ক্রিকেটীয় ’দ্বেষপ্রেম’ ও ভাববাদী ’দ্বেষপ্রেমিক’

মিহির নাথ
Published : 18 March 2015, 07:48 PM
Updated : 18 March 2015, 07:48 PM

খেলাধুলা নাকি বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। আর খেলাধুলার বৈশ্বিক আসর গুলো নাকি এক্ষেত্রে আরও বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু আসলেই কি তাই হয়? অন্য খেলাধুলার কথা আপাতত বাদ দিয়ে শুধু ক্রিকেট নিয়ে কথা বলি, যেহেতুক্রিকেটেরই মচ্ছব চলছে । ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। দুই দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের "বাতুলতা" সর্বজন বিদিত। দুই দলের খেলোয়াড়েরা খেলে মাঠে কিন্তু দুই দেশের বাতুল সমর্থকরা মাঠের বাইরে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই যে ধরনের হিপোক্রেট আচার আচরণ করে তা নতুন করে কিছুই আর বলার নেই। বাংলাদেশে ফুটবল বিশ্বকাপ হলে এ ধরনের ফ্যানেটিক আচরনের পরিচয় খুব ভালোভাবেই পাওয়া যায়। কিন্তু ক্রিকেটে এরকম আচরণ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বোধ হয় নতুনই। আজকে ভারত কিংবা বাংলাদেশের সাপোর্টাররা যা করছে তা একধরনের হিপোক্রেসি বৈ কিছুই নয়। একদল উস্কানি দিয়ে একটা ভিডিও বানাচ্ছে তো আরেকদল তার পালটা হিসেবে বের করছে আরেকটা ভিডিও। ভিডিও তৈরী হতে পারে,টীমকে চাঙ্গা করার জন্য। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের "ফ্যানেটিক" সমর্থকগণ যে ধরনের ভিডিও তৈরী করছেন তা কি আদৌ টিমকে অনুপ্রেরনা দেয়ার জন্য, নাকি অন্য টিমকে ছোট করার জন্য? নিজেকে অনুপ্রেরনার দেয়ার স্থলে যদি আমি অন্যকে ছোট করতে যাই তবে সেটা একধরনের হিপোক্রেসিই প্রকাশ করে ।

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এটা তো স্রেফ একটা ম্যাচ হতে পারতো? স্রেফ বিনোদনের মাধ্যম হতে পারতো। কিন্তু এই 'স্রেফ'টা আর স্রেফ থাকেনি। বিনোদনের প্রক্রিয়া হিসেবে খেলাধুলার যে ভুমিকা তা ছাপিয়ে গিয়ে খেলাধুলা আজকে অন্য ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সেই 'অন্য' ভুমিকাটা যে ভালো কোনো ভুমিকা নয় তা নিশ্চই বলা লাগবে না। খেলাটা এখন বিনোদনের মাধ্যম থেকে "দেশপ্রেমের" মধ্যদিয়ে "দ্বেষপ্রেম"এর মাধ্যম হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। এর কারন খুঁজতে গেলে আমাদের সামনে প্রথমেই হয়তো ঐসমস্ত 'হিপোক্রেট' ফ্যানদের কথাই আসবে। কিন্তু শুধু কি হিপোক্রেট ফ্যান? না, তাদের সাথে তাল মিলায় কর্পোরেট মিডিয়াও, আর সাথে আছে কর্পোরেট কোম্পানী গুলো। কারন খেলার সাথে 'দ্বেষপ্রেম'টা মিশিয়ে দিলে তা 'ফ্যানেটিক' সমর্থকগণের দৃষ্টি যতটা আকর্ষণ করে অন্যক্ষেত্রে তা ততোটা করেনা।

২০১১ বিশ্বকাপের ভারত-পাকিস্তানের সেমি ফাইনালের কথা নিশ্চই মনে আছে? খেলা দেখেছিল প্রায় ৯৮৮ মিলিয়ন দর্শক।(১) কিন্তু ভারত-শ্রীলঙ্কা ফাইনালের কথা মনে আছে? দেখেছিল মাত্র ১৩৫ মিলিয়ন মানুষ।(২) সেমিফাইনাল অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ,কিন্তু ফাইনাল নিশ্চই সেমিফাইনালের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সেমিফাইনালের প্রায় দশভাগের এক ভাগ মানুষ খেলাটি দেখেছিল। এতেই বোঝা যায় এরকম 'উগ্রতা' ছড়িয়ে দিলে লাভটা আসলে কাদের হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পণ্য ও স্টার স্পোর্টসের মত কিছু চ্যানেলের বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে চোখ দিলেই এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। আবার বাংলাদেশের অনেকগুলো মিডিয়া ও বাংলাদেশে ব্যবসা করা অনেকগুলো কোম্পানিও কম যায় না। আর কিছু অখ্যাত অনলাইন সংবাদমাধ্যম তো সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। তাই বলা যায় এইযে 'দ্বেষপ্রেম' তাকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সেটাকে পুঁজিবাদী দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের যে প্রক্রিয়া তারই অংশ হিসেবে ভাবা দরকার।

