তোমরা আছ হৃদয়ে, তোমরা আছ ভালবাসায়, তোমরা আছ অনুভবে

মিনহাজ আল হেলাল
Published : 23 Feb 2011, 08:21 PM
Updated : 23 Feb 2011, 08:21 PM

বাংলার মানুষ সিরাজউদ্দৌলার সাথে পরিচিত, মীর জাফরের সাথেও পরিচিত। তিতুমীরের সাথে পরিচিত, মীরনের সাথেও পরিচিত। ১৯৭১ সালের সাথে পরিচিত, ১৭৫৭ সালের সাথেও পরিচিত। ১৯৫২ সালের সাথে পরিচিত, ১৯৯০ সালের সাথেও পরিচিত। সেনাবাহিনীর সাথে পরিচিত, রক্ষীবাহিনীর সাথেও পরিচিত। জিয়াউর রহমানের সাথে পরিচিত, এরশাদের সাথেও পরিচিত। ভালর সাথে পরিচিত, মন্দের সাথেও পরিচিত। হাজার বছর ধরে ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই, লাঞ্চনা-বঞ্চনা, শোষন-নিপীড়ন ইত্যাদির সাথে একরকম প্রেমের সম্পর্ক এই বাংলার। এখানে যেমন আছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিবেদিত প্রান মানুষ, তেমনি আছে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতে তৎপর পাষন্ডরা। এখানে যেমন আছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, তেমনি আছে সেনাবাহিনী ধ্বংসে তৎপর জন্তু জানোয়ারেরা।

যে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সেই সেনাবাহিনী ধ্বংস করে এ দেশকে একটা গোলামী রাষ্ট্রে পরিনত করার অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর অগাধ দেশপ্রেম সকল চক্রান্তকে পদদলিত করে গত সাড়ে তিন দশকে অনেক দূর এগিয়েছে। দেশ বিদেশে সুনাম এবং সুখ্যাতি অর্জন করেছে। তবুও স্বার্থন্বেষী মহলের কুচক্রান্ত থেমে থাকে নি একটি মুহূর্তের জন্যও। অপেক্ষা ছিল শুধু সুযোগের। ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৬, ২০০৭ সহ বহুবার সেনাবাহিনীকে মুষ্টিবদ্ধ করতে প্রচেষ্টা ছিল কুচক্রী মহলের। ২০০৯ সাল থেকে অব্যহতভাবে সেনাবাহিনীকে মগজবিহীন খুলিতে রুপান্তরের প্রচেষ্টা নাড়া দিয়েছে প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে যার শুরু হয়েছিল বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে। ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম একটি কালদিন। সম্ভবত জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এই প্রথম বড় ধরনের আঘাত পেয়েছিল পুরো জাতি।

২৫ ফেব্রুয়ারি অন্যদিনের মতই তাড়াহুড়ো করে প্রোগ্রামিং ক্লাসে গিয়েছিলাম। অন্যদিনের মত শিক্ষকের চোখ ফাকি দিয়ে অলাইনে পত্রিকাও ওপেন করলাম। একটি পত্রিকায় "বিডিআর সদর দপ্তরে গোলাগুলি" শীর্ষক সংবাদটি আমার নজর কাড়ল যা আমার অভ্যন্তরে প্রচন্ড ভাবাবেগ আর অস্থিরতার সৃষ্টি করে। শিক্ষকের কড়া ভাষা আর ক্লাসে উপস্থিতি গননা না হওয়ার আশঙ্কা সব কিছুই আমার কাছে তখন অত্যন্ত তুচ্ছ। আরও বেশ কয়েকটি পত্রিকা ওপেন করলাম সর্বশেষ খবর জানার জন্য। আস্তে আস্তে সদর দপ্তরের অভ্যন্তরের ভয়াবহতার খবর পেলাম। বাসায় ফোন করে জানলাম সাভার থেকে ট্যাঙ্কবহর রওয়ানা হওয়ার খবর। ভেতরে অনেকে মৃত্যবরন করেছে বলেও শুনলাম। সদর দপ্তরের চারিদিকে সেনাবাহিনী, র‍্যাব এবং পুলিশে ঘিরে রেখেছে বলে জানতে পারলাম। ছোট হোক বড় হোক একটা যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা। মুহূর্তে আমার প্রোগ্রামিং ক্ষমতা যোগ বিয়েগে নেমে আসল। অজানা আশঙ্কায় সেনাবাহিনী অতি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌছেছে শুনে কিছুটা ভারমুক্ত হতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু? কি হল? এই আমাদের সেনাবাহিনী?

