আমাদের বর্ণবাদ

মেহেদী হাসান
Published : 14 Feb 2012, 11:07 AM
Updated : 14 Feb 2012, 11:07 AM

কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামীতে ভরপুর , পুরুষতান্ত্রিক ও পৃথিবীর অন্যান্য সমাজের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকা আমাদের এই জরাজীর্ণ সমাজে বর্ণবাদ আছে কি ? প্রকট ভাবে হয়ত নেই , প্রচ্ছন্ন ভাবে আছে কি, প্রকাশ্যভাবে হয়ত নেই , গোপনে থাকতে পারে কি , আমাদের মনের সচেতন স্তরে নেই ,অবচেতন স্তরে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু ?

আমি সেই বর্ণবাদের কথা বলছি , যার কারনে যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে আততায়ীর গুলিতে প্রান দিতে হয়েছিল , মূলত সাদা ও কালো রঙয়ের মানুষদের মাঝের বৈষম্যকে।

এই আলোচোনার শুরুতে আমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই ,গায়ের রঙ সাদা করার ক্রীমের বর্তমান বাজার , এর ব্যাবহারকারীর সংখ্যা এবং এগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষার দিকে–

আমাদের প্রসাধনের বাজার সয়লাব হয়ে গিয়েছে , এই রঙ সাদা করার ক্রীমে । এই ক্রীম বাদে প্রসাধনের বাজারকে আজ কল্পনাও করা যায় না । পূর্বে মেয়েদের রঙ ফর্সা করার ক্রীম ছিল শুধু , যদিও তখনও পুরুষরাও ওই ক্রীম ব্যাবহার করত । এখন আলাদা ভাবে পুরুষদেরও রঙ ফর্সা করার ক্রীম বের হয়েছে । আর পূর্বে শুধু মেয়েদের মুখের রঙ সাদা করার ক্রীম ছিল এখন হাতের পায়ের সমস্ত শরীরের রঙ সাদা করার ক্রীম বের হয়েছে । কিছুদিন পরে হয়ত পুরুষের সমস্ত শরীরের রঙও সাদা করার ক্রীম বের হবে । প্রেমিকার যে কালো চুল নিয়ে কত কবিতা কত গান কত শিল্প রচনা করল পুরুষ প্রেমিক সেই কালো চুলকে বাদামী করার জন্য বেরিয়েছে চুলে ব্যাবহারের জন্য বাদামী রঙের কলপ ।

এখন দেখা যাক রঙ সাদা করার ক্রীমের ভোক্তার সংখ্যা কেমন ? পুরো দেশ জুড়ে খাদ্য , বস্ত্র , বাসস্থানহীন মানুষবাদে এমন একজনকেও (নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে) হয়ত খুজে পাওয়া কষ্টকর হবে, যে রঙ সাদা করার ক্রীম ব্যাবহার করেনা । ক্রীম ঘষে সবাই সাদা হতে চায় , গায়ের রঙ সাদা না হলে সুন্দর দেখাবে না আর সুন্দর না দেখালে চলবেনা কারন সবাই সুন্দর পছন্দ করে । দেখতে সুন্দর না হলে অস্তিত্ব স্বার্থকতা পায় না ,সমাজে কোন কাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় না । সুতরাং সাদা তাকে হতেই হবে । এবং এর পাশাপাশি কালো চুল বাদামী করার কলপ ব্যাবহারকারীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে । তারা মনে করছে গায়ের রঙ এর পাশাপাশি তাদের চুলের রঙও সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ানদের চুলের মত বাদামী হতে হবে । অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে কালোকে কোনমতেই আর টিকতে দেয়া হবেনা ,শরীরের সমস্ত জায়গা থেকে তাকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হবে ।

এখন আসি রঙ সাদা করার ক্রীমগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষার দিকে । টেলিভিশন খুললেই ,পত্রিকার পাতা উল্টালেই ,রাজপথের বিলবোর্ড গুলোর দিকে তাকালেই রঙ ফর্সা করার ক্রীমের বিজ্ঞাপন ।

