অনেকদিন পর আজ আবারও হেলসিংকির একটি রেস্টুরেন্টে মিলিত হলাম রাজনৈতিক আড্ডায়। বলা যায় মনের অজান্তে জন্ম নেওয়া কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুজতেই আজকের আড্ডায় যাওয়া। মধ্য বয়সী সেই লোকটির কাছ থেকে শোনা বাংলাদেশের ইটিহাসে ঘটে যায়া নানা ঘটনা মুরব্বীদের কাছ থেকে শোনা ঘটনার সাথে মিলে যাওয়ায় তার কথাগুলো বড়ই সত্য এবং নির্ভেজাল বলেই আমার বিশ্বাস। দেশের জন্য হয়ত আমার বা তার বড় কিছু করার সাধ্য নেই। কিন্তু ইতিহাসের কিছু বাস্তব সত্য প্রকাশ করতে পারাটাই বা কম কিসের। কথা প্রসঙ্গে অনেক কথাই উঠল। কোন কোন প্রসঙ্গ আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই টানলাম। যেমন তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার যৌক্তিকতা, স্বাধীনতার ঘোষনা, মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ গঠনে জিয়াউর রহমানের ভুমিকা ইত্যাদি। কয়েকটি কথা তিনি নিজ থেকেই বলেছেন। অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত। যেমন জিয়াউর রহমানের অবদানকে অস্বীকার করা, বর্তমান আওয়ামী লীগকে পুনজ্জিবীত করা প্রভৃতি।
নেমকহারামদের একহাত নিয়া ভদ্রলোকটি অনেকটা রাগ, অভিমান আর দুঃখ নিয়ে বললেন, "আমি নিজ কানে শুনেছি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা।" একথাটি যে শুধু আমি তার কাছ থেকে শুনেছি বা জেনেছি মোটেও সেরকমটি নয়। কয়েকদিন আগেও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকীও বলেছেন জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার কথা। আওয়ামী ঘরানার লেখকরাও যারা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছেন তারাও তাদের লেখায় এ বাস্তব সত্যটি গোপন করেন নি। অবশ্য জাফর ইকবাল কিসিমের কিছু বর্ণবাদী এখনও সমাজে বিদ্যমান রয়েছে যারা ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে অন্ধকারে রেখে অন্যের গোলামী করতে বদ্ধ পরিকর। যাইহোক ভদ্রলোকের কথার সারমর্ম হচ্ছে জিয়ার ডাক শুনেই সর্বস্তরের মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল পুরো জাতি। ঝাপিয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় বাংলাদেশের লক্ষ্য কোটি মানুষ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মু্ক্তি সংগ্রামে শামিল হয়েছিল। অথচ স্বার্থন্বেষী মহল জিয়ার অবদানকে অস্বীকার করার নগ্ন খেলায় মত্ত। রায় দিয়ে বইয়ের ভাষা পরিবর্তন করা যায়, হৃদয়ভ্যন্তরে লিখিত ভাষা পরিবর্তন করা যায় না।
তাহের প্রসঙ্গ আসতেই একে একে তিনি অনেক কথাই বলে গেলেন। একটি ঘটনার বর্ণনা দিলেন তিনি এভাবে, বাংলাদেশের সংবিধানে তখন সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোন একজন সিনিয়র সহকারী সচিব অফিসে যাচ্ছিলেন রিক্সায় চড়ে। মাঝপথে গিয়ে রিক্সাচালক রিক্সা থামিয়ে সমাজতন্ত্রের দোহাই তথা সমাজে সবাই সমান এই অজুহাতে বাকি পথটা সচিব সাহেবকে চালিয়ে যেতে বলল। বুদ্ধিমান সচিব লাজ লজ্জার বালাই ত্যাগ করে রিক্সা চালিয়ে সচিবালয়ে পৌছলেন। অতঃপর রিক্সাচালককে নিজের অফিস কক্ষে নিয়ে গেলেন। ভিতরে ঢুকে রিক্সাচালককে তার চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে একটি ফাইল তাকে বুঝিয়ে দিতে বললেন আর বললেন সমাজতন্ত্রে সবাই সমান। রিক্সাচালকতো বেজায় চুপ। সচিব সাহেবের যুক্তি আর আবেগের উচ্চ কন্ঠে সমাজতন্ত্র যখন তাহেরের মতই ফাঁসির কাষ্টে, অফিসের অন্যদের আক্রমনে বেচারা রিক্সাচালকের মুখের কথা তখন চিরতরে বন্ধ হাবার উপক্রম। শেষপর্যন্ত অবশ্য নাকি তিনি ভালয় ভালয় সচিবালয় থেকে বের হতে পেরেছিলেন।
এ ঘটনার ব্যাখ্যায় তিনি বললেন সমাজতন্ত্রের দোয়াই দিয়ে একজন রিক্সাচালককে দিয়ে যেভাবে একটা সচিবালয় চালানো সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি শুধু সৈনিক দিয়েও সেনাবাহিনী চালানো অসম্ভব, অকল্পনীয়। আর এই জঘন্য কাজটিই করতে চেয়েছিলেন কর্নেল তাহের। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে ফেলেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল চিরতরে সেনাবাহিনী ধ্বংস করে বাংলাদেশকে একটা তলাবিহীন ঝুড়িতে রুপান্তর করে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া। ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছিল রক্তপিপাসু তাহের। স্লোগান তুলেছিল, "সিপাহি জনতা ভাই ভাই অফিসারদের রক্ত চাই। সিপাহি জনতা ভাই ভাই জেসিওর উপরে অফিসার নাই।" শুধু তাহের এবং তার দোসরদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন এবং পৃষ্ঠপোষকতায় অফিসারদের রক্ত নেশায় উম্মাদ হয়ে উঠেছিল অস্ত্র হাতে সৈনিকেরা। চেইন অব কমান্ড ধ্বংস হলে সিপাহীরা যে কত বড় পৈশাচিক হতে পারে তা এই প্রজন্মের একজন যুবক হিসেবে আমি উপলব্ধি করেছি, প্রত্যক্ষ করেছে পিলখানাতে।
ভদ্রলোকটি একমত হলেন কোর্টের মাধ্যমে ৩৫ বছর পরে যেভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথিকৃত জিয়াউর রহমানকে খুনি হিসেবে চিহ্নিত করা হল, ভবিষ্যতে হয়ত ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ৪০ হাজারেরও বেশি হত্যাকান্ডের জন্য শেখ সাহেবকে খুনি সাব্যস্ত করা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তিনি বাংলাদেশের বর্তমান নোংরা রাজনীতির শেষ কোথায় বলে প্রশ্ন তোলেন। তিনি আবার বললেন, বার বার বললেন, জিয়াউর রহমানের মত লোক যেদিন আসবে সেদিনই এর পরিসমাপ্তি ঘটবে।