রোহিঙ্গাদের নিধনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তিন কৌশল

মাহমুদুল হাসান শাকুরী
Published : 22 Sept 2017, 05:22 AM
Updated : 22 Sept 2017, 05:22 AM

গত ২৫শে আগস্ট কয়েকটি সেনাবাহিনী আর পুলিশের টহল চৌকিতে দুর্বৃত্তদের হামলার জের ধরে আবার রোহিঙ্গাদের উপর খড়গ নেমে আসে। সন্ত্রাসী দমনের নামে, সেনাবাহিনীর সাথে মগ সন্ত্রাসীরাও নেমে পড়েন রোহিঙ্গা দমনে। ফলে প্রাণ রক্ষার জন্য লাখ লাখ রোহিঙ্গা মাতৃভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে।

জনমনে প্রশ্ন রোহিঙ্গারা এই বর্বর হামলা প্রতিরোধ করছে না কেন? স্বাধীন দেশে নিজেদের পরাধীনতা ঘুচাতে কেন স্বাধীনতা চাইছে না? আর কেনই বা প্রতিবাদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে না তারা? আমারা তো পাক শাসকদের পরাধীনতার শৃঙ্খল রুখতে এত সময় নেইনি। তাহলে রোহিঙ্গারা কি নেতৃত্বশূন্য রয়েছে?

এমন অসংখ্য প্রশ্নের জবাব খুঁজতে টানা তিনদিন উখিয়া থেকে নাফ নদীর সীমান্ত পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের দুর্দশার চিত্র সরেজমিন ঘুরে দেখে এবং তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে মিয়ানমমারের সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদী সেনারা তিন কৌশল অবলম্বন করে নীরবে রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধের শক্তি নিস্তেজ করে দিয়েছে।

প্রভাব খাটিয়ে প্রায় ১০ বছর আগ থেকেই রাখাইন রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধবংস করেছে সেখানকার সেনাবাহিনী ও রোহিঙ্গা বিদ্বেষী প্রভাবশালীরা। নেতৃত্ব শূন্য করতে সেখানকার রোহিঙ্গা জনপদ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, শিক্ষক এবং সরকারী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের গুম করে হত্যা করা হয়েছে। বহু ব্যাবসায়ী নেতাকে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীরা তুলে এনে হাজার হাজার রোহিঙ্গার সামনে তাদের হত্যা করে রোহিঙ্গাদের মন থেকে প্রতিরোধের শক্তি নষ্ট করে দিয়েছেন।

গত শনিবার দুপুরে টেকনাফ পেরিয়ে শাহরীর দ্বীপে অবস্থান করছি। সেখানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রবেশ করছে। কিছুক্ষণ হাটার পর কোলে এক সন্তানকে নিয়ে হুযাইফাতুন নামের এক রোহিঙ্গা নারীকে বাংলাদেশে আসতে দেখা যায়। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, আমার স্বামী বড় ব্যবসায়ী ছিলো। বেশ কিছুদিন আগেও পাকা দালানে থাকতাম দুই ছেলেসহ পরিবার নিয়ে। আর এখন বাংলাদেশের কাদামাটিই আমার সবচেয়ে আপন!

নিজেদের উপর অন্যায় হামলার প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ করলেন না কেন এমন প্রশ্ন শুনে তার চোখে-মুখে ক্ষোভের আগুনের ছাপ দেখতে পেলাম। ক্রোধ চেপে বললেন, "একমাস আগেই স্বামী আনিসুল ও ছেলে জিহাদকে স্থানীয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসী ও সেনারা তুলে নিয়ে যায়। গত দু'সপ্তাহ আগে খবর পেয়েছি তারা আমার স্বামী ও ছেলেকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। ইচ্ছে ছিলো আমার দুই বছরের ছেলেকে কারো মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে অন্তত একজন সন্ত্রাসীকে হলেও খুন করবো! যারা আমার স্বামী আর সন্তানকে হত্যা করেছে।