সাদা তোমাকে হতেই হবে , কোনমতেই গায়ের রঙ কালো থাকা চলবেনা ; তোমার গায়ের রঙ যদি কালোই থেকে যায় সমাজে দাড়ানোর জায়গাটুকুও তোমার থাকবে না । পুরুষ হলে হয়ত কোনমতে বেচে থাকতে পারবে কিন্তু নারী হলে আর রক্ষে নেই ! তুমি যতই শিক্ষিত হও , থাকো যতই মেধাবী , হও যতই বুদ্ধিমান ,যতই থাক ধনসম্পদ কোন লাভ নেই ; এই গায়ের রঙ কালো নিয়ে কোথাও দাড়াতে পারবেনা । তোমার চাকুরী হবেনা , তোমার প্রেমে কেঊ হবুডুবু খাবেনা, তোমাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না , কোন সন্মান পাবেনা , স্নেহ করবেনা কেহ , পরিবারে কোন জায়গা হবেনা , কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তোমাকে ঘিরে , তোমাকে নিয়ে কোন আলোচোনা হবে না ।সর্বোপরি সমাজে তোমার কোন ব্যাক্তিত্বই থাকবেনা ,এর চেয়ে বরঞ্চ মরনই ভাল । হয় গায়ের রঙ ফর্সা কর , নচেৎ মারা যাও বা বেচে থাকো জীবন্মৃত হয়ে ।

আর তোমার গায়ের রঙ যদি ফর্সা থাকে বা কালো রংকে ঘষে মেঝে ক্রীম লাগিয়ে ,উপটান মেখে ফর্সা হতে পার বা ফর্সাকে করতে পারো আরো ফর্সা ,গরুর খাটি দুধের মত; তাহলে দেখবে কি হয় ! তোমার চাকুরী হবে রিসিভশনে , সহজেই হতে পারবে কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের প্রাইভেট সেক্রেটারী ।

নৃত্যশিল্পী হতে চাও ,গায়ের রঙ অবশ্যই সাদা হতে হবে ,নৃত্যের যত মুদ্রাই তুমি জানো না কেন ভারত নাট্যম , ক্লাসিক কোন লাভ নেই । তোমার গায়ের রঙ্গটি যদি সাদা না হয় তাহলে তোমার নৃত্য কেউ দেখবেনা ।

সঙ্গীত শিল্পী হতে চাও ? পূর্বের দিনে হলে গায়ের রঙ কালো হলেও চলত কারন তখনকার দিনে গান ছিল শুধু শোনবার বিষয় ,দেখার বিষয় ছিল না । এখন তোমার গায়কী সুন্দর হলেই চলবেনা গায়ের রংটিও হতে হবে সাদা ,তাহলেই কেবল মাত্র তুমি গায়িকা হিসেবে নাম কুড়োতে পারবে নচেত সম্ভবে না ।
অভিনয় করতে চাও ,তাহলে তো কোন কথাই নেই ,তোমার গায়ের রঙ অবশ্য অবশ্যই সাদা হতে হবে । তোমার গায়ের রঙ সাদা না হলে কোন চরিত্রেই তুমি অভিনয় করতে পারবেনা ।