এবার আসি 'ভাববাদী দ্বেষপ্রেমিক' প্রসঙ্গে। এ প্রসঙ্গে ভাববাদ সম্বন্ধে মোটাদাগে কিছু বলে নিই। 'চিন্তা থেকে বস্তুর উদয়' এটাই ভাববাদের মূলকথা। আর বস্তু থেকে চিন্তার উদ্ভব হয় এটা বস্তুবাদের কথা।উদাহরন দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে। ধরাযাক একটা আপেলের কথা। বস্তুবাদ অনুসারে আপেলটি আছে বলেই আমি এ আপেল সম্বন্ধে চিন্তা করতে পারছি। কিন্তু ভাববাদীরা বলে অন্য কথা-আমরা চিন্তা করছি বলেই আপেলটির অস্তিত্ব আছে। যেকোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই নিসন্দেহে স্বীকার করবেন ভাববাদী চিন্তার এই সীমাবদ্ধতার কথা। এবার আসা যাক ক্রিকেটীয় ভাববাদ প্রসঙ্গে। ক্রিকেট একটি খেলা। এখানে দুইটা দল একই সাথে কখনোই জিতবেনা। যেকোনো একদল জিতবে। তাই বলা যায় যে যেকোনো একটি দল জিততে পারে। তবে জিতবেই বলাটা বাতুলতা। আর খেলাটা যেহেতু ক্রিকেট নামক 'গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা' তাই এরকম চিন্তাভাবনা আরও বেশি হাস্যকর। ধরুন কোনো একদলের সমর্থকগন যদি ভাবে যে, তারা ভাবছে বলেই ঐ দেশ জিতবেই তবে সেটা বাতুলতাই বটে। এবার আসা যাক বাংলাদেশ ভারত প্রসঙ্গে।

বাংলাদেশ বনাম ভারতের কোয়ার্টার ফাইনাল এর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই দুই দেশের সমর্থকের যা শুরু করেছেন তা যে 'ভাববাদী' চিন্তা-চেতনা প্রসূত তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ভারতের সমর্থকগণ মানতেই পারছেনা যে বাংলাদেশ ভারতকে হারাতে পারে। অথচ এর চেয়ে দুর্বল দল নিয়ে ২০০৭ এর বিশ্বকাপ ও ২০১২ এর এশিয়া কাপে ভারকে হারিয়ে দেশের টিকেট ধরিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। এবারের বিশ্বকাপেও খেলছে দুর্দান্ত। ভারতীয় সমর্থকগণের চেয়ে কোন অংশেই কম নয় বাংলাদেশের সমর্থকগণও। তারাও এটা ভাবতেই পারছেনা যে ভারত বাংলাদেশকে হারাবে। অথচ এই ভারতই বাংলাদেশকে গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মাটিতে হারিয়েছিল এমন কি গত বছর দেশের মাটিতে ভারতের জাতীয় দলের মোড়কে আসা 'বি' টিমের কাছেও হেরেছে বাজেভাবে। তাছাড়া ভারতও আছে তাদের স্বপ্নের ফর্মে।

দেখা যাচ্ছে ভারত-বাংলাদেশের এই পরিসংখ্যান বা মাঠের পারফর্মেন্স সামনে থাকা সত্ত্বেও দুই দলের সমর্থকগণ 'দ্বেষপ্রেম'র মাপকাঠিতে খেলাটাকে বিচার করছেন, আর তার ফায়দা লুটছে দেশী-বিদেশী কর্পোরেট মিডিয়া ও কোম্পানিগুলো।

এবার একটু প্রথম লাইনে ফিরে যাই। বলছিলাম যে 'খেলাধুলা নাকি বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে ব্যাপক ভুমিকা রাখে'। এই আলোচনাটা মূলত ক্রিকেট নিয়ে,বিশেষত উপমহাদেশীয় ক্রিকেট নিয়ে। দেখাতে চেষ্টা করেছি যে আসলে খেলাটাকে কেন্দ্র করে 'ভ্রাতৃত্বের' বদলে 'দ্বেষপ্রেম'ই বাড়ছে। তার কারন অবশ্য ক্রিকেট নয়-এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। পুঁজিবাদীরা তাদের স্বার্থে উগ্রতাকে হাইলাইট করছে। ক্রিকেটে বিদ্যমান যে তিনমোড়ল প্রসঙ্গ তাও কিন্তু পুঁজিবাদী দুনিয়ার সৃষ্ট বাজারএর স্বার্থেই। তাই ক্রিকেট বা ফুটবল কিংবা যেকোনো খেলা যদি বিনোদনের মাধ্যম না হয়ে পুঁজিবাদিদের স্বার্থে কাজে লাগে তবে সেই খেলা বিদ্বেষের বদলে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলবে সেটা ভাবা বাতুলতা বৈ কিছুই নয়।