মাতৃভাষা শিক্ষা নাকি মাতৃভাষায় শিক্ষা

প্রশান্ত ত্রিপুরা
Published : 25 August 2013, 05:14 AM
Updated : 25 August 2013, 05:14 AM

পটভূমি

শিরোনামে যে প্রশ্নটি রয়েছে, তা সীমিত আকারে উঠেছিল ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময়। গৃহীত শিক্ষানীতিতে বলা আছে, আদিবাসী শিশুদের জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। আগে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচিত হত 'মাতৃভাষায় শিক্ষা'র কথা। সেটির বদলে 'মাতৃভাষা শিক্ষা' কেন বসানো হল, তা নিয়ে আসলে ব্যাপক পরিসরে তেমন কোনো আলোচনা বা বিতর্ক হয়নি।

আদিবাসী পরিচয়ের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সবাই শিক্ষানীতিতে 'আদিবাসী' শব্দটি দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু অন্তস্থ-য় বিহীন 'মাতৃভাষা শিক্ষা' কথাটি অনেকে হয়তো-বা খেয়ালই করেননি। যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা হয়তো-বা ধরে নিয়েছিলেন, এটি ছিল স্রেফ ছাপার ভুল বা ভেবেছিলেন, একটা 'সামান্য' প্রত্যয়ের থাকা না থাকা নিয়ে মাথা ঘামানোর তেমন কিছু নেই।

'মাতৃভাষায় শিক্ষা'র বদলে 'মাতৃভাষা শিক্ষা'র কথা কেন শিক্ষানীতিতে ঢোকানো হল, এ প্রশ্ন নিয়ে অন্যরা যদি তেমন মাথা না ঘামিয়েও থাকে, আমি ব্যক্তিগতভাবে তা তুলেছিলাম কয়েক জায়গায় এবং অন্তত একবার সুযোগ পেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবেই তা উঠিয়েছিলাম এতদ্‌সংশ্লিষ্ট একটি সরকারি সভায়, শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে। এসব অভিজ্ঞতার আলোকে একটা ব্যাপারে আগেই নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, 'মাতৃভাষা শিক্ষা' কথাটি চালু হওয়ার পেছনে যে কারণই থেকে থাকুক না কেন, মুদ্রণ প্রমাদের কোনো ভূমিকা ছিল না।

এদিকে 'মাতৃভাষা শিক্ষা' কথাটি নতুন করে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে জাতীয় শিক্ষা আইন ২০১৩-এর খসড়ায়, যা সম্প্রতি বিলি করা হয়েছে জনমত যাচাইয়ের লক্ষ্যে। উল্লেখ্য, আইনটি প্রণয়ন করা হচ্ছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আদলেই, সেটাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে জাতীয় শিক্ষানীতিতে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও ধ্যান-ধারণাই মূলত প্রতিফলিত হয়েছে।

খসড়া শিক্ষা আইন ২০১৩-এর ৫ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, "প্রাথমিক স্তরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সকল ক্ষুদ্র-জাতিসত্তার জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।" আমরা ধরে নিতে পারি, 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' ও 'ক্ষুদ্র জাতিসত্তা' বলতে তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে, যাদেরকে জাতীয় শিক্ষানীতিতে 'আদিবাসী' বলা হয়েছিল।

সরকারিভাবে 'আদিবাসী' শব্দটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে একটা কথা শোনা যায়, সে কারণেই হোক বা সংবিধানে শুধু 'উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠী' (হাইফেনসমেত) শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে বলেই হোক, 'আদিবাসী' শব্দটি জাতীয় শিক্ষানীতির বিভিন্ন জায়গায় থাকলেও খসড়া শিক্ষা আইনের কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে 'আদিবাসী' শব্দটি কেন বাদ দেওয়া হল, এ নিয়ে আলাদা করে প্রশ্ন ওঠানোর মানে হয় না, যেহেতু সমস্যাটির সার্বিক প্রেক্ষাপট আরও বড়। তবে আলোচ্য প্রেক্ষিতে অন্তত এটুকু নিশ্চয়ই আশা করা যায়, যে, 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' আর 'ক্ষুদ্র জাতিসত্তা' বলতে ঠিক কাদের বোঝানো হয়েছে, নৃ-গোষ্ঠী আর জাতিসত্তা সমার্থক কি না বা উভয় পদ দিয়েই শিক্ষানীতিতে যাদেরকে 'আদিবাসী' বলা হয়েছে তাদেরকেই বোঝানো হচ্ছে কিনা, এগুলি প্রস্তাবিত আইনে স্পষ্ট করা হোক।

'মাতৃভাষা শিক্ষা' কথাটি কেন সমস্যাজনক

মাতৃভাষা বলতে বোঝায় জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে বা পরিবারে সবার সঙ্গে বেড়ে ওঠার সময় শিশুরা যে ভাষা শেখে– সেটিকে। এ অর্থে মাতৃভাষা শেখার কাজ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অনেক আগেই শুরু হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও সকল সময়, সকল সমাজে চালু ছিল, রয়েছে, থাকবে। যেসব ভাষার লিখিতরূপে চর্চা নেই বা থাকলেও খুব সীমিত আকারে রয়েছে, সেসব ভাষাও শিশুরা পরিবারে ও সমাজে সাবলীলভাবেই বলতে শেখে।

