রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যত কী?

স্বদেশ রায়
Published : 22 Nov 2011, 11:21 AM
Updated : 25 Oct 2017, 07:23 AM

১৯৭১ সালের জুলাই-আগস্ট থেকে অক্টোবরের প্রথম দিকেও প্রচুর বৃষ্টি ছিল। তৎকালীন কোলকাতার অদূরে লবণ হ্রদে (বর্তমান সল্ট লেক ও নিউ টাউনে) ছিল বিশাল শরণার্থী ক্যাম্প। ছিল বসিরহাটের বিভিন্ন এলাকাতেও। এছাড়া ভারতের নানান প্রান্তে ছিল শরণার্থী ক্যাম্প। এর ভিতরে লবণ হ্রদ ও বসিরহাটের কিছু ক্যাম্প তখন দেখেছি।

অবিরাম বৃষ্টিধারার ভেতর দেখা যেত প্রায় প্রতিদিন ক্যাম্পের কোনো না কোনো তাঁবু থেকে একটি মৃত শিশুর লাশ নিয়ে বের হচ্ছে মানুষ। বের হয়ে তারা ওই শিশুর সৎকার করতে কোথায় যেত তা জানার মতো বয়সও তখন নয়। তবে মাটি দেওয়া সম্ভব হত না। কারণ, এক কোটি শরণার্থীর নব্বই ভাগেরও বেশি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। হিন্দু সম্প্রদায়ের শিশুদের একটি নির্দিষ্ট বয়স না হলে তাদের দেহ চিতার আগুনে পোড়ানো হয় না, সাধারণত পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সল্ট লেকের ধাপে বা কোথাও তাদের মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হত। বসিরহাটে ওই মৃত শিশুদের কী করা হত তা-ও ঠিক জানি না।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থী শিবির নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। তাই জানারও উপায় নেই এসব তথ্য। প্রয়াত সাংবাদিক অনিল চক্রবর্তীর জানিয়েছেন শরণার্থী শিশুমৃত্যুর হার ছিল সবচেয়ে বেশি ত্রিপুরায় ও মেঘালয়ে। হতে পারে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় সেখানে চিকিৎসক সংকট ছিল বেশি।

এই লেখা যখন লিখছি তার প্রায় ৩৬ ঘণ্টা আগে থেকে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল দেশজুড়ে। এই বৃষ্টিতে তাই একাত্তরের ওই স্মৃতি মনে পড়ল। বার বার মনে হচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা শিশুদের কথা। এই মৌসুম-বদলানো বৃষ্টিতে তারা ভিজছে। আবার পলিথিনের তাঁবুতে এক ধরনের গুমোট গরম। এ পরিবেশে যে কোনো শিশু অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে মিডিয়ার মাধ্যমে বা স্থানীয়দের কাছে টেলিফোনে খবর নিয়ে যা জানতে পারছি তাতে দুটি বিষয় দেখা যাচ্ছে; বিদেশি সাহায্য আসার পরিমাণ কমে গেছে এবং উৎসাহে ভাটা পড়েছে ব্যক্তি-উদ্যোগে দেওয়া রিলিফের পরিমাণেও।

বিদেশি সাহায্য যে রোহিঙ্গাদের জন্যে খুব বেশি পাওয়া যাবে না তা নানান লেখায় উল্লেখ করেছি। কারণ আমেরিকা, চীন, রাশিয়া ও ভারত সেভাবে সাহায্য দেবে না রোহিঙ্গাদের জন্য। পূর্ব এশীয় দেশগুলো মূলত অথরিটারিয়ান সরকারশাসিত। তাই সে সব দেশের জনগণের চাপ নেই এই সাহায্য দেবার বিষয়ে। কোনো দেশের জনগণের চাপ না থাকলে ওই দেশের সরকার ও আমলাদের উদ্যোগে অন্য দেশে অবস্থিত রিফিউজিদের জন্যে খুব বেশি সাহায্য যায় না। অন্যদিকে, মুসলিম বিশ্বের তরফ থেকে মুসলমান রিফিউজিদের জন্যে সাহায্য দেবার নজির খুব ভালো নয়। তাই বিদেশ থেকে যেমন সাহায্য পাওয়া যাবে না তেমনি দেশীয় আবেগ এক পর্যায়ে থিতিয়ে যাবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। নিত্য মরায় কেউ কাঁদে না। কথাগুলো একটু নির্মম হলেও বাস্তব সত্য। এই সত্য মাথায় নিয়ে এখন সরকারকে এগুতে হবে।

