জবাব তোমায় পেতেই হবে

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ এর ব্লগ
Published : 31 May 2012, 03:45 AM
Updated : 31 May 2012, 03:45 AM

দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতিতে লেজে গোবরে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ২০০৬ সালে গদি ত্যাগ করে চারদলীয় জোট সরকার। যদিও এর আগে থেকেই সরকার হটাতে আন্দোলনে তত্পর ছিল তত্কালীন বিরোধীদল আওয়ামীলীগ। কিন্তু তার পরও ক্ষমতার মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত গদিতে অনড় ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদল সরকার।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর চারদলীয় জোট ক্ষমতা থেকে সড়ে দাঁড়ানোর পর নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি একজন তত্ত্বাবধায়কের ওপর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার কথা ছিল। যে সরকার ৯০ দিনের জন্য দেশ পরিচালনা দায়িত্ব নেবেন। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও ছিল শেষ পর্যায়ে। কিন্তু তত্কালীন বিরোধীদলের তোপের মুখে অবশেষে ভেস্তে যায় সব প্রস্তুতি। যদিও আওয়ামীলীগের দাবি ছিল বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসতে নিজেদের লোক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় বসাতে চেয়েছিল। বিরোধীদল হিসেবে আওয়ামীলীগের কঠোর আন্দোলনের কারণে সব নীল নকশা ভণ্ডুল হয়েছে। এর পর দেশের রাজনীতিতে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দেখা দিয়েছিল; তা কারো অজানা নয়। দেশে বড় দুই রাজনীতিক দলের রাজপথে পাল্টাপাল্টি অবস্থান ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কথা এখনো ভুলে যাননি কেউ।

রাজনীতিক দলগুলোর অঘোষিত যুদ্ধকে সামাল দিতে দেশ পরিচালনার মসনদে আসীন হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। উত্তরপাড়া (সেনাবাহিনী) সমর্থিত এ সরকার সুবিধা বুঝে ক্ষমতা আকড়ে ছিল দু বছর। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দেশের সরকার ব্যবস্থার ইতিহাসে অন্তবর্তীকালীন সরকার হিসেবে নাম লেখালো উড়ে এসে জুঁড়ে বসা ওই সরকার। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সময়কালকে ফখরুদ্দিনী আমল হিসেবে বেশি পরিচিত। সুশীল সমাজের কাছে তা ১/১১ সরকার।

তত্ত্বাবধায়কের আদলে সামরিক বাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকারের সময়ে দেশে ছিল তিন উ-আ'র রাজত্ব। একজন হচ্ছেন, তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, সরকার প্রধান ফখরুদ্দিন আহমেদ এবং সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ। এ তিন উ-আ'র দাপটে দেশের হেভিওয়েট রাজনীতিকরা যে কি পরিমানে উহ্-আহ্ করেছেন তা দেশের মানুষ আজীবন মনে রাখবে। কী দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হয়েছে তাদের। পেদানির ভয়ে আয়েশালয় ছেড়ে ম্যানহোলে রাত কাটাতে হয়েছে অনেককে। কিন্তু তাতেও শেষ উদ্ধার হয়নি। ব্যবসায়ীর কোটি টাকার গাড়ি রাস্তা পড়েছিল বেওয়ারিশ হয়ে। দু নেত্রীকে এক ঘাটে জল খাওয়ানোর মতো অসাধ্যকে সাধন করা হয়েছিল। এসব কারণে ফাটাকেষ্ট টাইপের এ সরকার অল্পদিনেই জয় করেছিল সাধারণ মানুষের মন। কাউকে সেসময় এও বলতে শুনেছি-'ফখরুদ্দিন যদি সব সময় দেশটা চালাইতো; তাইলে দেশটাতে শান্তি ফিরে আসতো।' এটা ছিল অতি সাধারণ কিছু মানুষের চাওয়া। তারা জানতো না, দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তা করার পাশাপাশি দেশের ছাত্র সমাজের রাজনীতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে তৎপর ছিল সেনা সমর্থক গোষ্ঠী। তারা হয়তো শুনেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র নির্যাতনের উপাখ্যান। কিংবা অতটা গুরুত্ব পায়নি গণমাধ্যমের বাক স্বাধীনতা হরনের বিষয়টি। সর্বত্রই ছিল অজানা এক আতঙ্ক। ফের যেন বুটের ছাপ পড়তে যাচ্ছিল স্বাধীন এ দেশটির গৌরবময় ইতিহাসে। গণতন্ত্রের টুটি চিরতরে চেপে ধরার পায়তারা চলছিল।

