 AM
Updated : 16 Jan 2012, 02:47 AM

যুক্তফ্রন্ট ও ১৯৭০সালের সাধারন নির্বাচনের সময় আমরা দেখেছি যে , বাংলাদেশের জনগন স্বতস্ফুর্ত ভাবে, অপশাসন , দুঃশাসন ,শোষণ , অন্যায়- অত্যাচার , অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে।

নির্বাচন চলাকালীন সময়ে, রাজনৈতিক দলগুলোকে, ভোটারদের মনঃজয় করার মানসে ;চা, সিগারেট, শাড়ী , লুঙ্গি , সাবান, গামছা , চানাচুর , বিস্কিট এবং নগদ টাকা বিতরন করার প্রয়োজন পড়েনি । তারা যে শোষনের বিপক্ষ শক্তি এটার প্রমানই ভোটারদের সিদ্ধান্ত তৈরীর জন্য যথেষ্ট হয়েছে । তৎকালীন বাংলাদেশের জনগন ,তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে , জালিমের জুলুমের বিরুদ্ধে ,অত্যাচারীর তলোয়ারের বিরুদ্ধে ,সর্বোপরি নিজেদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে । তখনকার মানুষ নিজেদের আত্মজ অধিকার সমন্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ছিল বিধায় এমনটা হতে পেরেছে ।

আর নিজেদের ভোটাধিকারের সুচিন্তিত প্রয়োগ করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি ; নিজেদের রাষ্ট্রনৈতিক ,সামাজিক ,সাংস্কৃতিকও ভাষার অধিকার সম্পুর্ণ আদায়ের লক্ষ্যে , ৫২ এর ভাষা আন্দোলন , ৬৬ এর শিক্ষা আন্দোলন , ৬৯ এর গণ অভ্যূথ্যান এবং সবচেয়ে বড় কথা ৭১ এ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মরনপণ যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ্ শহীদ ও ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে ,স্বাধীন দেশ হিসেবে , বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে ।

এখন আসি বর্তমান প্রেক্ষাপট আলোচনায় । তার পূর্বে বলে নেওয়া ভাল তখন শোষিত হতাম পশ্চিম পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠী দ্বারা আর এখন এখন শোষিতত হচ্ছি আমাদের নিজেদের মহৎ ,মহান, উচ্চশির বাঙ্গালী শাসকদের দ্বারা ! সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ,আমরা সাধারন জনগন এদের দ্বারা দিনের পর দিন শোষিত ,অত্যাচারিত , নিপীড়িত ও নির্যাতিত হচ্ছি এবং বিনিময়ে এদের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছি , মাথায় করে নাচ্ছি , সর্বদা কোলের উপর বসিয়ে রেখেছি , পায়ের কাছে অতি প্রভুভক্ত কুকুরের মত বসে আছি নড়ার নাম নেই , এদের নামে স্লোগান দিয়ে গলা ফাটাচ্ছি ,ওদের তীক্ষ্ণ চাবুকের সামনে পিঠ ও পাছা পেতে দিচ্ছি আর ওরা চাবুক মারার পর কোমল , সুন্দর ও প্রচন্ড রকমের যৌন আবেদনময়ী হাতে ; ছেড়া ফাড়া পিঠে ও পাছায় ধীরে ধীরে লবন মাখিয়ে দিচ্ছে , আমরা বিনয়ে গলে গলে যাচ্ছি আর এমন সময়ে তাদের শুভ্র ,সুডৌল নরম স্তনের মৃদু ছোয়া শরীরে অনুভব করে শিহরনে ,পুলকে ঝাকি দিয়ে উঠছি বারংবার এবং তাদের প্রতি লেখা প্রেম পত্রে ব্যালট বাক্স ভরিয়ে ফেলছি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর ।