সারাদিন কম্পিউটার সামনে নিয়েই বসে থাকলাম যা পরের দিনও অব্যাহত থাকল। মনে হাজারও প্রশ্নের সৃষ্টি হল। মাত্র সাত হাজার সিপাহীর কাছে পুরো দেশটাকেই চরম অসহায় মনে হল। পঙ্গু মনে হল ট্যাঙ্কবহর নিয়ে অপেক্ষারত সেনাবাহিনীর কতিপয় অফিসার ও সৈনিককে। তলাবিহীন ঝুড়ি মনে হল যাকে নিয়ে আমরা অনেক গর্ব করি সেই সেনাবাহিনীকে। দানবের আস্তানা মনে হল বর্তমান শাসক গোষ্টিকে। একজন কুলাঙ্গার কাপুরুষ মনে হল স্বার্থের কাছে নীতি বিসর্জন দেওয়া তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈনকে। আর নিজেকে মনে হল একজন দুখী মানুষ একজন কাঙ্গাল। মনের গভীরে জাগ্রত প্রশ্নগুলো প্রচন্ড রাগ আর ক্রোধের সৃষ্টি করছিল। সেনাবাহিনী কেন অ্যাকশনে যাচ্ছে না? যেই সেনাবাহিনীর সামনে সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয় আর তারা সেটা উপভোগ করে, সেই সেনাবাহিনী কিভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে? এই সেনাবাহিনী নিয়েই কি আমরা গর্ব করি? এই সেনাবাহিনীই কি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল? সেনাবাহিনী, র‍্যাব, পুলিশ সদর দপ্তর ঘিরে রেখে কি সুনিপুনভাবে অফিসার হত্যায় সহায়তা করছে? সাহারা খাতুন গংরা কি মৃতের সংখ্যা গননা করতে ভেতরে গিয়েছিল? ইত্যাদি। ততক্ষনে পৃষ্ঠপোষকদের কার্যসিদ্ধি। অফিসারদের হত্যা করে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মাটির নিচে পুতে ফেলা নিশ্চিত করে খলনায়কদের পালিয়ে যাওয়ার রাস্তাও তৈরি।

এবার শুরু হল কান্নার পালা। সময় গড়ানোর সাথে সাথে একের পর এক মৃত অফিসারদের বিভৎস দেহ, স্বজনদের আহাজারি আর বেচে যাওয়া অফিসারদের হৃদয়বিদারক বর্নণা কখন যে নিজের চোখকে ভারী করে ফেলেছে বুঝতেও পারি নি। টিভিতে পাগলপ্রায় একজন নিখঁোজ অফিসারের ভাইকে সারিবদ্ধ লাশের পাশে দাড়িয়ে প্রলাপ করতে দেখলাম। সহ্য করতে পারছিলাম না। সদর দপ্তরে আমার পরিবার কিংবা কোন আত্মীয়স্বজন ছিল না। আমি জানতাম না এমনকি আমি কারও কাছে জানতেও চাই নি ওখানে আমাদের কোন স্বজন আছে কিনা। ঐদিন বিডিআর সদর দপ্তরে আক্রান্তদের কাউকেই আমার দূরের মানুষ মনে হয় নি। মনের অজান্তেই তারা আমার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। হৃদয়ের গভীরে প্রচন্ড শূন্যতার অনুভব করলাম। কাছের মানুষ হারানোর বেদনা অনুভব করলাম। সমব্যথিত হলাম শোকার্ত পরিবারগুলোর প্রতি। নিজের থেকেই প্রশ্নের সৃষ্টি হল। এটাই কি যথেষ্ট? আমি সেনাবাহিনীর সেদিনের ভূমিকায় যারপনারই ক্ষুব্ধ হয়েছি। যেই সেনাবাহিনী একজন অফিসারকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেই সেনাবাহিনী আমাদের দরকার নেই। যেই সেনাবাহিনী নারীর সতীত্ব রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে পারে না, সেই সেনাবাহিনী আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা রক্তের বন্যায় ভেসে যেতে সেনাবাহিনী পুষি না।