কিন্তু সর্বকালের মুক্তির দূত সদা সজাগ গণমাধ্যমের অগ্রণী ভূমিকার বদৌলতে অবশেষে নির্বাচনের দাবি ওঠলো। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জাতিকে সচেতন করে তুললো। ম্যানহোলের ঢাকনা সরিয়ে বেরিয়ে এলেন রাজনীতিক নেতারা। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মিছিলে দেশের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজ সবাই এক হয়ে কণ্ঠ ছাড়লো। তত্ত্বাবধায়কের নামে সেনা শাসন চাই না। চাই নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সর্বত্রই ধ্বনিত হয়েছিল সেই দাবি।

গণআন্দোলনের মুখে অবশেষে একে একে মুক্তি পেলেন দুই নেত্রী। অবশেষে দিন তারিখ ঠিক হলো নির্বাচনের। অনেকটা বাধ্য হয়ে উত্তরপাড়া রেখে সংসদ অভিমুখে যাত্রা করলো তৎকালীন ফখরুদ্দিন সরকার।

নির্বাচন হলো। যুদ্ধাপরাধীর বিচার আর প্রযুক্তি ও মেধার সর্বোত্তম প্রয়োগের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে অভাবনীয় জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এলো বর্তমান মহাজোট সরকার। আর স্বাধীনতা বিরোধীদের শরিকদল চারদলীয় জোটের ভাগ্যে জুটলো ক্ষমতায় থাকাকালে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতিতে নম্বর ওয়ান হওয়ার ফল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের কাছে নিরঙ্কুশ জয় যেমন অকল্পনীয় ছিল; তেমনি জনপ্রিয়তার চরম ধসের মুখে পড়ে কঠিন শিক্ষা পেতে হয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে।

কিন্তু যে স্বপ্ন চোখে নিয়ে দেশের মানুষ মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, তা এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে শুরু করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে উজ্জীবিত তরুণ সমাজ জীবনের প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করে যে সরকারের হাতে দেশের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিল, সে সরকারের ব্যর্থতা তাদেরকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি হতাশার পাল্লাকে ভারী করছে।

ঠিক একইভাবে মর্মাহত হতে হচ্ছে মুক্ত কন্ঠে কথা বলার অধিকার চাওয়া গণমাধ্যমকে। রাষ্ট্রযন্ত্রের একের পর এক অনাচার নির্যাতনের বোঝা কাঁধে নিয়ে নুয়ে পড়ার জো হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা সজাগ কলম যোদ্ধাদের। যা কখনো কল্পনাতে আসেনি, ঠিক তেমনটাই ঘটছে কলম সৈনিকদের ভাগ্যে। হন্তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে গণমাধ্যমের প্রাণ। দুবৃত্তের কালোহাতের ছাপই নয়; রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্ষীবাহিনীর বুটের ছাপও পড়ছে সাংবাদিকদের বুকে। অন্যায়ের প্রতিবাদকারী কণ্ঠের ভোকাল কড ছিড়ে নেয়া হচ্ছে নির্মমভাবে। হত্যা-নির্যাতন-জুলুমের বিচার চেয়ে ভাগ্যে জুটছে রাষ্ট্রের নিদারুণ উপহাস।

