খাদ্যনিরাপত্তা বনাম ব্যবসায়িক স্বার্থ প্রসঙ্গে

আশরাফুজ্জামান মিনহাজ
Published : 2 Jan 2016, 09:04 PM
Updated : 2 Jan 2016, 09:04 PM

খাদ্য যদি বিষাক্ত হয় তাহলে তো আর তাকে খাদ্য বলা যায় না। কৃষকের ফসলের মাঠ থেকে শুরু করে শহর-বন্দরের বাজার এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তার পাতে ওঠা পর্যন্ত যত রকম প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার মধ্যে অনেক গলদ ঘটতে শুরু করেছে। খাদ্য আর স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ থাকছে না। দেখতে চকচকে, কিন্তু স্বাদ নেই, পুষ্টি নেই, নেই কোনো খাদ্যগুণ। উপরন্তু তাতে রয়েছে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য।

জেনিটিক্যালি মডিফায়েড সংক্ষেপে জিএম প্রযুক্তি জীবনরক্ষার জন্য ঔষধ তৈরিতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন ডায়াবেটিকস রোগীদের জন্য ইনসুলিন তৈরি এবং জেনিটিক বা বংশানুগতিক বৈকল্য চিকিৎসার জন্য। তবে খাদ্য উৎপাদনে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক চলছে। শস্য পরিবর্ধন নতুন কিছু নয়। কৃষি উৎপাদনের শুরু থেকেই শস্য প্রজননবিদরা এটা করে আসছেন। বিভিন্ন ধরনের গোল আলু এই শস্যের নানা জাতের সংকরের ফলাফল।

এমনিভাবে নানা আকৃতির ও রংয়ের বেগুন উদ্ভাবিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রোকলি, ব্রাসেল স্প্রাউট, কোহলরবি ও ক্যালে একই প্রজাতি থেকে উদ্ভুত। আমাদের দেশে সেচ এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে আধুনিক জাতের ধান উৎপাদিত হচ্ছে। হাইব্রিড ধানচাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। মোট ধান আবাদি এলাকার চার-পঞ্চমাংশের বেশি আধুনিক ও হাইব্রিড জাতের দখলে চলে গেছে। ভাটিয়াল, বালাম, লতাশাইল, দাঁতখানি চাল বাজারে আর দেখা যায় না। গম, জোয়ার, কাউন, সরিষা, ছোলা, মুগ, মসুরি ইত্যাদি শস্যের চাষ প্রায় উঠে গেছে। সব্জির উৎপাদনে হাইব্র্রিড জাতের ব্যবহারই বেশি। কাঁটাযুক্ত গোল দেশি বেগুন এখন আর পাওয়া যায় না।

অন্যদিকে একই জমিতে বারবার আধুনিক বা হাইব্রিড জাতের চাষে ফসলে কীটপতঙ্গ ও রোগব্যাধির প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের উপর অতি নির্ভরশীলতা মাটির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার প্রবণতা আরও বৃদ্ধি করেছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নানারকম বিতর্ক শুরু হয়েছে। বায়োটেক বা জৈবপ্রযুক্তির সমর্থকরা জিএম অর্থাৎ বংশানুগতিক বা কৌলগত ধারায় পরিবর্ধিত ভিটামিন সমৃদ্ধ, উচ্চফলনের ও দ্রুত বর্ধনশীল শস্যের আবাদে উৎসাহিত করছে। পরিবেশবিদরা এই ফসলকে 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন' (মোহরাঙ্কিত বা সিল মারা) খাদ্যের রেসিপি অর্থাৎ প্রস্তুতপ্রণালী হিসেবে আখ্যায়িত করে জিএম প্রযুক্তি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে আশংকা করছে।

