একটি নির্দিষ্ট পেশার প্রতি গুরুত্ব এবং ভবিষ্যত বিপদ

মো: ফজলুল করিম
Published : 21 Jan 2018, 02:39 AM
Updated : 21 Jan 2018, 02:39 AM

পেশাগত প্রতিযোগিতা থাকা ভাল। প্রতিটি পেশায় নিয়োজিত মানুষের মধ্যে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অবশ্যই ভালো। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কোন একটি পেশাকে অধিকমাত্রায় গুরুত্ব দেবার কারণে অন্যান্য পেশার প্রতি সামাজিক অবমূল্যায়ণ হয়, এটা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে।

বাংলাদেশে বিসিএস চাকরী এখন সোনার হরিণ। এটা সত্য, বাংলাদেশে প্রশাসনিক জবের মধ্যে বিসিএস ক্যাডারদের মুল্য বেশি। কারণ তাদেরকে একটি বিরাট প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আসতে হয়, যদিও এ প্রতিযোগিতা উচ্চশিক্ষায় সংশ্লিষ্ট পাঠের সাথে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নয়। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনা করার মত/ মুখস্থ করার মত ধৈর্য্য যাদের থাকে তাদের জন্য বিসিএসের দ্বার অবশ্যই খোলা থাকে। যদিও এর মাধ্যমে আমাদের বিসিএসে উত্তীর্ণ বন্ধুদের খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নাই। কারণ, তারা রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আসেন। এখানে প্রচুর মেধাবী মুখ আমরা দেখি, যারা অন্যান্য পেশায়ও তাদের দ্যুতি ছড়াতে পারতেন খুব সহজেই। তাই বিসিএসের পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নাই। আমার মাথা ব্যথার কারণ হলো, শুধুমাত্র একটি পেশাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা কতটা যৌক্তিক?

বাংলাদেশে এই সেদিন পর্যন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব ভাল ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়াটা অনেক সম্মানের মনে করতেন। তাদের স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে রাষ্ট্রের সেবা করবার। এখনও আমি জানি, বেশির ভাগ ছাত্রের মনে একই স্বপ্ন থাকে। কিন্তু এখন অধিক মাত্রায় বিসিএসের প্রতি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়র প্রথম হওয়া ছাত্রেরও স্বপ্ন দেখার পেছনে রাষ্ট্র্রের একমুখী চিন্তা পুরোপুরি দায়ি। এর কারণে, বাংলাদেশে মেধার চর্চা ধীরে ধীরে কমে যাবে সন্দেহ নেই। এমনিতেই বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বাজেট খুবই কম। তার উপর সরকারের পেশাগত আচরণের বৈষম্যের কারণে শিক্ষা খাতের প্রতি এক ধরনের হেয় মনোভাব তৈরি হয়েছে।

আমাদের বিশ্বমানের গবেষণার জন্য কোন ধরনের পরিকল্পনা নেই। শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কোন তাড়া নাই। যখন একজন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার গাড়ি/রান্না করার জন্য হাজার হাজার টাকা দেওয়া হয়, তখন একজন শিক্ষকের জরাজীর্ণ মুখের ছায়া দেখে আমরা লজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনা। তাছাড়া শুধু শিক্ষা খাতকেই অনাকর্ষণীয় করা হয়েছে তা নয়। প্রশাসন এবং পুলিশ ছাড়া অন্যান্য পেশারও অবস্থাও একই। বুয়েট/মেডিক্যাল থেকে পাশ করে পেশাগত বিসিএস ক্যাডার হয়ে তাদের এমনকি একটি কলেজ থেকে পাশ করা প্রশাসনের ব্যক্তির কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়।

এভাবে চলতে থাকলে শুধুমাত্র পাওয়ার কেন্দ্রিক জব ছাড়া অন্যান্য জবের প্রতি মেধাবীদের আগ্রহ সংগত কারণেই কমে যাবে। তাছাড়া আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও এর জন্য দায়ি। আমাদের সমাজ এমনভাবে তৈরী হয়ে যাচ্ছে যে, শক্তি/টাকা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে মেধার মূল্যায়ণ হয়না। আর এটা হবেই না কেন? সরকার যখন একজন সচিব বা এর সম-মর্যাদার প্রশাসনের লোকজনের জন্য সবকিছু করছে, গাড়ি দিচ্ছে/বাড়ি দিচ্ছে/তাদের জবাবদিহিতায় ছাড় দিচ্ছে, তখন সাধারণ মানুষ কেন তাদের মূল্যায়ন করবেনা? কেন ছাত্ররা শুধুমাত্র বিসিএস সোনার হরিণ মনে করবেনা?

অথচ, আমাদের উচিত ছিল একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখা। আমরা যদি একটি উদাহরণ দেই, তাহলে বুঝতে পারব আমাদের সমস্যা কত গভীরে। আমরা প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর/ভারত/থাইল্যান্ডে যাই। কারণ, ওখানে বিশ্বমানের সেবা দেওয়া হয়। আমাদের দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যায় বিদেশে। কিন্তু আমরা কখনও প্রশ্ন করিনি, আমরা কেন পারছিনা? আমাদের মেধার কোন অভাব নাই, তারপরেও আমরা পারছিনা। কারণ আমাদের সরকারের কোন পরিকল্পনা নাই। আমরা কি বিশ্বমানের গবেষণার জন্য কোন চিন্তা করতে পারিনা? আমরা কি আমাদের বিখ্যাত স্কলারদের দেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে পারিনা? ইতিমধ্যে যে কাজ ভারত/চীন শুরু করেছে। চীন গবেষণাপত্র প্রকাশনায় ইতিমধ্যে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে গেছে। তারা কেন এত কিছু করছে শিক্ষা/গবেষণার জন্য? তারা কি বোকা? নাকি আমাদের বোকামির কারণে আমরা একদিন হারিয়ে যাব অন্ধকার সমাজে এ প্রশ্ন আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে/ বিশ্ববিদ্যালয়র শিক্ষকদের মধ্যে নেই। রাজনীতির শিকলে সব হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের।

আমাদের সরকারকে এখনই উপলব্ধি করতে হবে, একটি দেশের উন্নয়নের জন্য জ্ঞানভিত্তিক সমাজের বিকল্প নাই। প্রতিটি পেশার আলাদা আলাদা গুরুত্ব আছে এটা সরকারকে বুঝতে হবে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্তু বিশ্বমানের শিক্ষা দেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারে এটা আমাদের মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। শুধুমাত্র একটি পেশার মানুষ নিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়- এটি অনুধাবন না করতে পারলে আমাদের সত্যিই বিপদে পড়তে হবে।

লেখক: ড. মো: ফজলুল করিম, শিক্ষক ও গবেষক, কুমামতো বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।