বিডিআর ঘটনার পর ঐ সময়কার কোন সিনিয়র অফিসারের সেনাবাহিনীতে থাকার নৈতিক যোগ্যতা নেই। দে শুড গো। পুরো দুইদিন সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কগুলো খাচায় বন্দী বাঘের মত বিডিআর সদর দপ্তরের দিকে মুখ করে চেয়ে থাকল। সারা দেশবাসীর চোখের পানি কয়েকটি আশ্বাসেই মুছে দেওয়ার চেষ্টা। ফ্ল্যাট, অনুদান, তদন্ত, বরখাস্ত, শহীদ অফিসারদের স্বজনদের জড়িয়ে ধরে একটু সান্ত্বনা, আরও অনেক কিছু। অতঃপর সবকিছু ধামাচাপা। আমরা হারালাম মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, কর্নেল গুলজারসহ ৫৭ জন অফিসারকে। আর আশ্বাস পেলাম একটি ফ্ল্যাট একজন অফিসারের প্রানের বিনিময়ে। আমরা হারালাম নারীর সতীত্ব। আর শুনলাম সান্ত্বনার বানী। আমরা করলাম ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের পিতৃহারা। আর দিলাম কিছু ছিটেফোটা অনুদান। আমরা হারালাম আমাদের ঐতিয্যবাহী বিডিআরকে। আর পেলাম সীমান্তে ডজন ডজন লাশ উপহার। মিলিয়ন বিলিয়ন ফ্ল্যাটরট বিনিময়েও কি একজন কর্নেল গুলজার পাওয়া যাবে? লক্ষ কোটি ভালবাসার কথা শুনিয়েও কি একজন নারীর কলঙ্কের দাগ মুছা যাবে? বিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েও কি কারও বাবাকে ফেরত পাওয়া যাবে? হাজারটা তদন্ত করেও কি আমাদের সেই বিডিআরকে ফিরে পাওয়া যাবে? এই প্রশ্নগুলো হয়ত সারাজীরন প্রশ্নই থেকেই যাবে।

কোন সন্দেহ নেই বিডিআর বিদ্রোহ ছিল একটি সাজানো নাটক। সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা আর সেনাবাহিনীর বিকল্প বাহিনী গঠন করাই ছিল এই বিদ্রোহের পৃষ্ঠপোষকদের মুল উদ্দেশ্য। প্রাথমিকভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের সফল মনে হলেও একটা কথা ইতিহাস থেকে স্পষ্ট ষড়যন্ত্রকারীরা কখনও সফল হতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান ঘটনাগুলোও তারই ইঙ্গিত বহন করে। নীল আসমানের শপথ করে বলছি তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রকারীদেরকেও সফল হতে দেওয়া হবে না। বিডিআর বর্বরতায় নিহত হওয়া বীর সেনানীরা, সেই সত্ত্বার কসম বিশ্বাসঘাতকরা একদিন না একদিন পদদলিত হবেই। হে শহীদ বীর সেনানীরা, আমারা তোমাদের ভুলি নি। আমরা তোমাদের ভুলতে পারি না। তোমরা আছ হৃদয়ের গভীরে সদা সর্বদা। বিডিআর সদর দপ্তরের প্রতিটি বুলেটের শব্দ এখনও কানে বাজে। আগামী দিনের সোনার বাংলা গড়তে তোমরাই হবে আমাদের প্রেরনা।

"যারা নিজেদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে- তুমি কখনও এমন সব লোকের পক্ষ নিও না, কেননা আল্লাহ তায়াল এই পাপিষ্ঠ বিশ্বাসঘাতকদের পছন্দ করেন না।" -৪:১০৭