আমাদের দেশে ইতিমধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণিপ্রজাতির বিলুপ্তি শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি বিলুপ্তির পথে। বনও অনেকাংশে উজাড় হয়ে গেছে। এটা বন্ধ না হলে চলতি শতাব্দী পূর্ণ হওয়ার আগেই বেশিরভাগ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটবে। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির অনেকগুলোই খাদ্য ও ঔষধ সরবরাহ করে। এই বিলুপ্তির ফলে প্রতিবেশ নষ্ট হবে। অনেক দেশেই এই ধরনের বিলুপ্ত সম্পদ পুনরুদ্ধার শুরু হয়েছে। ফিজিতে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের পুনরুদ্ধার চলছে। কেনিয়াতে মৌমাছি পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। চিলি পানি ও বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহারে উৎসাহিত করছে পরিবেশ রক্ষার জন্য। জাপানে পরিবেশবান্ধব গাড়ি ক্রয়ে ঋণ দিচ্ছে।

আধুনিক মলেক্যুলার বায়োলজি প্রযুক্তিতে আমরা একটি প্রাণিসত্তার নির্দিষ্ট কোনো বৈশিষ্ট্যের জিন আলাদা করে অন্য প্রজাতিতে স্থানান্তর করতে পারি। এই পদ্ধতিতে একটি উদ্ভিদকে কোনো প্রাণী বা ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে বহিরাগত জিন দিয়ে রুপান্তরিত করা হয়। এটাই হল জিএম খাদ্য নিয়ে বিতর্কের কারণ।

জিএম প্রযুক্তিতে তিনটি উদ্বেগের বিষয় রয়েছে। বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট একটি আগাছানাশক সহনশীল বা প্রতিরোধক জিন নিয়ে কোনো শস্যে স্থানান্তর করতে পারে। জিনটি স্থানান্তরের ফলে এই ফসলের আগাছানাশক সহনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে ওই ফসলের জমিতে রাসায়নিক আগাছানাশক স্প্রে করা হলে আগাছা ধ্বংস হলেও ফসল রক্ষা পাবে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হল, এই ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়ায় ফসলের জমিতে উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব পড়বে। কারণ ফসলের জমির আগাছার উপর অনেক পোকামাকড়, পাখি ও অন্যান্য জীবজন্তু খাদ্য ও বসবাসের জন্য নির্ভরশীল থাকে। আর একটি ভয় হল, জিএম ফসলের বহিরাগত জিন সংশ্লিষ্ট জাতের বন্য উদ্ভিদজগতে সংক্রমিত হতে পারে। যেহেতু বাতাসে প্রবাহিত পরাগ থেকে উদ্ভিদ ভ্রুণ গঠন করে, ফলে জিএম ফসলের পরাগ প্রবাহিত হয়ে অনেক দূরবর্তী স্থানেও অন্য উদ্ভিদের ফুলে ঢুকে পড়তে পারে। ফলে এই সমস্ত বন্যজাত উদ্ভিদের আগাছানাশক সহনশীলতা বৃদ্ধি পেয়ে 'সুপার' আগাছাতে পরিণত হতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে পড়বে। অস্বাভাবিকভাবে আগাছানাশক সহনশীল হওয়ায় এই উদ্ভিদজাত অন্যান্য জীবজন্তুর খাদ্য হিসেবে অনুপোযোগী হয়ে পড়বে। এতে 'ফুড চেইন' ব্যাহত হবে।

তৃতীয়ত পরবর্তী ফসল উৎপাদনে জিএম ফসলের বীজ উপযোগী হবে না। এমনকি অঙ্কুরিতই হবে না। ফলে বীজ কোম্পানিগুলো এই সুবিধা নেবে। প্রতিবার ফসল উৎপাদনে নির্দিষ্ট কোম্পানিগুলো থেকে বীজ ক্রয় করতে হবে। কৃষকদের বিদেশি জিএম বীজের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে। এভাবে জিএম প্রযুক্তি উন্নয়নশীল দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

অনেকেই হয়তো-বা জিএম খাদ্য খেতে দ্বিধাবোধ করবে না। কিন্তু জীবজন্তুর জিন খাদ্য ফসলে স্থানান্তরকরণ নিরামিষভোজী ও নির্দিষ্ট কোনো পশুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ ধর্মানুসারীদের জন্য নৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করবে। এ জন্য হয়তো জিএম খাদ্যের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে বিদেশি ফসলের জিন থেকে সৃষ্টজাত অন্য দেশের স্থানীয় ফসলে সংক্রামিত হতে পারে। আমেরিকা ও ইউরোপে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও অনেক দেশে তা দুরূহ হয়ে পড়বে। এতে প্রতিবেশে প্রকটভাবে বিরূপ প্রভাব পড়তে থাকবে। এই সমস্ত প্রতিকূলতা জিএম প্রযুক্তিকে বিরাগভাজন করে তুলতে পারে। অন্যদিকে জিএম বীজ কোম্পানিগুলো কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ও সমস্য যাচাই ও পরীক্ষা ব্যতিরেকেই দ্রুত তাদের পণ্য বাজারজাত করতে চাচ্ছে। এসব কারণে বিশ্বে জিএম খাদ্য নিয়ে বিতর্ক চলছে। বাংলাদেশেও এই বিতর্ক শুরু হয়েছে।

জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুন উদ্ভাবন করা হয়েছে। মৃত্তিকাবাহিত ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস সংক্ষেপে 'বিটি' নামক ব্যাকটেরিয়াম এর জিন স্থাপন করে 'বিটি বিরিঞ্জাল' নাম দিয়ে এই বীজ তৈরি করা হয়েছে। বিটি বেগুন বীজ থেকে আবাদি জমির ফসল মাজরাপোকা প্রতিরোধশীল হবে। উল্লেখ্য মাজরাপোকা বেগুন ফসলের বড় শত্রু। এই পোকা বিটি বেগুন ফসল আক্রমণ করলে বিটি টক্সিন বা বীষাক্ত পদার্থ তার পরিপাকতন্ত্র নষ্ট করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে। এ থেকে আশংকা করা হচ্ছে যে জিএম প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত বীজ ব্যবহার করে উৎপাদিত শস্য সাস্থ্যশূল হতে পারে। ভারতে বিভিন্ন পরীক্ষায় যে জিএম খাদ্য দিয়ে পালিত গবাদিপশুর বৃদ্ধি, অঙ্গ বর্ধন ও রোগপ্রতিরোধে সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। বিগত ২০০২ সালে বিমুক্ত বিটি কটন বা তুলার কারণে মধ্যপ্রদেশে খামার ও ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখে গেছে। যেমন চুলকানি, মুখ ফুলে যাওয়া ইত্যাদি।

