আর কত কলম সৈনিকের প্রাণ চাই?

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ এর ব্লগ
Published : 12 May 2012, 08:25 AM
Updated : 12 May 2012, 08:25 AM

বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মিশুক মনির ও চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের রক্ত আজও শুকায়নি। সাংবাদিক দীনেশ দাসের চলে যাওয়া এখনো মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার, সহকর্মী ও গুণগ্রাহীরা। সত্য অনুসন্ধানে আরেক লড়াকু সৈনিক সাংবাদিক নিখিল ভদ্রের অঙ্গহানি প্রতিনিয়তই পীড়া দিচ্ছে তার ব্যক্তিজীবনকে। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে সড়ক দুর্ঘটনার বলি হয়ে গোটা সাংবাদিক মহলে শোকের ছায়া নামিয়ে আনলেন ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের সিনিয়র রিপোর্টার বিভাস চন্দ্র সাহা ও বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক মতবাদের ফটো সাংবাদিক শহীদুজ্জামান টিটু। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে শুক্রবার ঢাকায় পৃথক দু'টি মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারান তারা।

একই দিনে সিলেটে এক সড়ক দূর্ঘটনায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামীমসহ ৮ জন নিহত হন। গাইবান্ধায় ট্রাকচাপায় একই পরিবারের ৪ জনসহ ৫ জন, চট্টগ্রামে ট্রাকচাপায় এক পরিবহন শ্রমিক এবং সিরাজগঞ্জে এক পথচারীর মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে এসেছে। গণমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, শুক্রবার সারা দেশে সড়ক দূর্ঘটনার কবলে পড়ে নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়েছে ১৭টি তরতাজা প্রাণ। সংখ্যাটি রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। একদিনেই ১৭ জন! সড়ক দূর্ঘটনার এ চিত্র প্রতিদিনকার। এমন কোন দিন হয়তো খুঁজে পাওয়া কষ্ট হবে, যেদিন একটিও প্রাণ বলি হয়নি যমদূত গাড়ির চাকার নিচে। কী নিদারুণ বাস্তবতা!

শুক্রবারের পৃথক পাঁচটি সড়ক দূর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও ২ জন কলম যোদ্ধাকে। সেই সঙ্গে হারিয়েছি, ১৪টি নিরীহ প্রাণ। এঘটনা নতুন নয়। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও অঙ্গহানি হয়েছে একজনের।

ফ্ল্যাশব্যাক:

এক: দিনটি ছিল ১৩ আগস্ট, ২০১১। তারেক মাসুদের নতুন চলচ্চিত্র কাগজের ফুলের চিত্রায়নের জন্য স্পর্ট দেখে ফেরার সময় ঢাকা – আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ ঘিওর উপজেলাধীন জোকা নামক স্থানে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনীরসহ পাঁচ জন নিহত হন। যাত্রীবাহী কোচ ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখী সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা ঘটে। অসাধারণ প্রতিভাধর এই দুই ব্যক্তিত্বের অকাল প্রয়াণের খবরে শোকের মেঘে ছেয়ে যায় মিডিয়া আকাশ। কাগজের ফুলের স্বপ্ন রয়ে যায় কাগজেই।

দুই: গত ২৮ ডিসেম্বর কর্তব্যের খাতিরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে বিআরটিসির একটি বাসে চড়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে আসছিলেন দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার নিখিল ভদ্র। বাসটি প্রেসক্লাবের সামনে নির্দিষ্ট স্থানে না থামিয়ে ডিভাইডারের পাশে থামিয়ে দেন চালক। নিখিল দা সেখানে নেমে প্রেসক্লাবের দিকে যেতে চাইলে পেছন থেকে বিআরটিসির আরেকটি বাস তাকে ধাক্কা দেয়। এ সময় নিখিল ভদ্র রাস্তায় পড়ে যান, ডান পা চলে যায় বাসের পেছনের চাকার নিচে। নির্দয় চালক সোহেল বাস না থামিয়ে চালিয়ে দেয় তার পায়ের ওপর দিয়েই। নিখিল দা'র আত্মচিৎকারে আশপাশের মানুষ বাসটি আটক করে তাকে উদ্ধার করে। ততক্ষণে নিখিল দা'র দেহ থেকে ডান পায়ের গোড়ালি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এরপর তাকে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হলে সেখানে তার ডান পায়ের হাটু থেকে নিচ পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়। সদাকর্মতৎপর মানুষটি অযাচিত পঙ্গুত্ববরণ করে নেন জীবনের বাকিটা সময়ের জন্য। সেদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দু'মাসের কন্যা ইন্দুমালাকে বুকে নিয়ে নিখিল দা'র কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য কখনও মুছবে না সহকর্মীদের স্মৃতি থেকে।