কেন এমন হচ্ছে , এই প্রশ্নের জবাব কী? কিভাবে, কখন থেকে বাঙালি এরকম যৌন সুখ পেতে শুরু করল? আমার মনে হয়, বাঙালি যখন থেকে তাদের নিজস্ব অধিকার বোধ হারিয়ে ফেলে , ফাও খাওয়ার দিকে তাদের মনঃযোগকে অধিকতর প্রশস্ত করেছে ,তারপর থেকেই তারা বিকৃত যৌনসুখ অধিকতর হারে পেতে শুরু করেছে । তার যেন বুঝতে পেরেছে , অধিকার আদায় করা আর হয়ে উঠবেনা , সুতরাং যত বেশী পারা যায় মাখনের মত নরম স্তনে ,তলপেটে হাত বুলিয়ে নেই ।

বর্তমানে যে সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে , সেগুলোর দিকে চোখ বুলালে বিষয়টা কিছুটা স্পষ্ট হয় । এসব নির্বাচনে দেখা যায় ,কোন পার্থী বা দল যদি ভোটারদের মাঝে , শাড়ী ,লুঙ্গি , গামছা , সাবান , চানাচুর ,আরো বিভিন্ন ধরনের পন্য সামগ্রী এবং নগদ টাকা যথেষ্ট পরিমানে বিতরন করতে পারটাই ভোটারদের মন জয় করার জন্য যথেষ্ট । ফলে নির্বাচনের সময় প্রার্থী বা দল ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়ে ভোটারদের মাঝে এসব দ্রব্য সামগ্রী এবং নগদ টাকা বিতরন করার কাজে । নির্বাচন বলতে আমরা এখন এসমস্ত কর্মকান্ডকেই বুঝি ।

আর আমাদের স্বাধীন ,নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন , একটি নির্বাচনী ব্যায়সীমা নির্ধারন করে দিয়েই খালাশ ; নির্বাচনী ব্যয় সীমার মধ্যে রাখার কোন প্রচেষ্টাই তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না । ফলে দেখা যায় প্রার্থী এবং দলগুলো ভোটারদেরকে নিজেদের দিকে টানার জন্য লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টকা ব্যয় করে । এবং এটি বর্তমানে সবচেয়ে লাভজনক ব্যাবসায় পরিনত হয়েছে । টাকা থাকলে যে কেউ এই ব্যাবসায় পুঁজি খাটাতে পারে । এটার নাম দেয়া যেতে পারে 'রাজনৈতিক ব্যাবসা ' ।

সকল ধরনের ব্যাবসাতেই ক্ষতি যাওয়ার কম বেশী ঝুঁকি থাকে কিন্তু এই রাজনৈতিক ব্যাবসায় এরকম কোন সম্ভাবনা মোটেই নেই । এ ব্যবসায় , প্রার্থী বা দল ; নির্বাচনের সময় টাকা লগ্নি করে এবং নির্বাচিত হওয়ার পর ,লগ্নি কৃত টাকার পরিমানের দশ-বিশ গুন হাতিয়ে নেয় । আর কেউ যদি নির্বাচনে হেরে যায় তাতেও কোন সমস্যা নেই কারন চার-পাচবার প্রতিদন্ধিতা করার পর একবারও যদি নির্বাচিত হতে পারে তাহলে ও সে বিগত নির্বাচনগুলোতে যে পরিমান টাকা লগ্নি করেছে তা সুদে-আসলে তুলে নিতে পারে । আর তিন-চারটি নির্বাচনে ঠিকমত টাকা লগ্নি করতে পারলে সবচেয়ে কম করে হলেও অন্তত একটি নির্বাচনে জিতবেই জিতবে । সুতরাং কোন সমস্যা নেই । প্রার্থী যদি মাথায় এক শিং ওয়ালা , মোটা চামড়ার গন্ডারও হয় এবং দলটি যদি কচু খাওয়া শুয়োরের পালও হয় তাতেও কোন সমস্যা নেই । আর এই ব্যাবসায় লাভের পাশাপাশি এই দলেরা পায় গনপ্রজাতন্ত্রী বাঙ্গলাদেশের এক কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের সন্মানিত সদস্য পদ এবং মাঝে মাঝে মন্ত্রীত্বের স্বাদ ।

