শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের আরেকটি রূপ

মেহেদী হাসান
Published : 16 Jan 2012, 09:54 AM
Updated : 16 Jan 2012, 09:54 AM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ত্ত্বধীন , একটি কলেজের নাম হচ্ছে ; গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ । এই কলেজটির নামের সাথে মহিলা শব্দটি যুক্ত না থাকলেও , এই কলেজে শুধুমাত্র মেয়েরাই অধ্যয়ন করার সুযোগ পায় ।

স্বাভাবিক বোধ থেকে প্রশ্ন জাগে , গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ক জ্ঞান কি শুধু মেয়েদেরই জানার দরকার ; ছেলেদের বোঝার দরকার নেই ? আচ্ছা ধরেই নিলাম, গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে মেয়েদের একচেটিয়া অধিকার ; সেখানে ছেলেদের কোন ধরনের প্রবেশাধিকার নেই । কিন্তু এটা ধরে নিলে , স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নটি চলে আসে , সেটি হলঃ সাধারণ অর্থনীতি বিষয়ক যে জ্ঞান তাতে মেয়েদের প্রবেশাধিকার থাকবে কি না ?

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে , সাধারন অর্থনীতি বিষয়ক জ্ঞান, ছেলে-মেয়ে সবাই অর্জন করছে । কিন্তু পূর্বে অর্থনীতি বিষয়ক জ্ঞান কেন , শিক্ষা লাভের কোন অধিকারই মেয়েদের ছিল না । সমাজের ক্রমবিবর্তনে এবং নানা মনীষীদের অবদানে মেয়েরা বর্তমানে শিক্ষা লাভের অধিকার পাচ্ছে । কিন্তু আমাদের সমাজে , পুরুষরা আজো গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ক জ্ঞানে অধিকার পেলোনা !

বর্তমান সমাজে নারীদের কিছু ভাসা ভাসা অধিকার আইনগত ভাবে স্বীকৃত হলেও এ অধিকার গুলোর শক্ত কোন সামাজিক ভিত্তি নেই । এবং তাদেরকে আজো অবলা , ললনা , রমনী , কামিনী , মহিলা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের দূর্বলতা ও নিগ্রহ জ্ঞাপক বিভিন্ন ধরনের শব্দে ডাকা হয় ও সমাজে তাদের প্রতি আচরণ ওরকমই । কিন্তু পুরুষকে ঠিকই সম্বোধন করা হয় বিভিন্ন ধরনের শক্তিব্যাঞ্জক শব্দে । এবং বড় বড় পদবাচক শব্দগুলো এখনো পুরুষবাচক ।

রাষ্ট্রীয় আইনে , উত্তারিধকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার আজো অর্জিত হয়নি । সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যাবস্থার অন্দরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিকৃত রূপ । পুরুষ , মানুষ হিসেবে যতটুকু অধিকার সমাজের নিকট থেকে পায় , তার একাংশও নারী পায়না । তারপরেও নারী বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত । আর এত কিছুর পরেও পুরুষকে দেয়া হল শুধুমাত্র বাহিরের দায়িত্ব এবং নারীকে দেয়া হল ঘর-বাহির দুটোরই দায়িত্ব ।

সমাজ পূর্বে নারীদেরকে শুধুমাত্র ঘরের কাজের দায়িত্ব দিত, বাহিরের কাজে হাত দিতে দিত না । এখন কিন্তু ধীরে ধীরে বাহিরের কাজে অংশগ্রহনের সুযোগ তারাও পাচ্ছে । কিন্তু পুরুষ সেই আদিকাল থেকেই বাহিরের কাজ নিয়েই ব্যাস্ত হয়ে আছে , ঘরের কাজের অধিকার সে আজ অব্দি পেল না বা নিল না । আবার কোন পুরুষ যদি ঘরের কাজের দায়িত্ব নেয় বা নিতে চায় , তাহলে সমাজে তাকে ঘিরে ছি ছি পড়ে যায় । সে পরিনত হয় সমাজের সবচেয়ে ব্যাক্তিত্বহীন চরিত্রে ।

যে দম্পত্তির স্বামী-স্ত্রী , দুজনেই চাকুরী ,ব্যবসা বা বাহিরের অন্য কোন কাজের সাথে জড়িত ; সেখানে দেখা যায় , শুধুমাত্র স্ত্রীকেই বাহিরের কাজ থেকে ক্লান্ত শরীরে ফিরে এসে ; ঘরের সকল কাজ সম্পন্ন করতে হয় । আবার যে দম্পত্তিতে স্বামী সারাদিন বেকার বসে থাকে , সেখানেও ঐ স্ত্রীকেই ঘর -বাহির একাই সামলাতে হয় । তার পরেও ঐ বেকার স্বামীটিই গৃহস্বামীর মর্যাদা লাভ করে । এভাবেই সমাজ তৈরীকৃত অসম শ্রম -বন্টন ,নারী-পুরুষের মধ্যে নিদারুন বৈষম্য তৈরী করছে ; ফলত সমাজের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে ।

সমাজের এরকম অবস্থায় , রাষ্ট্রের কি উচিৎ নয় , এই বৈষম্য দূর করতে ; সমাজকে সচেতন করে তোলা ? সেটা না করে রাষ্ট্র যদি এই অসম শ্রমবন্টনকে স্বীকৃতি দেয়া ,এবং বাড়িয়ে তোলার জন্য ; গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে , সেটি শুধুমাত্র মেয়েদের প্রবেশাধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে ; তাহলে সেটা রাষ্ট্রের উচিত কাজ হবে কি না ? আমি যদি একজন পুরুষ হয়ে গার্হস্থ্য অর্থনীতি অধ্যয়ন করার মানসে , গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে ভর্তি হতে চাই , তাহলে রাষ্ট্র আমাকে বাঁধা দেওয়ার কোন নৈতিক অধিকার রাখে কি না ? আর আমি যদি রাষ্ট্রের ঐ নিয়মটি পুরোপুরি লঙ্ঘন করে , জোর করে ভর্তি হতে চাই ; তাহলে রাষ্ট্রের আইন অমান্য কারী অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হব কিনা ?