বিনাদোষে-বিনেঘাটে পুলিশিবাহীনির কাছে পথে-পথে লাঞ্চিত, নির্যাতিত হচ্ছে সাংবাদিকরা। এ অন্যায়ের বিচার ও প্রতিকার দাবি করে মিলছে-"পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরুত্বে থাকুন"-জাতিয় উপহাসমূলক পরামর্শ। পুলিশের হাতে শ্লীলতাহানি হওয়া মেয়েটির বাবা-মা যখন রাষ্ট্রের দরজায় কড়া নেড়ে বিচার দাবিতে অশ্রু ঝড়ান; তখন রাষ্ট্রের অযৌক্তিক ছাফাই কীর্তণ তাদের বুকে চাবুকের আঘাত হানে। যখন তারা কোন সাহারাকে বলতে শোনেন-"পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।" দ্বিতীয়বার এমন কথা শোনার চেয়ে নিজেকে চিরতরে বধির করে দেয়া ছাড়া কী আর করার থাকে?

এতোদিনে এ কথা দিবালোকের মতো পরিস্কার যে, নিজের শোবার ঘরে দুবৃত্তের হাতে প্রাণ দিতে হবে বলেই হয়তো উত্তরাপাড়ার বুটের আঘাত থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করেছে গণমাধ্যম। রাজপথে দানব যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হতে হবে বলেই হয়তো ল্যাণ্ডক্রুজারের হেভি হুইলের নিচ থেকে বের করা হয়ছে গণতন্ত্রকে। পুলিশের হাতে নির্যাতিত হতে হবে বলেই হয়তো বেওনেটের ধার থেকে রক্ষা করা হয়েছিল স্বাধীন দেশের মানচিত্রকে। 'নিরাপদ দূরুত্বে' থাকার পরামর্শ শুনতে হবে বলেই হয়তো ১/১১ দানবের থাবা থেকে রাজনীতিকে নিরাপদ দূরুত্বে এনেছিল কলম সৈনিকরা। নিজ কর্মক্ষেত্রে সন্ত্রাসীহামলার শিকার হয়ে জমাট রক্তের মানচিত্র রচনা করতে হবে বলেই সেদিন কলমের জমাট কালিকে তরল করেছিল সাংবাদিকরা। শ্লীলতাহানির বিচার চেয়ে 'অনেক ভাল হয়েছে' মন্তব্য শোনার জন্যই হয়তো দুই তৃতীয়াংশ জনগণের সমর্থনের মালা গলায় পরিয়ে জনপ্রতিনিধিকে সংসদে পাঠিয়েছিল অসহায় তরুণীর জনক-জননী। যুদ্ধাপরাধীর বিচার নামের কচ্ছপ দৌড়ের সাক্ষী হয়ে রইবে বলেই জীবনের প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের গৌরোজ্জ্বল ইতিহাসকে বুকে আঁকড়ে বড় হওয়া তরুণরা।

বোদ্ধাজনদের মতে, স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্রপ্রহরীর ভূমিকায় থাকে চৌকোশ স্বসস্ত্র সৈনিকদল। তেমনি দেশের নাগরিকদের অধিকার রক্ষা ও গণতন্ত্রকে সুসংহত রাখতে কলম হাতের যোদ্ধাদের সংগ্রাম অবিরাম চলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম যোদ্ধাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে অনন্তকাল। থামবে না এ যুদ্ধ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্ব ইচ্ছাতেই কাঁধে তুলে নেবে উত্তরসূরীদের রেখে যাওয়া দায়িত্ব। অন্যায়, জুলুম, নির্যাতনের প্রতিবাদ হবেই হবে। দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেবে। অস্ত্র আর গোলাবারুদের মুখে কলম কখনও দমবে না। জবাব তোমায় পেতেই হবে।

গানের ভাষায়- এইদিন দিন না; আরো দিন আছে।/ এইদিন নিয়ে যাবে সেইদিনের কাছে।

(ছবি সূত্র : ইন্টারনেট ও ফেসবুক)