হেমন্তের এই অকালবৃষ্টির ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যে হাজার হাজার শিশু বৃষ্টিতে ভিজেছে, পলিথিনের তাঁবুতে তীব্র গরমে কাটিয়েছে– তাদের একটি বড় অংশ দ্রুতই অসুস্থ হয়ে পড়বে। এর সঙ্গে আছে প্রায় বিশ হাজারের বেশি পিতামাতাহীন বা এতিম শিশু। এদের জন্যে সরকার শিশুপল্লী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ, তারপরও এখানে কাজ করার সক্ষমতা কম। সব মিলে সরকার যে সময়ের মধ্যে এই শিশুদের জন্যে শিশুপল্লী তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে তার মধ্যে কাজ শেষ হবে সেটা ধরে নেওয়া ঠিক নয়। বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, ওই কাজে আরও দেরির আশঙ্কাই বেশি।

তার মধ্যে এসে যাবে শীতকাল। হিমের কুয়াশায় খোলা আকাশের নিচে পলিথিনের তাঁবুগুলোতে গরমের বদলে পড়বে তীব্র ঠাণ্ডা। এ সময়ে যে হাজার হাজার শিশু রোগাক্রান্ত হবে তাতে সন্দেহ নেই। তাছাড়া ততদিনে প্রয়োজনীয় খাদ্য না পেয়ে তাদের রোগ প্রতিরোধ শক্তিও কমে যাবে। যা দেখেছি একাত্তরের শরণার্থী শিবিরে– রক্ত-আমাশয়, ডায়রিয়া ও স্কিন ডিজিজ শুধু নয়, নানান রকম জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল শিশুরা। বিপুল সংখ্যক শিশু হয়ে গিয়েছিল কঙ্কালসার। তাই এই ছয় সাত লাখ শরণার্থীর মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশুকে কীভাবে বাঁচানো যাবে তা এখন বড় প্রশ্ন।

পাশাপাশি কক্সবাজারের যে এলাকায় এই শরণার্থীরা এসেছে ওই এলাকা আর্ন্তজাতিক মানব চোরাচালানের অন্যতম একটি রুট। যারা মানব পাচারকারী তাদের ধর্ম নেই, নেই স্নেহ-মায়া-মমতা। এদের শেকড়ও নানান জায়গায় ছড়ানো। এরা যেমন অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, তেমনি এদের থাকে অনেক 'উঁচু' যোগাযোগ। শোনা যায়, বাংলাদেশের একজন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও একজন বড় নেতার অতিপরিচিত সন্তানও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। তাই রোহিঙ্গা শিশুদেরকে এই চোরাচালানিদের হাত থেকে রক্ষা করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

পৃথিবীর অনেক রিফিউজি ক্যাম্পের ইতিহাস ও রিফিউজি ক্যাম্প বা রিফিউজি নিয়ে লেখা নানান উপন্যাস ও গল্পে দেখা যায়, কোনোক্রমেই এই চক্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। এত শিশু এক জায়গায়, তার ওপরে রয়েছে এতিম শিশু– তাছাড়া তারা একেবারে স্থান নিয়েছে মানব পাঁচারকারীদের রুটের কাছেই। এ কারণে এদের রক্ষা করা খুবই কষ্টকর হয়ে উঠবে

চোরাচালানীরা এখনও সেভাবে সক্রিয় হতে পারেনি। কারণ রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নানান লোকের আনাগোনা। সর্বোপরি দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা সেখানে অবস্থান নিয়েছেন। এঁরাও আর বেশি দিন থাকবেন না। রোহিঙ্গা ইস্যু ক্রমেই বাংলাদেশের একটি ইস্যু হয়ে পড়বে, তার ওপর আগামী বছর নির্বাচন- তাই সরকারও দেশের দিকে খেয়াল দেবার পাশাপাশি কতটা আর এ বিষয়ে বিদেশকে আকর্ষন করতে পারবে তাও একটি বড় প্রশ্ন। সব মিলে একটা পর্যায়ে গিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যু দেশীয়ও আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমের অবস্থানও হারাবে।

