মুসলিম মনিষীগন: ইমাম আল গাজ্জালির জীবন নিয়ে আলোচনা

মেহেদি হাসান জয়
Published : 6 Dec 2014, 03:40 PM
Updated : 6 Dec 2014, 03:40 PM

ইমাম আল গাজ্জালি ১০৫৮ সালে ( ৪৫০ হিজরি) মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে উর্বর ভূমি যেখানে অনেক মুসলিম মনিষী জন্মেছেন সেই খোরাসানের তুস শহরে অথবা তা পাশে জন্মগ্রহন করেন। তিনি এমন এক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন যার পূর্বসূরি ইরানের এবং সূফী আকিদার প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। ইমাম আল গাজ্জালির পিতা নিজে একজন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব না হলেও উনি পণ্ডিত ব্যক্তিদের অনেক কদর করতেন এবং উনার মনে এই আশা লালিত ছিল যে উনার ছেলেরা বড় হয়ে পান্ডিত্ব অর্জন করবেন।  ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক টি উইন্টার মনে করেন যে গাজ্জালি ছিলেন মানব জাতির এক অগ্রদুত এবং এই কথা বলা যায় যে উনার পিতার লালিত স্বপ্ন একটু বেশি পরিমাণে পূরণ হয়েছিল। গাজ্জালির পিতা উনার খুব অল্প বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন এবং শেষ নিশ্বাস ত্যাগের পূর্বে উনি উনার সঞ্চিত টাকা উনার এক ধার্মিক বন্ধুকে দিয়ে যান ইমাম গাজ্জালি এবং তার ভাইয়ের লালন পালনের খরচ বাবদ। গচ্ছিারত টাকা শেষ হবার পর তার বাবার বন্ধু তাদেরকে মাদ্রাসাতে দাখিল করেন এবং সেখানে তিনি কৃতিত্বের সাথে সব বিষয়ে অধ্যায়ন শেষ করেন। মাদ্রাসাতে অধ্যায়ন শেষ করে তিনি ১৫ বছর বয়সে জুরযান নামক স্থানে যান ফিক নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য। সেখানে তিনি ইমাম আল ইসমাইল নামে একজন শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেন এবং কিছু পরেই তুস নগরিতে ফিরে আসেন নিজে নিজে অধিক অধ্যায়ন করার জন্য। তিন বছর যাবত নিজের সমস্ত বিদ্যা অধ্যায়ন শেষে করে তার জ্ঞান পিপাসু হৃদয়ের পিপাসা আর ও বেশি বৃদ্ধি করেন এবং তার পিপাসা মিটানর জন্য নিশাপুরে যান । সেখানে তিনি ইমাম আল জুয়াইনি যে ছিলেন সেই সময়ের শাফি মাজাহাবের অনেক মর্তবাপূর্ণ আলেম তার কাছে ফিক, যুক্তিবিদ্যা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন।

