মামার বাড়ি আগুন এবং অন্যান্য প্রবচন

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
Published : 16 Jan 2012, 02:53 AM
Updated : 12 May 2020, 07:06 PM

মামার বাড়ি আগুন লাগছে চলো আলু-বেগুনটা পোড়াইয়া খাই। শৈশবে শোনা এই গ্রাম্য প্রবচনের গূঢ় অর্থ বুঝেছি একটু বড় হবার পর। নিজের অত্যন্ত আপনজনের কঠিন বিপদের সময়েও সুযোগসন্ধানী বা আপন স্বার্থ চরিতার্থকারীদল সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে নিজের সুবিধাকেই মোক্ষম মনে করে। এদের চক্ষুলজ্জা বলে কিছু নাই। নিজের বাবা, মা, ভাই, বোনের ক্ষতি করতেও এরা দ্বিধা করেনা। নেশাখোরেরা যেমন নেশার সামগ্রী জোগাড় করতে নিজের ঘরের জিনিসপত্র চুরি করে টাকার জন্য, এরাও তেমনি। এরা এক অদ্ভুত চিড়িয়া।

প্রবচনটি প্রথম শুনেছিলাম আবু ভাইয়ের মুখে। তখন আমি খুবই ছোট। গোপালগঞ্জ এস এম মডেলে ক্লাস টু-তে পড়ি। স্কুল থেকে ফিরেই আবু ভাইয়ের জিম্মায়। যত আবদার সব আবু ভাইয়ের কাছে। আবু ভাইও কোন কিছুতে না করেন না। আবু ভাই ছিলেন বাসার সার্বক্ষণিক কর্মী। মাথায় টুপি, মুখে হালকা দাঁড়ির আবু ভাই নিয়মিত নামাজ পড়তেন। রোজার দিনে আমার মায়ের হাতের ইফতার খেতেন। আবু ভাই খুব সুন্দর পুঁথি পাঠ করতেন। এমনকি রামায়ণের রাম-সীতা-রাবনের গল্পও তিনি খুব সুন্দর করে সুরেলা সুরে বলতে পারতেন। আহা, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! ধর্মচর্চা আর আবহমান সংস্কৃতি চর্চা পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হাঁটতো। তখন কোন ঠোকাঠুকি হত না। এটাই এই ভূখন্ডের শত শত বছরের গড়ে ওঠা সভ্যতা।

থাক গে, আমার লেখার বিষয় গোপালগঞ্জের আবু মিয়া নয়। বিষয় মামার বাড়ি আগুন ও আলু-বেগুন পুড়িয়ে খাওয়ার মত জঘন্য মনোবৃত্তি। এই জঘন্য মনোবৃত্তির চিড়িয়াদের নতুন করে পরিচয় দেবার প্রয়োজন আছে কি? মনে হয় না। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এই সব চিড়িয়া দর্শনের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আছে। এদের দেশ, সমাজ, মানুষ এমনকি নিজের স্ত্রী-সন্তানদের প্রতিও ভালোবাসা নাই। এদের কাজ সারাক্ষণ সুযোগের সন্ধানে থাকা। অপরের মাথায় বাড়ি দিয়ে খাওয়া।

দুর্যোগ দুর্বিপাকে বিপন্ন মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ কিভাবে নিতে হয় সেটি তাদের রক্তগত শিক্ষা। রাজাকারের সন্তানের মানসিক গড়নের পরিবর্তন খুব একটা হয় কি? এটা রক্তের ভেতর থেকেই যায়। নইলে দেশ ও জাতির সংকটকালে কিভাবে তারা দুই নম্বরি কাজে অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠে? কিভাবে নকল পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস্ তৈরি করে বাজারে ছাড়ে অথবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে? কিভাবে পবিত্র রমজান মাসে ফলে রাসায়নিক দ্রব্য মেশায়, যা জীবন বিনাশী? কিভাবে গরীবের জন্য বরাদ্দকৃত চাল, তেল মেরে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে? কিভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ ইফতারের খেজুর বিক্রি করে পবিত্র মাসে? কিভাবে? কিভাবে? অনেক প্রশ্ন। উত্তর একটাই। দুর্যোগকালে ঝোঁপ বুঝে কোপ দেয়া এবং নিজের আখের গোছানো।