পক্ষান্তরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ভিন্ন একটি বিষয়– সেখানে 'মাতৃভাষা' শেখানো অপরিহার্য নয়। কিন্তু অক্ষরজ্ঞান, সংখ্যাজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদি শেখানো অবশ্যই প্রত্যাশিত। সেটা করার ক্ষেত্রে 'মাতৃভাষা'র ভূমিকা কী হবে তা হল একটা পদ্ধতিগত প্রশ্ন, যা সকল শিশুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যদিও আদিবাসী শিশুদের বেলায় এ প্রশ্নের একটা বাড়তি তাৎপর্য রয়েছে।

বিশেষ করে যেসব আদিবাসী শিশু প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করে, যারা বাংলা একেবারেই বোঝে না বা খুব কম বোঝে, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে তাদেরকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাদের মাতৃভাষার একটা ভূমিকা থাকবে, এটা অবশ্যই কাম্য। তবে সেটার মাত্রা বা ধরন কী হবে তার সর্বজনীন মাপকাঠি নেই, যদিও ন্যূনতমভাবে এটা প্রত্যাশিত যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে 'যোগাযোগের মাধ্যম' হিসাবে মাতৃভাষা ব্যবহৃত হবে।

নীতিগতভাবে 'মাতৃভাষায় শিক্ষা'র অধিকার সকল শিশুরই রয়েছে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনেও এটি সর্বাধিক কার্যকর একটি পন্থা। তবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে 'মাতৃভাষায় শিক্ষা'র নীতির প্রয়োগের মাত্রা ও ধরনে বিভিন্নতা দেখা যেতে পারে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিদ্যমান বিভিন্ন বাস্তবতার আলোকে।

অন্যদিকে একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, এ নীতির ভুল ব্যাখ্যা হলে বা সেটা প্রয়োগের বেলায় শিশুর স্বার্থের চাইতে জাতীয়তাবাদ বা বড়দের বিভিন্ন পক্ষপাত প্রাধান্য পেলে, সেসব বিষয় শিশুঅধিকার ও শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হয়ে উঠতে পারে।

উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পরিষদের জন্য প্রণীত আইনসমূহে সুস্পষ্টভাবেই 'মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা'র কথা বলা হয়েছে, কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে 'মাতৃভাষা শিক্ষা' সন্নিবেশিত হলে তা বিভ্রান্তি ও আইনি জটিলতা তৈরি করবে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে পরিচালিত কিছু প্রকল্পসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় 'মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা'র যেসব উদ্যোগ চালু রয়েছে, সেগুলির আইনগত ভিত্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কারণ, প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ায় সুস্পষ্টভাবেই বলা আছে, 'আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে।'

সমস্যার গভীরে কেন যাওয়া চাই

'মাতৃভাষা শিক্ষা' কথাটা যে গোলমেলে, এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে যে একটা সর্বজনগ্রাহ্য মীমাংসায় আসা উচিত, এটা উপরের আলোচনায় তুলে ধরতে পেরেছি বলে আশা করি। তবে আমার মনে হয়, এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে আলোচ্য বিষয় আসলে গভীরতর ও ব্যাপকতর কোনো সমস্যার একটা লক্ষণ মাত্র। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এখানে শুধু কিছু ইঙ্গিত দেব।

প্রথমত, 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী' বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে, 'মাতৃভাষা শিক্ষা'র ধারণাই-বা কীভাবে এল, এসব বিষয় স্পষ্ট না থাকাতে 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য মাতৃভাষা শিক্ষা' কথাটার একটা বিশেষ অর্থ দাঁড় করানো যায় যা আরোপিত হলেও অপ্রাসঙ্গিক নয়। এদেশে ইংরেজি মাধ্যমের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচুর ছেলেমেয়ে পড়ে। কিন্তু সারাদেশের প্রেক্ষিতে তারা এখনও 'সংখ্যালঘু'ই রয়ে গেছে। এ প্রেক্ষিতে সমাজের যেসব অংশ থেকে এ শিক্ষার্থীরা এসেছে, তাদেরকেও কিন্তু 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী' বলা যায়! আর তাদের বেলায় 'মাতৃভাষা শিক্ষা' যে জরুরি, তা নিয়েও খুব একটা বিতর্কের অবকাশ নেই। যদি বলা হয়, আদিবাসী শিশুদের জন্য 'মাতৃভাষা শিক্ষা'র ব্যবস্থা করার চিন্তা এমন ভাবনা থেকেই এসেছে, খুব কি ভুল হবে?

দ্বিতীয়ত, এটা কি হতে পারে যে, 'মাতৃভাষায় শিক্ষা'কে শিশুদের একটা অধিকার হিসাবে দেখা হচ্ছে না এ কারণে যে নীতিনির্ধারকরা নিজেরাও নিজেদের শিশুদেরকে পাঠাচ্ছেন এমন সব স্কুলে যেখানে মাতৃভাষায় শেখানো নিষেধ? সেসব স্কুল থেকে অভিভাবকদের পর্যন্ত বলে দেওয়া হয়, 'বাসায় বাংলা বলবেন না!' তবে একটা বিষয় হিসাবে বাংলা পড়ানো হয় এবং অভিভাবকদের অনেককে গর্বের সঙ্গে আফসোস করতে শোনা যায়, 'আমারটা বাংলায় খুব দুর্বল'। এসব স্কুলে ইদানিং 'বাংলাদেশ স্টাডিজ' নামে একটা বিষয়ও ঢোকানো হয়েছে, যা আসলে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য মাধ্যমিক স্তরে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

বিষয়ের নাম 'বাংলাদেশ স্টাডিজ' কেন হবে আর বাংলাদেশে বসে এ নামের একটা বিষয়– যা আসলে অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যেই মিশে থাকার কথা ছিল– বাধ্যতামূলক করার চিন্তা এল কেন?

প্রশান্ত ত্রিপুরা: মুক্ত গবেষক; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক।