বন্যাকবলিত এলাকায় প্রাণ রক্ষায় তারুণ্যের জোয়ার

মাহমুদুল হাসান শাকুরী
Published : 31 August 2017, 04:00 PM
Updated : 31 August 2017, 04:00 PM

টকশো কিংবা চায়ের আড্ডায় আলোচনার মুখ্য বিষয় দেশের আগামী প্রজন্ম কোন পথে হাঁটছে। তারা আজ ধ্বংসের পথে বলে অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, মাদকের করাল গ্রাসে নিজেদের দেশপ্রেম আর মূল্যবোধ হারিয়েছে। এমন অভিযোগ করে আগামী প্রজন্মের আলোর দিশা দেখছেন না অনেকেই। কিন্তু এখনো সেই আলো সবটুকু নিভে যায়নি বলে আশাবাদও ব্যক্ত করেন কেউ কেউ।


ছবি: খাবার স্যালাইন বানাচ্ছে হিমু পরিবহনের কর্মীরা

তারা বলছেন, দেশের তরুণ প্রজন্ম এখনো বেচে আছে। সব শেষ হয়ে যায়নি। দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে তাদের অস্তিত্বের বড় প্রমাণ।

মানুষ আর মানবতার জন্য তারা মাঠে-ঘাটে, গলির মোড়ে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ত্রাণ সংগ্রহ করছে। কেউ কেউ পারিবারিকভাবেও সাহায্য নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন। ত্রাণ সংগ্রহের কাজে তরুণদের সবচেয়ে বড় সহায়ক ছিলো বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম। যার মাধ্যমে তুলে ধরছে দুর্গত এলাকার দূর্ভিক্ষের চিত্র। আর সহায়তা চেয়েছে মানবতাবাদীদের কাছে। পেয়েছেও কাঙ্খিত সাড়া।

বন্যা দুর্গতদের নিয়ে কাজ করছেন এমন অধিকাংশ তরুণরা জানিয়েছেন, বন্যা দূর্গত মানুষের জন্য শুকনো খাবার, খাবার স্যালাইন প্রাথমিক চিকিৎসার ঔষধ, নগদ অর্থ, চাল-ডাল আবার অনেকে ঈদ আনন্দের কথা চিন্তা করে সেমাই চিনি দিয়ে সহায়তা করার চেষ্টা করছেন তারা।


ছবি: পথ শিশুও তাণ সহায়তা বক্সে তার শেষ সম্বল দিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বসে শরিয়তপুরের পদ্মার ভাঙ্গন কবলিত মানুষের সাথে ঈদ আনন্দ করার পরিকল্পনা করছেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা হয়। তাদের একজন সুমন বেপারী বলেন, আমরা চাইলেই সব করতে পারি। ভাঙ্গতেও পাড়ি আবার গড়তেও পাড়ি। আমরা তরুণরা মানুষের ধারণা পাল্টে দিতে কাজ করতে চাই। এদেশের মানুষ যেন আর না বলে যে, আগামীর প্রজন্ম নৈতিক অবক্ষয়ের কবলে পড়ে দেশপ্রেম হারিয়েছে। আমরা কাজ করে প্রমাণ করতে চাই আমরা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত।

ছবি: গেল ঈদে জামাল মাদবরের নেতৃত্বে চাঁদনী মঞ্চের উদ্যোগে নতুন জামা বিতরণ

এই আয়োজনের আরেক উদ্যোক্তা জামাল মাদবর বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি বেশি হয়েছে। কিন্তু পদ্মা নদী শরিয়তপুরের মানচিত্র পরির্তন করে দিচ্ছে। অথচ দেখার কেউ নাই। তাই আমরা এবার পয়লা সেপ্টেম্বর গত ঈদেরমত পদ্মার ভাঙ্গন কবলিত শতাধিক পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপন করতে চাই। তাদেরকে সেমাই-চিনি, চাল-ডাল, তেল আর বাচ্চাদের মেহেদী দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি এজন্য মানুষের কাছে অনবরত সহায়তা চেয়ে যাচ্ছি।

গত সোমবার দুপুরে রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে তরুণ বন্যার্তদের জন্য সাহায্য সংগ্রহের বক্স নিয়ে ঘুরছে। সেখানে কথা হয় কয়েকজনের সাথে। তারা জানান পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে মানুষের মাঝে সচেতনতা গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এমন কিছু তরুণ চেঞ্জ দ্যা আর্থ ফর পিপলস নামে একটি সংগঠন চলতি বছর প্রতিষ্ঠা করেছে।