ফসলের মধ্যে ধানের পাশাপাশি হাইব্রিড জাতীয় সবজি চাষে ব্যাপক হারে কীটনাশক ব্যবহার হয়। আধুনিক কৃষির কারণে শহরের মানুষের ধারণা যেকোনো সবজিতেই কীটনাশক দিতে হয়, কিন্তু আসলে কীটনাশক ব্যবহার হয় হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার এবং অ-মৌসুমে করলে। স্থানীয় জাতের বীজ, স্থানীয় পরিবেশ ও মৌসুমের ফসলে কৃষক নিজস্ব উপায়ে কীট ব্যবস্থাপনা করতে পারেন। সরকারের কৃষি পরিসংখ্যানে খরিফ মৌসুমে ১৯টি ও রবি মৌসুমে মাত্র ১২টি সবজির তালিকা দেয়া হয়েছে, যা প্রধানত বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে শহরের বাজারে বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে লাউ, বেগুন, পটোল, ঢেঁড়শ, ঝিঙা, চিচিংগা, করলা, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেপে, লাল শাক, মূলা, পালং শাক, লাউ শাক, ডাটা, শিম, গাজর ইত্যাদি রয়েছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, দেশের বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে বাণিজ্যিক চাষের সবজি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়, যাতে কীটনাশক ও রাসায়নিক রঙ ব্যবহার হয়। টমেটো পাকাতে গিয়ে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের তথ্য পত্রপত্রিকায় এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য ১৯৮৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত (২৭ বছরে) কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ যোগ করে দেখা গেছে, ৪,৪৬,২৪৬.৭৮ টন, গড়ে বছরে ১৬৫২৭.৬৫ টন মানুষের শরীরে যাচ্ছে। কীটনাশক দ্বারা ক্ষতি নানাভাবে হতে পারে। কীটনাশক স্প্রে করতে গিয়ে কৃষি শ্রমিক সরাসরি এর সংস্পর্শে আসছেন, পরিবারের সদস্যরা সারাক্ষণ কীটনাশক ব্যবহারে যুক্ত হচ্ছে, (স্প্রে মেশিনটি দামি হওয়ায় ঘরের ভেতরেই রেখে দেয়া হয়), ভোক্তারা কীটনাশকযুক্ত ফসল খেয়ে এর ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ১৯৯০ সালে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৭ লাখ ৯৮ হাজার জন। যার মধ্যে ৭৫ শতাংশ হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশে। নারীদের মধ্যে এ প্রবণতা অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি বছর ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশকের বিষাক্ততায় আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হয় কীটনাশকের কারণে। কিডনি রোগ, লিভারের রোগ, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট এখন খুব দেখা যাচ্ছে। নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মরা বাচ্চার জন্ম দেয়া (Still Birth) ও নবজাতকের মৃত্যু অনেক বেড়ে গেছে। ভারতে প্রায় আগের তুলনায় যথাক্রমে ৩০০ ও ২০০ গুণ বেড়ে গেছে। তাই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফসল উত্পাদনে কীটনাশক ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিচ্ছে। ১৩টি কীটনাশক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যার মধ্যে ডিডিটি অন্যতম (যা আমাদের দেশে শুঁটকিতে ব্যবহার হচ্ছে)।

অনেকেই আবার খাদ্যশস্যে বিষাক্ত জিন স্থাপনের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলাসহ আটটি রাজ্য সরকার বিভিন্নভাবে এই পক্ষে অবস্থান নেয়। মাঠ পর্যায়ে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি বিধায় জিইএসি কর্তৃক অনুমোদনের বিপক্ষে সুপ্রীম কোর্ট অন্তবর্তীকালীন ইনজাংশন জারি করে। যাহোক বিটি বেগুন নিয়ে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ফলে এক পর্যায়ে এই প্রযুক্তি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়।

আধুনিক কৃষি বা সবুজ বিপ্লবের ভিত্তি হচ্ছে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ভূগর্ভস্থ পানি সেচের জন্য ব্যবহার ইত্যাদি। বলা হয়, এ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়ে উত্পাদন বাড়ানো হবে এবং পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে ফসল। গত ৬০ বছরে বিশ্বব্যাপী কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ ও ধরন বেড়েছে ব্যাপক হারে। যেখানেই আধুনিক কৃষির প্রচলন হয়েছে, সেখানেই কীটনাশক ব্যবহার বেশি। তারা খুশি যে কীট দমন করে ফসলের উত্পাদন বেড়েছে। কিন্তু 'কীটনাশক' শুধুই নাশ করে, কারণ এটা বিষ। ফসলের মধ্য দিয়ে শরীরে যায়, তাত্ক্ষণিক কেউ মারা যায় না ঠিক কিন্তু শরীরে বিষের ক্রিয়া চলে। বিষ হিসেবে বোঝার সহজ প্রমাণ হচ্ছে, ফসলের জন্য কেনা তরল বিষ পান করেই গ্রামের কৃষক পরিবারের মেয়েরা আত্মহত্যা করে। এটাই তাদের হাতের কাছে মরে যাওয়ার সহজ পথ। সে একই বিষ কীট মারার জন্য খাদ্য উত্পাদনে ব্যবহার হয়। আমরা খেয়েই তক্ষুণি মরে যাই না বটে, কিন্তু স্লো-পয়জনিংয়ের মতো করে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ এখন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে। ফসল উত্পাদনে কীটনাশক স্প্রে করার দৃশ্য আমরা সবসময় দেখি। এ কীটনাশক বেছে বেছে শুধু ক্ষতিকর কীটকেই মারে না, প্রজাপতি ও অন্যান্য বন্ধু কীটকেও ছাড়ে না। বিষ তো সবার জন্যই বিষ। মাটি, পানি ও বাতাসকেও দূষিত করে। অর্গানোক্লোরিন ও অর্গানোফসফেট ধরনের কীটনাশক মাটি ও পানিতে খুব বেশি পাওয়া যায় এবং এর প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী হয়। ডিডিটি ও পিসিবি জাতীয় কীটনাশক ব্যবহারের কারণে ক্যান্সার, বিশেষ করে স্তন ক্যান্সারের ঘটনা সারা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে।

ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত জিএম শস্যে যেমন তুলা, ভুট্টা বিটি জিন সংযোজিত। ভারত জিএম খাদ্যে নিরাপদমূলক ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী। এই দেশ ২০০২ সালে বিটি তুলা অনুমোদন করলেও জিএম ভুট্টা আমদানি বন্ধ রাখে। ফ্রান্স থেকে শুরু করে জিম্বাবুয়ের জনসাধারণ, এমনকি ভারতীয়রাও জিএম খাদ্যের উপর আস্থাশীল নয়। তাদের ভয় বিদেশি জিন সংক্রমিত হয়ে তাদের নিজ দেশের ফসল ও মাঠ দূষিত করবে। তাছাড়া কৃষকেরা জিএম বীজের জন্য আমেরিকান কোম্পানিগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

এক দশক আগে দিল্লিভিত্তিক 'ফোরাম ফর বায়োটেকনলজি এন্ড ফুড সিকিউরিটি'র চেয়্যারম্যান দেবিন্দর শর্মা জিএম প্রযুক্তি ভারতীয় কৃষিকে আমেরিকার কর্পোরেশনগুলোর কর্তৃত্বাধীন নিয়ে আসবে বলে আশংকা করেন। আমেরিকা থেকে জিএম খাদ্য আমদানির ব্যাপারে চীন বেশ সাবধান। চীন নিজ দেশে জিএম প্রযুক্তি গবেষণায় চীন যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। জিএম তামাক উদ্ভাবন করেছে। ইউরোপ অবশ্য এই তামাক আমদানি নিষিদ্ধ করেছে।

মহাইকো-মনসান্তো শুধু ভারতেই নয় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশসমূহেও বিটি বেগুনচাষে বীজ বাজারজাতকরার লক্ষ্য স্থির করে। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে মাজরাপোকা প্রতিরোধশীল বিটি বেগুন বীজ বাজারজাতের চেষ্টা চলছে। কয়েকটি বৃহত্তর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে বেশ সচেষ্ট। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের ভিত্তিতে বছরে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বেগুনের চাষ হয়। এই বেগুন চাষে প্রায় ১০ হাজার কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। গত দুই দশকে বেগুন আবাদি জমির পরিমাণ শতকরা ৭৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামীতে বেগুনের চাহিদা ও আবাদ প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বীজের প্রয়োজনও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। মহাইকো ইতিমধ্যে বাংলাদেশে স্থানীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বীজ কোম্পানির সহায়তায় বিটি বেগুন বীজে সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। বিটি বেগুনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি প্রতিবাদ করা হয়েছে। আদালতে মামলা দায়েরও হয়েছে। উল্লেখ্য বিগত দশকের মাঝামাঝি সময়ে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল যে যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ব্যতিরেকে বাংলাদেশে জিএম বীজ ব্যবহার করা হবে না।