বিখ্যাত মনিষী সক্রেটিস তার রিপাবলিক গ্রন্থে পিতার চেয়ে শিক্ষকের গুরুত্বের যে অনেক বেশি সেই বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। পিতার অবদান অনেক বেশি আমাদের এক দুনিয়াবি জীবনে আনার জন্য কিন্তু শিক্ষকের আমাদের শিক্ষায় যে কিভাবে এই দুনিয়াবি জীবনে আসল সাফল্য পাওয়া যায় এবং ইমাম গাজ্জালি এমন কিছু গুনিজনের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন যারা উনাকে শিখিয়েছিলেন যে কিভাবে দুনিয়াবি জীবনের  সাথে সাথে মৃত্যুর পরের জীবনে  ও সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে এবং কিভাবে লক্ষ কোটি মানুষের হেদায়াতের নুর হিসাবে জ্বল জ্বল করা যায় হাজার বছর ধরে। জ্ঞান অর্জনের জন্য এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমন করা তৎকালীন সময়ে শিক্ষাবিদদের জন্য একটি প্রথা বংকি আর কিছুই ছিল না। লক্ষ্য পূরণে সচল কারও আশেপাশে যদি সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকে তবে তার লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হওয়া অনেকটা সহজ হয়। ইমাম আল গাজ্জালির ক্ষেত্রে কিছুটা এমন হয়েছিল। তবে জ্ঞান তাপস হবার লক্ষ্য পূরণের দিকে অগ্রমান হতে গিয়ে তিনি অপরিচিত কেউ থেকে হচ্ছিলেন এমন এক নাম যা গুণীজনেরা বিনীত ভাবে উচ্ছারন করে। ইমাম আল গাজ্জালি আজ শুধু একটি নাম হয় , অনেক দর্শন শাস্রের লুকায়িত জ্ঞানের উন্মুক্তকারি।  ইমাম আল জুয়াইনির কাছে তিনি জ্ঞান অর্জনের পাশা পাশি তাকে অধ্যাপনা করতে সাহায্য করতেন। ১০৮৫ সালে আল জুয়াইনির  যখন মৃত্যুর হয় তখন ইমাম আল গাজ্জালির বয়স ছিল ২৮ বছর। তখন তিনি নিজাম আল মুল্ক ( সেলজুক র মন্ত্রি) র সুনজরে আসেন এবং তিনি তাকে কোর্টে নিযুক্ত করেন । সেখানে তিনি ছয় বছর অতিবাহিত করেন এবং সেখানে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করতেন। অতপর তিনি নিজামিয়া মাদ্রাসাতে শিক্ষা দান শুরু করেন এবং সাথে সাথে নিজের লেখা লেখির প্রসার বাড়াতে থাকেন। এমন সময়ে তিনি একটি ইসলামিক মতভেদের মধ্যে ঘরপাক খাচ্ছিলেন আর তা হল দর্শন শাস্র এবং ইসলাম কে নিয়ে। উনি ইসলামের পক্ষে মত দান এবং মতবাদ দেন যে যে দর্শন ইসলামের সাথে সামঞ্জস্য শুধুই তাহাই গ্রহণযোগ্য কারন সত্যিকারের সত্য হল ইসলাম যা সারা জাহানের প্রভু হতে আগত। তিনি গ্রীক দর্শনবিদদের লেখা সব বইয়ের উপর প্রচুর পরিমাণে অধ্যায়ন করেন এবং ইসলামি দর্শনবিদ ইবনে রুশদ র বইয়ের উপর ও অনেক চর্চা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তিনি নিজে  সিরিজ আকারে অনেক বই লেখেন এবং তার মধ্যে একটি হল ফাদাহ আল বাতিনিয়াহ ওইয়াহ ফাদিল আল মুস্তাজহিরিয়াহ । এই বইতে তিনি দুইটি প্রধান বিষয়ে আলোকপাত করেন আর তা হল ইমামদের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং ইসলামি শরিয়ার সঠিক বর্ণনা । উনি মূলত উনার যুক্তি দিয়ে ইমামদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে পরোক্ষভাবে আঘাত করেন কিন্তু বরাবরের মত তিনি খুব বেশি সফল হতে পারেন নি।

১০৯৫ সালে ৩৮ বছর বয়সে  আল গাজ্জালি আধ্যাতিক খরায় ভোগেন যার মূল কারন ছিল যুক্তিতর্ক এবং আধ্যাতিকতার মধ্যে সামঞ্জস্য করতে না পারা। উনার এই খরা উনাকে শারীরিক ভাবে অনেক অসুস্থ করে ফেলে এবং উনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তাই শিক্ষাদান থেকে দূরে থাকেন। আল গাজ্জালি মনে করতেন যে প্রতিটি কাজের একটি আধ্যাতিক প্রভাব আছে। যেমন  শাফি মাযাহাবে ওযুর পানি অন্য কোন কাজে ব্যাবহার নিশিদ্ধ কারন তারা মনে করেন যে ওযুর পানির সাথে আমাদের পাপ ধুয়ে পরে আর এইটাই হল আধ্যা্তিক রুপ।  বিখ্যাত ইসলামিক চিন্তাবিদ হামজা  ইউসুফের মুখে শুনেছিলাম যে উনি এমন এক আরব পরিবারকে চিনেন যারা বেনামাজি দোকানির কাছ থেকে কোন খাবার কিনেন না এমন কি যে পশুর মাংশ তারা খায় তাও তারা অতি যন্তসহকারে লালন করে কারন তারা মনে করে যে প্রতিটি কাজের ই একটা আধ্যাতিক প্রভাব আছে। সেই বাসাতে আহার করার পর তার মনে হয়েছিল যে এত বরকত পূর্ণ খাবার তিনি কখনই আর কোথায় পান নি। ইমাম আল গাজ্জালি যে ১২ হাজার পাতা মুখস্ত না করে দর্শন শাস্র নিয়ে কিছু বলতেন না সেই তিনি বাকরুদ্ধ অবস্থায় নিজেই নিজেকে খুজছিলেন। ইমাম আল গাজ্জালির উপর সুফি দর্শনের প্রভাব অনেক বেশি  পরিমাণে ছিল। কারন উনার পিতা সুফি দর্শনের প্রতি অনেক প্রেমাসক্ত ছিলেন এবং উনার ভাই ছোটবেলা থেকেই সূফীতত্ত্বের একজন অনুগামী ছিলেন। জর্জ ওইয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিসের অধ্যাপক হুসাইন নাসের বলেন যে ছোট বেলা থেকেই আল গাজ্জালি ছিলেন প্রথাগত জ্ঞানের প্রতি আসক্ত এবং উনার ভাই ছিলেন সূফীমতবাদের প্রতি অনুরাগী। উনার অধিকাংশ শিক্ষক ছিলে সুফি তরিকার অনুসারি এবং নিজাম আল মুক্ল ও ছিলেন সুফি ভক্ত। আল গাজ্জালি সুফি মতবাদের প্রতি বিস্তর অধ্যায়ন শুরু করেন এবং নিজে থেকেই বুজতে পারেন যে এই মতবাদ কোন গ্রন্থগত বিদ্যা নয় যা মুখস্ত বা অন্তস্ত করা যায় বরং ইহা এমন এক যাত্রা যেখানে মানুষ নিজেকে সত্যিকারের মানুষ রুপে গড়ে তোলে । কিছু রীতিনীতি , সাধনার মাধ্যমে আত্তশুদ্ধি হল সুফি তরিকার যা কুরআন এবং হাদিস বহির্ভূত নয়। কুরআনে মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বলে অভিহিত করা হয়েছে আর যদি তাই হবে তবে শ্রেস্ট সৃষ্টি কিভাবে একে অন্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।