ত্রাণ সহায়তা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সংগঠনের সদস্য জাহিদ হাসান বলেন, আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ করতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রেরণা নিয়ে মানুষের জন্য কিছু করার প্রচেষ্ট থেকে এই সহায়তা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হওয়া।

সংগঠনের সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, আমাদের এটাই প্রথম সহায়তা কার্যক্রম। বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি সবার কাছ থেকে। এমনকি অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের কাজকে সমর্থন করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একজন পথ শিশু তার একদিনের আয়ের পুরোটা দিয়েছিলেন আর আজ একজন বৃদ্ধা ভিখারী সদরঘাটে আজ সহায়তা কাজে অংশ নিয়ে আমাদের কিছু টাকা দিয়েছেন। এমনকি অনেক স্কুল পড়ুয়া শিশুরাও তাদের টিফিনের টাকা আমাদের সহায়তা বক্সে দিয়েেএগিয়ে এসেছেন। আমরা আগামি ৩১ আগস্ট শরিয়তপুরের পদ্মার ভাঙ্গনকবলিত জাজিরায় শতাধিক পরিবারের মাঝে নগদ অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি।

ছবি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে পরিকল্পনা করছে জাহিদ-হাসানরা

কথা সাহিত্যিক হূমায়ুন আহমেদের ভক্তদের সংগঠন হিমু পরিবহণ ভিন্ন একটি উদ্যোগ নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তাদের সমন্বয়ক আহসান হাবিব মুরাদ বলেন, নিজেদের সাধ্যমত প্রচেষ্টা চালিয়ে আমরা ৫০ হাজার খাবার স্যালাইন হাতে বানিয়ে বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তাকারী সংগঠনকে সাহায্য করার কাজ হাতে নিয়েছি। এর এর বাইরে ফরিদপুরে দূর্গম চরে সোমবার মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে। রংপুরে আড়াইশ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা হিসেবে চাল,ডাল, ঔষধ আর নিত্যপণ্য দিয়েছি এবং কোরবানির ঈদের পর দূর্গত বিভিন্ন জেলায় মেডিকেল টিম পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।

পথশিশুদের শিক্ষা অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে স্বপ্নালোড়ন। বন্যা দুর্গতদের পাশে তারাও এগিয়ে এসেছেন অন্য সবারমত। সংগঠনের সমন্বয়ক শুভ বলেন, আমরা পথশিশুদের শিক্ষা অধিকারের পাশাপাশি জনকল্যাণকর যেকোন কাজে সবসময় যুক্ত থাকতে চেষ্টা করি।

রাজধানির বিভিন্ন এলাকায় আমারা ত্রাণ সহায়তা তুলেছি। সেই ত্রাণ গত বৃহস্পতিবার দিনাজপুরে বন্যাকবলিত এলাকায় ৩ শতাধিক পরিবারকে শুকনো খাবার, খাদ্য পণ্য, লুঙ্গি আর ঔষধ দিয়ে প্রাথমিক সহায়তা করেছি। ঈদের পর কুড়িগ্রামে ৫শতাধিক পরিবারের মাঝে ব্যাপকভাবে এই সহায়তা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছি। এভাবে অসংখ্য তরুণ প্রাণের জন্য দিনরাত ত্রাণ সংগ্রহের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

আমানুল্লাহ সরকার কুড়িগ্রাম বাড়ি এই তরুণের। এবারের বন্যাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। তাই বন্ধুদের নিয়ে ত্রাণ সহায়তা তুলে গেল ২৮শে আগস্ট কুড়িগ্রামের উজিরপুরের দূর্গম চরের শতাধিক পরিবারকে নগদ অর্থ, চাল-ডাল আর ওষুধ দিয়ে সহায়তা করেছেন বলে জানিয়েছেন।

তরুণ প্রজন্মের এই উদ্যোমকে কিভাবে দেখছেন বিভিন্ন উন্নয়নকর্মীরা। কথা হয় ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট (ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট) এর মিডিয়া এডভোকেসি অফিসার সৈয়দ সাইফুল আলম শোভনের সাথে। তিনি বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্ম তো মোট জনসংখ্যার অনেক বড় একটা অংশ। এদের একটা বড় অংশ বিপথগামী আর আত্মকেন্দ্রীক মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। যারা পারিবারিক বন্ধনের বাইরে থাকায় এমন মূল্যবোধহীন হয়ে বেড়ে উঠছে । তবে হতাশার কিছু নেই এখনো অধিকাংশ তরুণ দেশকে ভালোবাসে আর মানুষের জন্য কাজ করে। আমাদের উচিত হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এদের ভালো কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের অনুপ্রাণিত করা। সেই সাথে তরুণদের যেকোন কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা যথাযথভাবে নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তিনি।