আর এই সু্যোগে রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়ন বিক্রির বড় ধরনের ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয় । এবং নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর যেকোন একটি নির্বাচিত হয়ে পর সরকার গঠনের পর তার নিজ দলীয় গন্ডার সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীদের জন্য দুর্নীতি ,লুটপাট ও কামড়া কামড়ির ঝাপি খুলে দেয় এবং তার থেকে একটা পারসেন্টেন্স নিজের জন্য রেখে দেয় তাদের পুরুষাঙ্গকে মোটা তাজা করার জন্য।

এখন আসি, জনগনের কথায় । তার পূর্বে একটি গল্প বলে নেই; আমাদের এলাকায় একবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় , একজন চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোটারদের মাঝখানে গমছা বিতরন করে এবং নির্বাচনী ওয়াদা হিসেবে বলে , সে নির্বাচিত হতে পারলে , এলাকার লোকজনের চলাচলের সুবিধার জন্য এলাকার মাঝের নদিটির উপরে একটি সেতু নির্মান করে দিবে । এবং যথারীতি ঐ প্রার্থী নির্বাচনে জয় লাভ করে । প্রথম, দ্বিতীয় ,তৃতীয় –এভাবে চারটি বছর কেটে গেল; কিন্তু নদীর উপর দিয়ে আর সেতু নির্মিত হয়না । তখন এলাকার কিছু মানুষ চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে দেখা করতে গেল , তার নির্বাচনী ওয়াদা স্মরন করিয়ে দিত।

তখন চেয়ারম্যান সাহেব তাদেরকে লক্ষ্য করে বলে , আমি নির্বাচনের সময় তোমাদের প্রত্যেককে একটি করে গামছা দিয়েছিলাম মনে পড়ে? লোকগুলো বলে, হ্যা ।

তখন চেয়ারম্যান সাহেব বলে ,তোমাদেরকে গামছা দিয়েছিলাম নদী পার হওয়ার জন্য ,মাথায় বেধে রাখার জন্য নয়, ঐ গামছা পরে নদী পার হবে ; নদীর উপর সেতু নির্মান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।

এই গল্পের সত্যতা আমার চেয়ে আপনারা ভাল আঁচ করতে পারবেন বলে মনে হয় ।

প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজের দিকে তাকালে , দেশের যে চিত্র দেখতে পাওয়া যায় , সে চিত্র বর্ণনা করে অযথা লেখার কলেবর বৃদ্ধি করবনা । সে চিত্র আপনাদের চেয়ে ভাল বোধ হয় আর কেউ জানেনা । অথচ জনগনের ভেতর প্রতিবাদের কোন ধরনের চিহ্নই দেখা যাচ্ছেনা না । জনগন সম্ভবত অতি মানব হয়ে গেছে , শুধুমাত্র যৌন অনুভূতি বাদে অন্য সকল অনুভূতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এ অনুভূতি তাও আবার পাঁচ বছর পর পর জাগে। তখন তার মুখে বুলি ফোটে, পুরোদেশ মুখরিত করে তোলে; এবং বলতে থাকে কই আমরা তো এখনও বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী এবং নগদ টাকার নাভীমূল রমন করতে পারলাম না । তারপর কোন মতে এসবের নাভীমুলে তার ফ্যাস ফ্যাসে মুখটি একটু ঘষে দিতে পারলেই রমন চিতকারে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে অথচ নির্বাচনের পর ধর্ষিত হতে হতে ,মুখ দিয়ে গ্যাজলা বেরিয়ে গেলেও একটি আর্তনাদও সে করতে পারেনা ।

ফাও খাওয়ার অভ্যাস করে নিজেদের অধিকার বোধ হারিয়ে ফেলেছে বিধায় আজকে তাদের এই অবস্থা হয়েছে বলে মনে হয় । জনগনের এই লুপ্ত অধিকার বোধ কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সেটাই কি আজকে চিন্তাশীল তরুনদের ভাবনার বিষয় হওয়া উচিত নয়?