কিভাবে ধর্ষণের মত ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হয় যেখানে যদি আল্লাহর অনুমতি থাকত তবে মাটি ধর্ষণকারী কে গ্রাস করত। নিজেকে সত্যিকার মানুষ বানানোর এই যাত্রায় আল গাজ্জালি তার সবচেয়ে সমাদৃত উলমে আল দ্বীন গ্রন্থটি লিখেন। যার চারটি খণ্ড আছে এবং মুলত এই বইতে ইসলামি অনুশাসনের অনুশীলন এবং তার গুরুত্ব খুব দক্ষতার সাথে আলোচনা করেন। অনেকের ইসলামিক চিন্তাবিদগনের মতে কুরআন এবং হাদিসের পর  ইসলামের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল উলমে আল দ্বীন গ্রন্থটি।  যেহেতু সুফি মতবাদ নিয়ে কথা হয়েছে তাই অনেকে নাক ছিটাতে পারেন । তাই একটু নিজের স্বপ্ন জ্ঞানের ধারনা নিয়ে আলোচনা করি। আমরা আজকাল আমাদের দেশে সে রকম পীর ফকির দেখে থাকি যারা মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ার অভিনব পন্থা করেন তারা কখনই আসল সুফি মতবাদ দ্বারা তাড়িত নন । মাজার পুজা এবং বিভিন্ন ধরনের  বেশরিয়াতী কাজ কারবার দ্বারা যারা নিজেকের আবাসস্থান পূর্ণ করে রেখেছেন এবং নিজেদের কে সুফি মতবাদের ধারক দাবী করেন তারা সুফিমতবাদ হতে অনেক অনেক দূরে আছেন। ্সুফি বা তাসাউফ (আত্তশুদ্ধি)  কখনই মানুষকে  ইসলামের শরীর মানে শরীয়ত থেকে দূরে সরায় না বরং শরিয়াতের পূর্ণতা দান করে। আল্লাম আমাদের সবাইকে এমন বেশরিয়াতি পীর ফকির থেকে মুক্ত রাখুনি, আমীন  ।  ১০৯৭ সালে আল গাজ্জালি বাগদাদে প্রত্যবর্তন করেন এবং খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে থাকেন। তিনি নিজামিয়া মাদ্রাসাতে আবার ও কিছুদিনের জন্য অধ্যাপনা করেন এবং পরে তিনি তুস শহরে চলে যান এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন। দশ বছর পর সেলজুগ র মন্ত্রি ফখর আল মুল্ক র অনুরোধে আবার ও নিজামিয়া মাদ্রাসাতে শিক্ষাদান করেন এবং ৫ বছর পর নিজের জন্মভুমিতে চলে যান । সেখানে জীবন যাপনের সময় তিনি তার অতি গুরুত্বপূর্ণ বই মিনহাজ আল আবেদিন লিখেন । আই বইটি ছিল মুলত কিভাবে জীবন যাপন করা উচিত এবং কিভাবে নিজ সত্তাকে আবাদ করা যায়। তিনি ১১১১ (হিজরি ৫০৫) সালে এই দুনিয়া থেকে পর্দা করেন।