এটা অনস্বীকার্য যে জিএম প্রযুক্তির পরিবর্তে প্রচলিত পদ্ধতিতে উত্তম শস্য আবর্তন ও সেচ দিয়ে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণে ও ক্ষয়রোধ করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। পুরানো পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত সংকরজাত স্থানীয় উপযোগী, কীটপতঙ্গ প্রতিরোধক ও প্রকৃতিবান্ধব হতে পারে। তবে জিএম পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত ফসলের জাতও ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদাপূরণে সহায়ক হতে পারে। তাই বলে পশ্চিমা দেশসমুহে সৃষ্ট ও উপযোগী জিএম প্রযুক্তি ব্যবহারে অন্য কোনো দেশকে বাধ্য না করাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে। বরং উচিত হবে নিজ নিজ দেশে উপযোগী জাত উৎপাদনে বায়োটেক অবকাঠামো উন্নয়ন। জিএম পদ্ধতিতে ফসলের জাত উদ্ভাবন যে বড় বড় বায়োটেক ফার্মকেই করতে হবে তা নয়।

কোনো প্রতিষ্ঠান বা গবেষক টিম যারা স্থানীয় চাহিদা সম্পর্কে অবগত তারাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন উগান্ডাতে জাতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থা এমন একটা ভুট্টার জাত তৈরি করেছে, যেটা শুধুমাত্র রোগবালাই সহনশীলই নয়, যে জমিতে নাইট্রোজেনের অভাব আছে, সে জমিতেও ভালো ফলন দেয়। কেনিয়ার এগ্রনমিস্টদের উদ্ভাবিত মিষ্টি আলুর জাত ভাইরাস আক্রমণ ঠেকায়। একইভাবে পশ্চিমা দেশসমূহ খরা সহনশীল, রোগ প্রতিরোধক এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে। সুতরাং ভিন্ন দেশের নির্দেশে, প্রযুক্তি বা নীতির ভিত্তিতে যে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে তা নয়। নিজস্ব বায়োটেক অবকাঠামো উন্নয়ন করে প্রয়োজনের গুরুত্ব অনুযায়ী ফসলের জাত উদ্ভাবন সম্ভব। ব্রাজিল ও চীন নিজ নিজ দেশে জিএম প্রযুক্তিতে বীজ তৈরি করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে।

এ পর্যন্ত জিএম ফসলের স্বাস্থ্যঝুঁকির ওপর যত গবেষণা হয়েছে, তার বেশির ভাগই করেছে কোম্পানি নিজেরাই এবং তাদের ফল হচ্ছে 'জিএম ফসল নিরাপদ। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন স্বাধীনভাবে পরীক্ষা করেছেন তখন তারা প্রাণী গবেষণায় ক্ষতিকর ফলাফল পেয়েছেন। ২০০৩ সালে কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত পাঁচটি গবেষণায় 'কোনো ক্ষতিকর ফলাফল নেই' বলে দেয়া হলো, কিন্তু একই সময়ে তিনটি স্বাধীনভাবে করা গবেষণায় 'মাত্র ১৪ দিন পরেই প্রাণীর শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায়।' প্রাণী গবেষণার ক্ষেত্রে কোম্পানির গবেষণা পদ্ধতিতেও সমস্যা ধরা পড়েছে। তারা প্রাণীর ওপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা (Scientific Study) ও প্রাণী নিয়ে জিএম উত্পাদন পরীক্ষা (animal production exercise) এর মধ্যে কোনো পার্থক্য না করেই ফলাফল দিয়ে দেন। বিজ্ঞানীরা এ ধরনের অনেক গবেষণার সারমর্ম (abstract) ২০০৪ সালে তুলনা করে দেখেছেন যে, ৬৭ শতাংশ ক্ষেত্রে ফলাফল দেখা গেছে, জিএম খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথচ এ গবেষণার ভিত্তিতেই দাবি করা হয়েছে, জিএম নিরাপদ। প্রাণী গবেষণার ক্ষেত্রে কোম্পানি কিছু কৌশল অবলম্বন করে, যেন ক্ষতিকর প্রভাব ধরা না পড়ে। যেমন তারা গবেষণার প্রাণী নির্ধারণের সময় বেশি বয়স, জিএম ফসলের পরিমাণ কম দেয়া, বেশি রান্না করে দেয়াসহ নানাভাবে প্রভাব কমানোর চেষ্টা করে। ২০০৭ সালে মাত্র একটি গবেষণা হয়েছে মানবদেহে কিন্তু জিএম খাদ্য বাজারজাত করার পর যখন তা ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে, তখন কোনো প্রকার গবেষণা বা তদারকি নেই। যারা খাচ্ছে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, হলে কী ধরনের হচ্ছে, তা জানতে কোম্পানি আগ্রহী হয় না। কারণ একবার বাজারজাত হয়ে গেলে তা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, তখন অন্য কারো কথায় কান দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

