আল্লাহর উপর অনাস্থা: এ যুগের লর্ড ও তছবি পট্টির গল্প

মিনহাজ আল হেলাল
Published : 3 July 2011, 09:08 AM
Updated : 3 July 2011, 09:08 AM

এইচএসসিতে রসায়ন বিজ্ঞান ব্যবহারিক পরীক্ষায় অনৈতিকতার আশ্রয় নেওয়া আমার এক ক্লাসমেট শিক্ষকের নিকট হাতে নাতে ধরা পড়ে। যদিও ব্যবহারিক পরীক্ষায় বইয়ের সহায়তা নেওয়ার সীমিত সুযোগ দেওয়া হত, তবে একাধিক বার সতর্ক করা সত্ত্বেও দুর্ভাগা বন্ধুটি সীমারেখার পুরোটাই অতিক্রম করে ফেলায় বেরসিক শিক্ষক খাতা কেড়ে নিতে বাধ্য হন। প্রচন্ড রাগে গদগদ করতে থাকা শিক্ষক মহোদয় একটু উত্তেজিত হয়েই বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, কত নম্বর দিলে খুশি হও? আমতা আমতা করতে করতে বন্ধু বলল, সার ২২-২৩ দিলেই চলবে। প্রতি উত্তরে সার বললেন, "স্বয়ং আল্লাহ নেমে আসলেও তোমাকে ২২-২৩ নম্বর দেওয়া সম্ভব নয়"। সারের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ পরীক্ষা স্থলে মৃদু হাসির রোল পড়লে আমিও শরীক না হয়ে পারি নি। অবশ্য পরবর্তীতে যতবারই ব্যাপারটি নিয়ে ভেবেছি হাসি তো দূরের কথা মানুষের হিতাহিত জ্ঞান নিয়ে মনের মধ্যে যথেষ্ট প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

গত বছর ভোলার উপনির্বাচনে বিরোধী দল কর্তৃক সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবীর প্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও আল্লাহ সম্পর্কে একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। ভোলায় উপনির্বাচনে ভয়াবহ সহিংসতার বিরুদ্ধে নিজের সীমাহীন ব্যর্থতাকে ঢাকতে এবং সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের পক্ষে প্রত্যক্ষ সাফাই গেয়ে তিনি বলেছিলেন, "সেনাবাহিনী কেন খোদ আল্লাহ তায়ালা নেমে আসলেও কিছু করতে পারবেন না, যতক্ষণ না রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে।" তাহলে রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য হাহাকার করলেই তো হয়, উনি কেন গুরুত্বপূর্ণ পদ আকড়ে ধরে দরিদ্র রাষ্ট্রের কাড়ি কাড়ি টাকা নষ্ট করছেন? অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টিতে বর্তমান সিইসির জুড়ি মেলা ভার। দ্বায়িত্ব নেওয়ার প্রথম থেকেই তিনি নিত্য নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন। এদেশে তো আরও অনেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। মানুষ যে এত বড় ব্যক্তিত্বহীন ও নির্লজ্জ হতে পারে তা এই সিইসিকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।

আমাদের দেশের বিচারপতিরা এক একজন জীবন্ত দেবতা (!)। শুনেছি 'মাই লর্ড' না বললে নাকি ওনারা ভীষণ মাইন্ড করেন। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মাহমুদুর রহমান 'মাই লর্ড' না বলায় আইনজীবীরা তাকে একাধিকবার সতর্ক করেছেন। মাননীয় বিচারকমণ্ডলী নিজেদের লর্ডশিপে মাহমুদুর রহমানের আনুগত্য না পেয়ে আদালতে বসেই চরম ঠাট্টা বিদ্রুপে লিপ্ত হয়েছিলেন। বিচারপতিদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দেখে অবশ্য আমার মত আম জনতার কাছে বুয়েট আর আইবিএ থেকে ডিগ্রী নেওয়ার মহত্ত্ব বুঝা বেশ মুশকিলই হয়ে পড়েছে। আর বিচারাঙ্গনের নানা কুকর্ম প্রকাশ করায় তো মিস্টার রহমানকে তারা নজিরবিহীনভাবে চার দেওয়ালের মাঝে অর্ধ বছর বিনা পয়সায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে একপ্রকার অনুগ্রহই করে বসলেন। লর্ডশীপ বলে কথা! আল্লাহর উপর আস্থায় তাদের বিচারের ষোলকলা পূর্ণ হয় না। অবস্থাদৃষ্টে এখন এমনই মনে হচ্ছে মহান আল্লাহ তাদের কাছে চরম ঠেকায় পড়েছেন (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহর উপর মানুষের আস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য। অথচ মাহমুদুর রহমানের কারাভোগের কাহিনী পড়ে জানতে পারলাম এজলাসে ওঠার আগে নাকি বিচারপতিরা রীতিমত দোয়াও পড়ে থাকেন। ছল চাতুরীর তো একটা সীমা থাকা উচিত। সামান্য একটু কলমের খোঁচা আর মুখের বুলি দিয়ে যারা আল্লাহর উপর আস্থা উঠিয়ে দিতে চায় তারা কেমন দোয়া পড়েন তা বুঝতে মনে হয় না উচ্চতরও ডিগ্রীর প্রয়োজন আছে। এই লর্ডদের বর্তমান অবস্থা এমনই বেগতিক যে তাদের রায় ঘোষণার পূর্বেই বলে দেওয়া সম্ভব রায়টা কেমন হতে যাচ্ছে।