তিন: এর মাত্র ১২দিনের মাথায় নতুন করে শোকের মাতমে ভাসে মিডিয়া পাড়া। ৯ জানুয়ারি মেয়ে অথৈকে স্কুলে রেখে নিজ মটরসাইকেলে করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আসার সময় কাকরাইলে টিসিবির ঘাতক বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ পাখি উড়ে যায় দৈনিক আমাদের সময়ের সাংবাদিক দীনেশ দাসের। সদাপ্রাণবন্ত মানুষটি চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যায় বুকের মানিক অথৈ, প্রিয় স্ত্রী ও সহকর্মীদের কাছে । মটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে বাবা যে আর কোন দিনই স্কুলে নিয়ে যেতে পারবে না, সে কথা মেনে নিতে পারছিলো না অথৈ। তাই কিছুক্ষণ পর পরই ডুকরে কেঁদে উঠছিল সে।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার পর আন্দোলন ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা সাংবাদিক পাড়া। পত্রিকার পাতা থেকে শুরু করে রাজপথ, টিভি পর্দা থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ সর্বত্রই তুলে ধরা হয় সড়ক দূর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র। রাজপথে সাংবাদিকের রক্ত ঝরানোর বিচারের দাবি ওঠে সর্বত্র। রাষ্ট্রযন্ত্রের "দুঃখ প্রকাশ" ও "বিচারের আশ্বাসে" সাময়িকভাবে আন্দোলন কর্মসূচি ইস্তাফা দেয়া হলেও, এসব ঘটনার কোনটিরই বিচার মেলেনি আজও। আশ্বাস শুধু আশ্বাসই রয়ে গেছে। বাস্তবতার মুখ কবে দেখবে তারও কোন ইয়াত্তা নেই।

সময়ের ব্যবধানে ব্লাকহোলে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে এসব ঘটনার বিচার। অতীতেও বিভিন্ন সময় সাংবাদিক হত্যার একটিরও বিচার হয়নি স্বাধীন এই দেশে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্বে এ যাবৎকালে যারাই ছিলেন, কারো সময়েই জোটেনি সাংবাদিকের রক্তের সঠিক মূল্য। কলম যোদ্ধার রক্তে বার বার লাল হয়েছে রাজপথ। শ্রাবণ ধারায় তিলে তিলে মুছে গেছে রাজপথের সেসব চিহ্ন। কিন্তু স্বজন ও প্রিয়সহকর্মীদের হৃদয়ে আজও অম্লান সেই ক্ষত।

আর কত প্রাণ রাজপথে বিলিয়ে দিলে টনক নড়বে রাষ্ট্রযন্ত্রের? বাবার ভালবাসা হারা অথৈ আদৌ কি পাবে তার প্রিয় বাবা হত্যার বিচার? নিখিল কন্যা ইন্দুলেখা বড় হয়ে কি দেখতে পাবে বাবার পা পিষে দেয়া সেই ঘাতকের বিচার? বাংলাদেশে ইলেক্ট্রনিক সাংবাদিকতার অগ্রনায়ক মিশুক মনিরের রক্তের কোন মূল্যই কি নেই? চলচ্চিত্র নির্মাণ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে তুলে ধরার প্রয়াসে তারেক মাসুদের ছুটে চলার কোন স্বীকৃতি কি দেবে না বিচারবিভাগ? সাংবাদিক বিভাসের স্ত্রী তপতী সাহার আর্তনাদের আওয়াজ কি কখনই পৌঁছবে না বিচারকের কানে ? রাজপথে পড়ে থাকা মফস্বলে দূরন্ত ছুটে চলা আলোকচিত্রী শহীদুজ্জামানের লাশের ছবিই কী তার স্বজনের শেষ শান্তনা? কলম সৈনিকদের রক্তের কোন মূল্যই কি নেই রাষ্ট্রের কাছে? আর কত প্রাণ চাই?

(লেখক : সাংবাদিক, অনলাইন সংবাদপত্র ঢাকা টাইমসটোয়েন্টিফোর ডটকম।)