সে সময় বিদেশি সাংবাদিক ও দেশীয় সাংবাদিকদের অবস্থান কমে যাবে। আর এগুলো সবই ঘটতে যাচ্ছে আগামী শীতকালে। শীতে সমুদ্রপথ যেমন কুয়াশায় ভরা থাকে তেমনি সাগরও ঠাণ্ডা থাকে। তাই এ সময় মানব পাচারকারীরা সক্রিয় হবে শিশু পাচারের জন্যে। অন্যদিকে এই শীত রোহিঙ্গা শিশুদের জন্যে আসবে একটি মৃত্যু বা রোগাক্রান্ত হবার হিমশীতল দিনমালা হিসেবে।

এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক অঙ্গগুলো ও বাংলাদেশ সরকারের উদ্বাস্তু ব্যবস্থাপনা অঙ্গকে এখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে তারা এই বৃষ্টির পর শিশুদের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে; তাদেরকে তীব্র শীতের সময়েও সুরক্ষা দেবে। শীতের আগে তাদেরকে এই কুতুপালং থেকে ভাসানচরের স্বাস্থ্যকর জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তাই কীভাবে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু ঠেকানো যাবে, বিশ্ববিবেক কীভাবে তাদেরকে বাঁচাতে আসবে সেটা এখনই ভাবতে হবে। তা না হলে সকলের চোখের সামনে ঘটবে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু।

১৯৭১ সালের তিন মাসের একটি হিসাবে দেখা যায় যে, প্রায় ৫ লাখের মতো শিশু ও দুই লাখ বৃদ্ধ তখন মারা গিয়েছিলেন। এখানে ভিন্ন প্রসঙ্গ হলেও বলতে হয়, বাংলাদেশে এক শ্রেণির জীব আছে যারা মানুষের মতো দেখতে, তারা স্বীকার করে না যে, ১৯৭১এ তিরিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। একাত্তরে শরণার্থী শিবিরে তিন মাসে যদি সাত লাখ মানুষ মারা যান তাহলে নয় মাসে কতজন মারা যেতে পারেন? তারপরে দেশের ভেতরে চালানো গণহত্যায় মৃত্যুর হিসাব তো রয়েছেই।

যাক ও প্রসঙ্গ। ওই কথা যারা বলে তারা বাস্তবে মানুষ নয়। তাই তাদের প্রসঙ্গে বেশি কথা না বলাই ঠিক। এখানে শুধু একাত্তরের ওই মৃত্যুর হিসাবটি করতে বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গা শিশুদের বাঁচানোর প্রস্তুতির জন্যে। একাত্তরের চেয়ে এখন চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। ডায়রিয়ার চিকিৎসা অনেক সহজ। তারপরও রোহিঙ্গা শিবিরে তারা সে সুযোগ যাতে পায় তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। আর ঠাণ্ডাজনিত রোগ থেকে শিশুর মৃত্যু হয় বেশি। সেগুলো নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।

অন্যদিকে মানব পাচারকারীদের মতো না হলেও এক ধরনের ব্যবসায়ী আছে তারা এতিম শিশুদের নিয়ে এতিমখানা ও মাদ্রাসা খোলে বা যে এতিমখানা আছে সেগুলো চালাতে চায়। এদের হাতেও রোহিঙ্গা শিশুরা নিরাপদ নয়। তারা এই শিশুদের কেবল জঙ্গি বানায় তা নয়, তাদের সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় যে খবর আসে সেগুলোও সুখকর নয়। তাই তারাও যাতে সুযোগ নিতে না পরে সেটা দেখা প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা সমস্যা যে বাংলাদেশের জন্যে একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা হতে চলেছে এ নিয়ে আর কারও দ্বিমত করার সুযোগ নেই। এখন এই শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি তাদের শিক্ষার বিষয়টিও দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের শিশু শিক্ষা বিভাগগুলো কতটা সহায়তা করে তা নিয়ে এখন থেকেই চিন্তা শুরু করা দরকার। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

তবে সবার আগে রোদ, বৃষ্টি, কুয়াশা ও শীতের প্রকোপ থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের রক্ষা করাটাই হল জরুরি।