অধ্যাপক জাফর ইকবালের উপর আক্রমণ এবং ব্যক্তিগত উপলব্ধি

মো: ফজলুল করিম
Published : 4 March 2018, 04:16 AM
Updated : 4 March 2018, 04:16 AM

অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যার এর সাথে আমার একবারই কথা হয়েছে। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর ২০০৭ সালে সেন্টার ফর পলিসি আয়োজিত এক ডায়ালগে টাঙ্গাইলে স্যার এর সাথে কথা হয়েছিল। জিন্সের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা মানুষটির স্মার্টনেস দেখে আমার ঈর্ষা লেগেছিল। বয়স যেন তার তারুণ্যের কাছে পরাজিত। অসম্ভব ভালো লেগেছিল এই মানুষটিকে।

প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো আদর্শে বিশ্বাসী। আদর্শবিহীন মানুষ আর যাই হোক পরগাছা ছাড়া আর কিছুই নয়। অধ্যাপক জাফর ইকবাল তার চিন্তা চেতনায় একটি মজবুত অবস্থান তৈরী করেছেন। তরুন প্রজন্মের বিরাট অংশকে তাঁর লেখনি দ্বারা প্রভাবিত করেছেন। মু্ক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম নিয়ে তাঁর লেখা তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে গেছে অন্য মাত্রায়। তিনি হয়েছেন হাজার হাজার তরুণের আইডল। তিনি যেভাবেই তাঁর বিশ্বাসকে উপস্থাপন করে থাকুন, তাঁর দেশপ্রেম নিয়ে কারও সন্দেহ নাই। তিনি সবসময় চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসের রাজনীতি হবে বাংলাদেশে।

ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা একজন মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। একজন মানুষ কিভাবে ধর্মকে তার জীবনের সাথে যুক্ত করবেন তা একান্তই তার ব্যক্তিগত উপলব্ধি। এটা একটি বিশ্বাসের ব্যাপার। একটি বিশ্বাসকে যুক্তি ও তর্কের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা এবং ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার মাধ্যমেই ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করা যায়। জোর করে/হত্যা করে মানুষকে বিশ্বাসী করা যায়না। এর মাধ্যমে জাফর ইকবালকে সরিয়ে দেওয়া গেলেও তিনি যে আদর্শের স্রোত ছড়িয়ে দিয়েছেন তাকে থামানো যাবে কি? ড. জাফর ইকবালের ধর্মীয় মতামত নিয়ে বুদ্ধি খরচ না করে আপনার চোখ ও মাথাকে বিশ্বাস করলেই তো হয়। আপনাকে কেন প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে হবে?

আমাদের সমাজে হিংসা-প্রতিহিংসা যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে শংকিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা প্রতিনিয়ত এই চর্চার মাধ্যমে আমাদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে চাই।আমাদের রাজনীতি থেকে ধর্মনীতি সব জায়গায় জোর করার নীতি চলে আসছে, যা ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের সর্বস্তরে। শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠার পরিবর্তে ঘৃণা এবং প্রতিহিংসা শিখে বড় হচ্ছে।ভালেবাসার মাধ্যমে যে সমাজ পরিবর্তন করা যায় তা আমরা ক্রমেই ভুলে যাচ্ছি।

শিশুদের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা কেন আমরা শেখাতে পারছিনা এ নিয়ে আমরা কোন চিন্তা করছিনা। আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থাই বা কেন ভালোবাসার বীজ বপন করতে পারছেনা, এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের শিক্ষা কাঠামোর দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা জরুরী। আমার সবসময় মনে হয়েছে একটি দেশে একটি ইউনিফর্ম জাতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প নাই। আমরা মসজিদ/মাদ্রাসা/স্কুল/কলেজ সব জায়গায় একই সিলেবাস করতে পারি। এসএসসি মানে শুধুই এসএসসি। এখানে অন্য কিছুকে সমতুল্য করতে গেলেই আলাদা আলাদা শাখা থাকবে, আলাদা আলাদা মত থাকবে। সরকারী নিয়ন্ত্রণে সবজায়গায় একই রকম শিক্ষা পদ্ধতি থাকলে সারা বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক চিন্তাভাবনায় খুব বেশী ফারাক থাকবে না।

আমি জাপানের মানুষের মৌলিক ভাবনা দেখেছি। আমি যে জায়গায়ই যায় একই রকম চিন্তা চেতনা। দেশপ্রেম কোন তফাত নাই। সবার জাতীয় শত্রু এক কিংবা জাতীয় বন্ধু এক। রাষ্ট্র ওদের শেখাতে পেরেছে একভাবে চিন্তা করা। এখানে দেখি এখানে কেউ কাউকে বিরক্ত করেনা। এখানে যে যার বিশ্বাসের উপর চলছে। এখানেও অনেক বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু কেউ কাউকে আক্রমণ করেনা। বাচ্চাদের ছোট বেলা থেকে মানুষকে ভালোবাসার ও অন্য মত শ্রদ্ধা করতে শেখানো হয়েছে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি ভিন্নমত ঠেকাতে একই ধরণের আক্রমণ বাংলাদেশে চলছে ধারাবাহিকভাবে। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো একের পর এক আক্রমণ করে যাচ্ছে। পুলিশ পাহারায় থেকেও জাফর ইকবাল স্যার আক্রমণের শিকার হলেন। তার মানে শুধুমাত্র পুলিশ দিয়ে একটি রাষ্ট্রকে নিরাপদ করা কঠিন। এজন্য দরকার একটি বৃহৎ পরিকল্পনা এবং তার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন আনা। ঘৃণা শব্দটি থেকে মুক্ত করবার সকল পদক্ষেপ আমাদের নিতে হবে। রাষ্ট্রকে ভালেবাসার বীজ বপন করতে হবে। রাজনীতিতে তৈরি করতে হবে পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবার উদাহরণ। আমরা যত দ্রুত একটি জাতি হিসেবে নিজেদের একত্রিত করতে পারব, যত দ্রুত পরস্পরকে ভালবাসতে পারব তত তাড়াতাড়ি আমাদের মঙ্গল হবে।