৭৫ সাল পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতে আওয়ামী লীগ মনে করেছিল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য তাদের প্রয়োজন। সম্ভবত সেই কারণেই নির্বাচনের পূর্বে মাথায় পট্টি আর হাতে তছবি নিয়ে জন সংযোগে লিপ্ত হতেন শেখ হাসিনা। জায়নামাজে মোনাজাতরত অবস্থায়ও বেশ দেখা গিয়েছিল। বর্তমান দেশ বিদেশের লর্ডদের কাছ থেকে তারা যে গ্যারান্টি পেয়েছে তাতে অবশ্য আল্লাহর সাহায্য মনে হয়না তাদের খুব একটা প্রয়োজন আছে! নির্বাচন কমিশনের চিফ লর্ডতো দেখিয়েই দিয়েছেন কিভাবে জনগণ না চাইলে ক্ষমতার মসনদে আসীন করা যায়। আদালতের লর্ডদের কথা তো সবারই জানা। আর বিডিআর বিদ্রোহের পর প্রতিবেশী লর্ডরাতো কসম করে হাসিনাকে রক্ষা করার অঙ্গীকার করেছিল। এতদিন আওয়ামী লীগ ধর্ম নিয়ে জনতার সাথে বেশ দক্ষভাবেই ভন্ডামির আশ্রয় নিয়ে আসছিল। এই লর্ডদের ভরসায় সংবিধানে আল্লাহর উপর আস্থায় অনাস্থা জ্ঞাপন করে আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবে নির্বাচন পূর্ব ভণ্ডামি করার সুযোগটাও হাতছাড়া করল। সামনের নির্বাচনগুলোতে মনে হয় না তছবি, পট্টিতে কোন কাজ দিবে। আওয়ামী লীগ অবশ্য ধরেই নিয়েছে ক্ষমতা তাদের আর হাতছাড়া হচ্ছে না।

আল্লাহর অসীম ক্ষমতা মানুষের চিন্তা রেখার অতীত। সামান্য স্বাধীনতা পেয়ে যারা আল্লাহর উপর গাদ্দারিতে লিপ্ত হয়েছে, ইতিহাসের কালজয়ী সাক্ষী সেই ফেরাউন, নমরুদ, মোবারক, গাদ্দাফী গংদের শেষ পরিনতি। সংবিধান থেকে ছাপার অক্ষরে লেখা কতিপয় শব্দ "আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস" মুছে ফেললেই কি আল্লাহর উপর চৌদ্দ কোটি মুসলমানের আস্থা শেষ হয়ে যাবে? আল্লাহর উপর মানুষের হৃদয়ের আস্থা, ভালবাসা কি দিয়ে মুছবেন? জ্ঞানী লোকদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়ে দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে; এই যদি হয় বর্তমান বিচারপতি ও সরকার সংশ্লিষ্ট লোকদের বুঝার পরিধি, তাহলে আমি আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের সমৃদ্ধি নিয়ে খুবই শংকিত। বিনীতভাবে সকলকে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে সতর্ক করে দেওয়াকে দায়িত্ব মনে করি। দয়া করে আল্লাহকে প্রতিপক্ষ করবেন না। চৌদ্দ কোটি মুসলমানের হৃদয়ে আঘাত করা মোটেও বুদ্ধিদীপ্ত হবে না। সময় থাকতে সকলকে শুধরে নেওয়ার অনুরোধ।