মামার বাড়ির আবদার বলেও আমাদের দেশে একটি জনপ্রিয় প্রবচন আছে। করোনাভাইরাসের দুর্যোগকালে আবদার করাদের সংখ্যাও যেন বেড়ে গিয়েছে। বছরের পর বছর হাজার হাজর কোটি টাকা কামিয়েছেন। কানাডা, অ্যামেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে রাজকীয় প্রাসাদ কিনেছেন। কাছাকাছি ভারতেও মোটামুটি বাড়ি, জমিজমা, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। কিন্তু গরীবের পাওনা পরিশোধের সময় তাদের গলা শুকিয়ে কাঠ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। তারপরও শুনি হায় হায়! আলু-বেগুন পুড়িয়ে খাওয়া দলের সাথে মামার বাড়ির আবদার দলের কোথায় যেন খানিকটা হলেও মিল আছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন চাটার দল। বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ আত্মজা কি এদের বলবেন– গলা গুকানোর দল কিংবা হায় হায় দল!

প্রচলিত প্রবচন নিয়ে আরো একটি দল হয় কিনা দেখা যাক। প্রবচনটি হচ্ছে, ঘোলা পানিত মাছ শিকার। এই দলটি সুযোগের অপেক্ষায় থাকে না, সুযোগ তৈরি করে নেয়। সমাজের ভেতর এরা ঘুণপোকার মতো অপকর্ম করে চলেছে অনেকদিন ধরে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল দর্শন, আদর্শ দাঁতাল শুকরের মতো তছনছ করে ফেলতে চায় তারা। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা তাদের চক্ষুশূল। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এবং জাতির পিতার আজন্ম লালিত ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শনকে নস্যাৎ করতে সদা তৎপর তারা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রগাঢ় ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মাচারের প্রতি শতভাগ নিষ্ঠার কথা সর্বজন বিদিত। অথচ বারবার নানাভাবে তাঁর ধর্মনিষ্ঠার ভাবমূর্তির উপর আঘাত করতে ক্লান্তিহীন অপপ্রচার চালিয়ে যায় ঘোলা পানির মাছ শিকারী দল। দেশের বিশাল সরলপ্রাণ ধর্মনিষ্ঠ মানুষের ভিতর ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করার কাজটি সুচতুরভাবে তারা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এরা উগ্রবাদী ও ধর্মান্ধ নানা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। এই সব গ্রুপের প্রায় সবাই সশস্ত্র কর্মকাণ্ডে জড়িত জঙ্গি। এরা দেশের ভেতর বেশ কয়েকবার সশস্ত্র ঘটনা ঘটিয়েছে এবং সুযোগ পেলেই ঘটিয়ে থাকে। ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি করে স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলায় এরা অত্যন্ত পারঙ্গম এবং এই ধরনের অপকর্ম তারা প্রায়শই করে থাকে। যেই দেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে নিজ ধর্মাচরণ করেন, যেই দেশের সরকার প্রধান ধর্মচর্চার সহযোগিতায় উদার হস্ত এবং দেশ শাসনে এমন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না যা সঠিক ধর্মচর্চার সাথে সাংঘর্ষিক, সেই দেশে ধর্মের কোন্ অনুশাসন কায়েমের চেষ্টা- সেটা অনেকেরই বোধগম্য নয়।

দেশ যখন করোনাকালের কঠিন সময় পার করছে এবং সরকার, সরকার প্রধান ও জনগণ যখন সংকট কাটানোর মহাকর্মযজ্ঞে গভীর মনযোগী, তখনও দেখছি দুর্বৃত্তরা হাত গুটিয়ে বসে নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত তথ্যে মাঝে মাঝেই তাদের ধৃত হবার কথা দেখি। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন। এই দুঃসময়েও বদ উদ্দেশ্যপূর্ণ নড়ন চড়ন দেখে মনে হয় চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।

