আপনার তো দেশে পড়ারই যোগ্যতা নেই, বিদেশে গিয়ে কি করবেন?

মিনহাজ আল হেলাল
Published : 11 Nov 2011, 10:17 AM
Updated : 11 Nov 2011, 10:17 AM

বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পুলিশের কাজ কি? উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গমনেচ্ছু অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ঢাকার শাহজালাল (র) বিমানবন্দর এসে এমনই প্রশ্নের উদ্রেক হয়। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ এবং এয়ারলাইনসে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের নানা রকম অবান্তর প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয় তাদের। গা শিউরে ওটা প্রশ্নও করে বসেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ। এটাকে অনেকটা অনধিকার চর্চা বলা যেতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আগত প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীকেই কমবেশি হয়রানির স্বীকার হতে হয়েছে। কয়েকদিন আগে এক ছেলে বাংলাদেশ থেকে ফিনল্যান্ড এসেছে। তাকে শুধু নানাভাবে হয়রানি করেই ছেড়ে দেওয়া হয় নি চরম লজ্জাও দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে।

শাহিন (ছদ্মনাম) ফিনল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বিদেশ ভ্রমনের অভিজ্ঞতা তেমন একটা নেই বললেই চলে। বিদেশ ভ্রমন বলতে ফিনল্যান্ডের ভিসা সংক্রান্ত কাজে বার দুয়েক নয়া দিল্লী যাওয়া হয়েছে, তাও বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে। বয়সেও একেবারে তরুন। ২০-২২ বছর হবে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ভারতের রাজধানী থেকে ফিনল্যন্ডের ভিসা পাওয়ায় খুব আনন্দিত সে। ঢাকা থেকে হেলসিংকিতে আসার জন্য তুর্কিশ এয়ারলাইন্সে টিকিটও কেটে ফেলেছে। এবার প্রবাসের উদ্দেশ্যে উড়াল দেবার পালা। কাঙ্খিত দিনটি এসে হাজির হল। পরিবারের চোট বড় প্রায় সবাই এসেছে বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানাতে। মাত্র কুড়ি বছর পেরুনো ছোট একটা ছেলে বহুদূরে দেশান্তরি হচ্ছে, সকলেরই মন বেশ খারাপ। বিশেষ করে মায়ের কান্না কাটি মোটে থামানোই যাচ্ছে না। মায়ের কান্নায় আনন্দের মাঝে শাহিনের মনটাও ভারী হয়ে গেল।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিমানবন্দরের ভিতরে প্রবেশ করল শাহিন। আনুসঙ্গিক কাজকর্ম সেরে বৈধ ভিসা নিয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে হাটছে। বিরাট লাইন। এক এক করে অবশেষে শাহিনের পালা আসল। শাহিন এগিয়ে গেল। বিপরীত দিকে চেয়ারে বসা গম্ভীর প্রক্বতির পুলিশের একজন এসআই ইমিগ্রেশনে দ্বায়িত্বরত। চশমার উপরিভাগ দিয়ে ভ্রুটা হালকা কুঞ্চিত করে শাহিনের কাছে পাসপোর্ট চাইলেন। শাহিন ছোটখাটো একজন ছেলে, স্বাস্থ্যটা ওত হৃষ্টপুস্ট নয়। এমন একজন অনভিজ্ঞ ছেলের দিকে এভাবে তাকানো ভয়ংকরই বটে। পাসপোর্ট হালকা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে কোথায় কোন উদ্দেশ্যে যাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা। লেখাপড়া করতে ফিনল্যান্ডে যাওয়া হচ্ছে জবাব দিতেই যেন আকাশ থেকে পড়লেন তিনি। ফিনল্যান্ড কোথায় সেটাও জানতে চাইলেন এবং সেই সাথে লেখাপড়া করতে যাওয়ার কথা শুনে পরবর্তী কথোপকথন ইংরেজীতে সম্পন্ন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। শাহিনের কাছ থেকে বিশ্বের মানচিত্রে ফিনল্যান্ডের অবস্থান সম্পর্কে ছোটখাটো একটা লেসন নেওয়ার পর অন্যান্য কাগজপত্র (ভর্তির আমন্ত্রন পত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট ইত্যাদি) দেখার আগ্রহ ব্যক্ত করলেন।

সহকারি পরিদর্শক সাহেব শাহিনের এসএসসি-এইসএসসির সার্টিফিকেট, বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রন পত্র, আইইএলটিসের সার্টিফিকেটসহ প্রতিটি কাগজ উল্টিয়ে পাল্টিয়ে বেশ কিছুক্ষন ধরে দেখলেন। অতঃপর এসএসসি এবং এইসএসসির ট্রান্সক্রিপ্ট দুটি হাতে নিয়ে রাগ ঢাক না করেই বলে ফেললেন, "আপনার তো বাংলাদেশে পড়ারই যোগ্যতা নেই বিদেশে গিয়ে কি করবেন।" এখানেই ইমিগ্রেশন সার্ভিস শেষ হয়ে যায় নি। এর পরও শাহিনকে জনা দুয়েক বড় বসের সাথে দেন দরবার করতে হয়েছে।

শাহিনের বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পুলিশের কমপক্ষে তিনটি ব্যাপার নিয়ে কথা বলা যায়। এক. ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা ফিনল্যান্ড কোথায় এটা জানেন না। দুই. তিনি কথোপকথনের মাঝখান থেকে ইংরেজী বলা শুরু করেন। তিন. তিনি বলেছেন, আপনার তো দেশে পড়ারই যোগ্যতা নেই বিদেশে গিয়ে কি করবেন। তিন নম্বর পয়েন্ট থেকে শুরু করা যাক। ঐ ছেলে আমাকে পুরো ঘটনা বলার পর আমি মনে করেছিলাম সে হয়ত জিপিএ ২-৩ করে পেয়েছে। তাই তাকে জিজ্ঞাসা করতেও লজ্জা পাচ্ছিলাম। তারপরও শাহিনের কাছে ওর এসএসসি এবং এইসএসসির রেজাল্ট জানতে চাইলাম। সে এসএসসিতে ৪.৮৮ এবং এইসএসসিতে ৪.১০ পেয়েছে। আমার মনের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হল, বাংলাদেশে পড়া লেখা করতে কি এর চেয়ে ভাল রেজাল্ট প্রয়োজন হয়? এই ফলাফল কি একেবারেই খারাপ? পুলিশের এসআই কি এই রকম ফলাফল নিয়ে কটাক্ষ করার যোগ্যতা রাখে যে কিনা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। ইংরেজীতে কথা বলা মোটেও মন্দ কাজ নয়, তবে কথোপকথনের মাঝপথ থেকে ঐ পুলিশ কর্মকর্তার ইংরেজী বলাটা দৃষ্টিকটুই বটে। শাহিনের সাথে ইংরেজীতে কথা বলে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা পরোক্ষভাবে কি তার ইংরেজী দক্ষতাটা যাচাই করে নিলেন!

যাইহোক আসল কথা হচ্ছে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাজ কি? কারও ইংরেজী দক্ষতা যাচাই করা কিংবা কে বিদেশে কি করবে তা জানা অথবা কার ব্যক্তিগত বিষয়ে মন্তব্য করা নিশ্চয় ইমিগ্রেশন পুলিশের কাজ নয়। ইমিগ্রেশন পুলিশের এ ধরনের কর্মকান্ডের জন্য অনেক ছেলেমেয়েকেই মানসিক যন্ত্রনায় ভুগতে হয় যা কোনভাবেই কাম্য নয়। আশা করি ইমিগ্রেশনে কর্মরত সকলেই তাদের মূল দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হবেন।