সেনাবাহিনী গ্রামের পর গ্রামে হামলা চালিয়ে আমাদের দিশেহারা করে দেয়। তাই বেশ কিছুদিন লুকিয়ে থেকে ক্ষুদার যন্ত্রণায় ক্ষোভটা বিসর্জন দিয়ে নৌকায় করে নাফ নদী পাড় হয়ে শাহপরীর দ্বীপে চলে এসেছি। হাতে টাকা না থাকায় ৩৫ হাজার টাকা মূল্য সোনার চেইন ও কানের দুল দালালকে দিয়েই জীবনটা নিয়ে কোন মতে চলে এসেছি।"

প্রায় ঘন্টাখানেক হেঁটে শাহররীর দ্বীপ পেরিয়ে বিকেলে সাড়ে চারটায় নাফ নদীর সীমান্তে। সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু রাখাইন রাজ্য আগুন জ্বলছে। শনিবার নাফ নদীর মাঝপথে সীমান্ত এলাকায় পাওয়া গেলো মিয়ানমারের কাদিসিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনকে। তিনি এই কোরবানীর ঈদের দিন পালিয়ে এসেছেন।

তিনি বলেন, রাখাইনের রোহিঙ্গা বিদ্বেষী সন্ত্রাসী ও সেনারা টার্গেট করেই প্রথমে রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বে থাকা রাখাইনের সব চেয়ারম্যনকে মাসখানেক আগে ধরে নিয়ে যায়। তিনি কোনোমতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। ঈদের দুদিন পর খবর পেয়েছেন ৯ জন চেয়ারম্যানকে ৫ দিন পর্যন্ত অমানবিক নির্যাতন করে ক্ষুধার্ত অবস্থায় কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করে মিয়ানমারের সেনারা।

তিনি আরো বলেন, এরপর বেশ কিছু চেয়ারম্যানের কংকাল দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। রাখাইনে তাদের জনপ্রতিনিধি থাকতে তারা কেন প্রতিরোধের শক্তি হারিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "সন্ত্রাসীদের সাথে উগ্রবাদী সেনারা সম্পৃক্ত হওয়ায় তাদের মনোবল নষ্ট হয়ে যায়। আর নির্যাতনের ধরন এতটা পৈচাশিক যে, নিরস্ত্র সংখ্যালঘু জাতি পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুছে দেয়ার মিশন। আগুনে পুড়ে, কুপিয়ে আর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের একেরপর এক জনপদ মানবশূণ্য করা হচ্ছিলো। তাই ঘুড়ে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ছুটেছেন তারা।

রোববার রাত সাড়ে নয়টায় কক্সবাজার কলাতলী মোড় থেকে রিক্সাযোগে সুগন্ধা মোড় হোটেলে আসার পথে কথা হয় এক রিক্সা চালকের সাথে। কথার ফাঁকে জানা গেলো তিনি রোহিঙ্গা। ছয় মাস আগে বাংলাদেশে এসেছেন। এখানকার স্থানীয় চালকদের মতোই চট্টগ্রামের ভাষা ও আচরণের সাথে মিল থাকায় মিশে যেতে তার সময় লাগেনি। রাখাইনের মুন্ডু এলাকার একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন যেহাদুল ইসলাম নামের এই রোহিঙ্গা।

রাখাইনে কী শিক্ষা নেই? তাদের কী কোনো নেতা নেই? তারা কেনো এতো মার খাচ্ছে? গল্পের ছলে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারে দুই নারীসহ ১৭ জন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এমনকি একজন রোহিঙ্গা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। শুধু এমপি-মন্ত্রীই নয়, মিয়ানমার সরকারের সচিবসহ শীর্ষ বিভিন্ন পদেও রোহিঙ্গারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে জানান এই রোহিঙ্গা শিক্ষক।

১৯৯০ সালের নির্বাচনেও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের চারজন প্রতিনিধি ছিলো বলেও জানান তিনি।

"এরপর রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সম্প্রতি নির্যাতনের পর থেকে আমাদের নেতা সামসুল আনোয়ারুল হক, ইব্রাহিম, ফজল আহমেদ ও নূর আহমেদ কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের ধারণা রাখাইনবাসীকে নেতৃত্বশূন্য করতে মিয়ানমার সেনারা সবাইকে গুম করে হত্যা করেছে।"