ধৃত দুর্বৃত্তদের ছবি গণমাধ্যমে দেখে বুঝতে পারি যে, এদের চেহারা, পোশাক, ভাবভঙ্গী, তরিকা অভিন্ন এবং প্রায় একই রকম। কিন্তু সম্প্রতি ধরা খাওয়া কয়েকজনকে দেখে বেশ বোঝা যায়, এরা উচ্চাবিত্ত, দামী বাড়ি-গাড়ির মালিক, সস্ত্রীক ক্লাব কালচারে অভ্যস্ত, নানা পেশার প্রভাবশালীদের সাথে নিত্য ওঠাবসা, আনন্দ ফুর্তিতে খই মুড়কির মতো ওরা টাকা ওড়ায়। আরো বোঝা যায় এরা নব্য ধনী এবং টাকা পয়সা যা কামিয়েছেন তা সম্ভবত গত দশ-বারো বছরে। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের সময়। এই সময়ের প্রতি বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞ না থেকে এই অকৃতজ্ঞের দল বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ এবং সরকারের বিরুদ্ধে অহরহ অযৌক্তিক, মিথ্যা এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলেন। দেশে বিদেশে বসে তারা সাম্প্রতিক দুঃসময়ের সুযোগ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে মহাপণ্ডিত বনে গিয়ে নিজ দেশ ও দশের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর কুৎসা রটনা করেন। কেউ কেউ ছবিটবিও আঁকার চেষ্টা করেন। সরল প্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়ে বীর সাজার প্রবণতা তাদের। পিপীলিকার পাখা হয় মরিবার তরে। হয়েছেও তাই। শেখ হাসিনা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহনশীলতাকে দুর্বলতা ভেবে তরা বোধ হয় টি-টোয়েন্টির চেয়েও শর্ট ভার্সনে খেলা শুরু করেছিল। দুঃসাহসই বলতে হবে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নাই। লাভ হল এই যে, সমাজের উচ্চ মার্গে এতদিন ধরে ফড় ফড় উড়ে বেড়ানো তেলাপোকাগুলো যে সত্যিকার অর্থে পাখি নয় সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল। তবে সাধু সাবধান। খুঁড়ে দেখতে হবে এদের সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গের গভীরতা এবং ভেতরে ভেতরে কোন কোন সুড়ঙ্গের সাথে যোগাযোগ সেটা খতিয়ে দেখলে হয়তো সাঙ্গপাঙ্গসহ কালকেউটে কিংবা গোখরার মত বিষধরের খবর বেরিয়েও আসতে পারে।

এরা ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার দল। এই দলের পক্ষে কথা বলছেন প্রভাবশালী বিদেশিরা। বাক স্বাধীনতার ধোঁয়া তুলে নড়াচড়া শুরু করেছেন দেশের স্বনামধন্য বিদ্যজনেরাও, যা তারা আগেও করেছেন এবং সব সময় করেই থাকেন। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই লাগে।

শেষ করার আগে আর একটা প্রসঙ্গে অল্প কটি কথা বলতে চাই। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণে দেশে নাকি ছোট বড় মিলিয়ে অনেকগুলো সংগঠন রয়েছে। যদিও জানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষায় এবং উৎসব আনন্দে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু ধারণাটাই মানতে চান না। তবু তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যে উচ্চ মূল্যায়ন করেন তার প্রশংসা না করলে ভুল হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু নামাঙ্কিত সংগঠনগুলো তারপরও প্রায়শই সাংবাদিক সম্মেলন, মানববন্ধন, পথশোভা, মিছিল-মিটিং করেন বিভিন্ন ইস্যুতে। সংগঠন সচল রাখতে এসবের প্রয়োজন আছে হয়তো। স্বাভাবিক সময়ে এসবকে অস্বাভাবিক মনে হয় না? তাছাড়া দেশে গণতন্ত্র চর্চার একটা মসৃণ ধারা তো শেখ হাসিনাই স্থায়ী করেছেন।

কিন্তু দেশের সংকটকালে দল, মত, ব্যক্তি সকলে মিলে সম্প্রীতির সহনীয় পরিবেশ বজায় রাখাই যখন কাম্য তখন "সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস", ত্রাণ বিতরণে ধর্মীয় বৈষম্যের অভিযোগ ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আগের মতো উচ্চকিত না হলেই কি ভালো ছিল না? দেশে বিদেশে সকলকে জানিয়ে মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ে 'জোর দাবি' অথবা 'ক্ষোভ' বা 'উদ্বেগ' আনুষ্ঠানিকভাবে না জানিয়ে পারষ্পারিক আলোচনার মাধ্যমেই তো সারা যেত। আগের মতো সংবাদপত্রে বিবৃতি দেয়ারও প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া সংগঠন এবং নেতৃবৃন্দের নিজ পরিচয় ও ক্ষমতায়ও মেমোরেন্ডামে উত্থাপিত অনেক সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব ছিল। শেখ হাসিনা বা তার সরকারকে বিব্রত করার অভিপ্রায়ও দেশ ও জাতির বর্তমান কঠিন সময়ে ভালো লাগে নাই এবং প্রত্যাশিতও নয়। রাজনৈতিক ঢং এ দাবি দাওয়া আদায়ের এই প্রক্রিয়ার পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য নাই তো?