আরেকটা ব্যাপারে তোমাকে হুশিয়ার করে দিচ্ছি ,সাবধান কখনো রোদে যাবেনা । রোদে যাওয়া তোমার জন্য হারাম ।সূর্য তোমার চির শত্রু । তোমাকে হতে হবে অসূর্যস্পর্শা ,কারন এই সূর্য তোমার সকল সাধনাকে নষ্ট করে দেবে ,তোমার গায়ের মেনালিনকে জাগ্রত করে ,তোমার গায়ের রংকে কালো করে দিবে । ভিটামিন ডি(যেটা সুর্যের আলো থেকে পাওয়া যায়) এর অভাবে তোমার শরীরের হাড় গুড়ো হয়ে যাক, তাতে কোন ক্ষতি নেই ,কারন তোমার গায়ের রঙ সাদা হলে তোমাকে তো আর শারীরিক , মানসিক কোন ধরনের পরিশ্রম করতে হবে না । গায়ের সাদা রংকে পুজি করে তুমি অনেক কিছু করতে পারবে । রোদে যাওয়ার আরো বিপদ আরো আছে ,তোমার মুখে লুকিয়ে আছে অনেক ডার্কস্পট , সূর্যের আলোতে গেলেই ওরা কালো কোলাহল করতে করতে বেরিয়ে আসবে ।আর তাহলেই তুমি গেছ ,আর রক্ষে নেই ,ধরনীকে দ্বিধা করে একবারে ভেতরে ঢুকে যেতে হবে । আর নিতান্ত বাধ্য হয়েই যদি বাইরে যেতে হয় তাহলে মুখে লাগিয়ে যাবে আমাদের শক্তিশালী সানস্ক্রীন । আর এই সানস্ক্রিন ভেদ করে সূর্যের আলো তোমার সাদা মুখের রঙ কালো করে দিতে পারবেনা ,ডার্কস্পট গুলোকেও আর জেগে উঠতে দিবেনা

আর হে পুরুষ ,তুমি আগে তোমার বৌয়ের ,প্রেমিকার ,বোনের রঙ ফর্সা করার ক্রীম লাগাতে । কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে এমনটি হবার কোন উপায় নেই , আমাদের কোম্পানী ,অনেক বছর গবেষণা করে বানিয়েছে ,পুরুষের রঙ ফর্সা করার ক্রীম । মেয়েলোকের ক্রীমে আর কোন কাজ হবেনা । কারন তুমি পুরুষ , তোমার গায়ের চামড়া ,মুখের চামড়া ওদের থেকে ভিন্ন , ওরা অনেক বেশী কোমল আর তুমি শক্ত সামর্থ্য । তাই তোমার জন্যে এনেছি রঙ ফর্সা করার শক্তিশালী ক্রীম । এই ক্রীম ব্যাবহার করার সাথে সাথেই তুমি সাদা এবং হ্যান্ডসাম হয়ে যাবে । চাকুরীর জন্য রাস্তায় রাস্তায় আর ঘুরতে হবে না , বা মাছি মারা কেরানীর চাকুরী তোমাকে আর করতে হবে না । আর এখন নারীরা আস্তে আস্তে স্বাধীন হচ্ছে স্ব ,পূর্বে হয়ত মেয়েরা কালো পুরুষদের মুখ বুঝে সহ্য করে নিত কিন্তু এখন শহুরে মেয়েরা আর সহ্য করবেনা , সুতরাং তোমার গায়ের রঙ যদি কালো হয় তাহলে তোমার প্রেম হবেনা । আমাদের রঙ ফর্সা করার ক্রীম ব্যাবহার করে, হতে পারবে সিনেমার হিরো , বিজ্ঞাপনের মডেল, গায়ক এবং পাবে একসাথে তিনচারটা গার্লফ্রেন্ড ।

আর দেখো তুমি জীবনের ঝুকি নিয়ে, কত কষ্ট করে , প্রচন্ড রোদের মধ্যে স্ট্যান্টম্যানের কাজ করতে করতে রোদে পুড়ে তোমার গায়ের রঙ কালো করে ফেলেছো । এত গুন থাকা সত্ত্বেও তোমার ঐ কালো চামড়ার কারনেই তোমাকে স্ট্যান্টম্যানের কাজ করতে হয় ,পারোনা হিরো হতে , আর যে হিরোর চরিত্রে অভিনয় করে তার কোন গুন না থাকা সত্ত্বেও , শুধু মাত্র সাদা চামড়ার কারনেই সে হিরো ,তার কত মেয়ে ভক্ত , কতজন অটোগ্রাফ নিতে আসে ! কত তার নাম ডাক ! তোমার এই কালো চামড়া নিয়ে তুমি শুধু মাত্র বিটকেলে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতে পারবে ,পার্শ্ব চরিত্র এমনকি কমেডিয়ানের চরিত্রেও অভিনয়ের সুযোগ হবেনা । তুমি কি পারবে দেখাতে সিনেমার জগতে কালো কোন হিরো আছে , এমন কোন চিত্র মডেল আছে যার গায়ের রঙ কালো ? আসো আমাদের ক্রীম মাখো ফর্সা হও ,সিনেমার হিরো হও, গায়ক হও, বিজ্ঞাপনের মডেল হও আর দুনিয়া জোড়া মেয়ে ভক্ত ও খ্যাতি লাভ কর ।

রঙ সাদা করার ক্রীমের বিজ্ঞাপনের ভাষা এবং আমাদের সমাজের প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদী ভাষার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না । পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে কি করে ,আমাদের সমাজের প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদী ভাষাকেই তো ওরা আরেকটু রাঙ্গিয়ে ওদের বিজ্ঞাপনের ভাষা হিসেবে ব্যাবহার করে । আবার ঐ রঙ্গচঙ্গে ভাষাই আমাদের সমাজ আয়ত্তীকৃত করে নেয় । আমাদের সুড়সুড়ি দেয়ার মত ঐ বর্ণবাদী অঙ্গটার অস্তিত্ব আছে বলেই তো ওরা সুড়সুড়ি দিয়ে ওদের পন্য বিক্রি করতে চায় এবং ব্যাপকভাবে করে । মোট কথা আমরা আমাদের গায়ের রঙ ফর্সা করতে চাই আর ওরা রঙ সাদা করার ক্রীম বিক্রী করে মুনাফা লুটতে চায় ।

সমাজের যেকোন অসঙ্গতি , বৈষম্য তার ভাষার ব্যাবহারে প্রভাব ফেলে । আমাদের বর্ণবাদী মানসিকতার প্রভাবও আমাদের ভাষায় দারুন ভাবে লক্ষ্য করা যায় । মানুষের গায়ের রঙের ক্ষেত্রে ফর্সা শব্দটি সুন্দর শব্দের সমার্থক হয়ে দাড়িয়েছে অনেক জায়গায় । আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে এ জিনিসটি বেশ ভালভাবে লক্ষ্য করা যায় । যে মেয়েটির গায়ের রঙ ফর্সা কিন্তু দেখতে হয়ত ভালো না, তার সমন্ধে বলা হয় ,মেয়েটি সুন্দর কিন্তু দেখতে ভাল না । আবার যে মেয়েটির গায়ের রঙ কালো কিন্তু দেখতে ভাল, তার সমন্ধে বলা হয় ,মেয়েটি দেখতে ভাল হলেও সুন্দর না ।

আবার যা কিছু ভাল, সুন্দর ,সৎ সবকিছুরই সমার্থক শব্দ হয়ে দাড়িয়েছে সাদা এবং যা কিছু খারাপ , কুৎসিত , অসৎ এগুলোর সমার্থক শব্দ হয়ে দাড়িয়েছে কালো । একজন খারাপ মানুষের গায়ের রঙ যদি কালো হয়ে থাকে তাহলে বলা হয় ; ওর বাহিরটাও কালো ,ভিতরটাও কালো ।আবার একজন ভাল মানুষের গায়ের রঙ যদি কালো হয় তাহলে বলা হয়; ওর বাহিরটা কালো হলেও ভিতড়টা সাদা ।

অন্যায়কারী , অসৎ লোকের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে গিয়ে বলি অমুকের কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও । অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকাকে বলা হয় কালো টাকা , সৎ উপায়ে অর্জিত টাকাকে বলা হয় কালো টাকা ।

আমাদের সমাজে সাধারণভবে যদি সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার এরকম একটি মানুষের চিত্র আঁকি তাহলে তার চিত্রটি সম্ভবত এরকম পাবো , নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি কালো মেয়ে । প্রথমত সে পুজিবাদী সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার , পুরুষতান্ত্রিকতার কারনে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার ,এবং তারপর শিকার বর্ণবাদের ।