জিএম পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত জাতের ফসল উৎপাদন করে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হল আমেরিকা। সারাবিশ্বে উৎপাদিত ভুট্টার একটা বড় অংশ এই দেশে উৎপাদন হয়। আমেরিকা সয়াবিন উৎপাদনেও এগিয়ে। এই সমস্ত ফসল রফতানি করে আমেরিকা আয় বৃদ্ধি করেছে। আমেরিকানদের মতে জিএম ভুট্টা নিরাপদ। কোনো রকম প্রাণঘাতী বিকিরণ থেকে এটা উদ্ভাবন করা হয়নি। সাধারণ ভুট্টার মতো। ব্যতিক্রম শুধু যোগ করা হয়েছে একটি জিন যা বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে বিটি ব্যাকটেরিয়া থেকে স্থানান্তর করেছে। এই জিন ভুট্টার কীটপতঙ্গ আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।

আমেরিকার কৃষিশিল্পের মতে এই প্রযুক্তি এক বিরাট সফলতা। এতে কীটনাশক ব্যবহার কমে গেছে। আমেরিকার স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটি ভুট্টাতে কোনো দোষ পায়নি। তাদের মতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির আশংকা নেই। আমেরিকা ২০১০ সালে বিশ্বে উৎপাদিত মোট ভুট্টার শতকরা ৩২ ভাগ, সয়াবিনের ৫০ ভাগ ও তুলার ৩০ ভাগ উৎপন্ন করেছে। উৎপাদিত ভুট্টার শতকরা ২০ ভাগ রপ্তানি করেছে। গম উৎপাদন এবং রফতানিতেও আমেরিকার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভুট্টা, সয়াবিন, গম ও তুলা রপ্তানি থেকে ২০১০ সালে আমেরিকার আয় হয়েছিল যথাক্রমে ৬৪, ৩৮, ১৫ ও ৮ বিলিয়ন ডলার।

অনেক দেশ আমেরিকাতে উৎপাদিত এই জিএম ফসল আমদানি থেকে বিরত থেকেছে। সারাবিশ্ব এই মোহরাঙ্কিত খাদ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। উন্নত দেশে জিএম খাদ্যের উৎপাদন আধিক্যে ও রপ্তানিতে অন্যান্য দেশে ফসলের মূল্য কমিয়ে দেবে। এই সমস্ত দেশের কৃষকরা পড়বে বিপদে। গত দশকের শুরুতে আমেরিকায় জিএম পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক জিন দিয়ে উদ্ভাবিত ভুট্টা, সয়াবিন ও টমাটো দেখে ইউরোপিয়ানরা মুখ ঘুরিয়েছে। ভারত আমেরিকা থেকে খাদ্য সাহায্য হিসেবে ভুট্টা ও সয়াবিন নেওয়া বন্ধ করে দেয়। জাম্বিয়া আমেরিকার ভুট্টা নিতে অস্বীকার করে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাম্বিয়ার এই অস্বীকৃতি এক বিরাট উদাহরণ সৃষ্টি করে। গ্রিন পিস এটাকে এক বিরাট সাফল্য বলে অভিহিত করে। জিএম-এর বিপদ নিয়ে গ্রিন পিস সরব রয়েছে।

মানুষের জীবনরক্ষার জন্য জিএম প্রযুক্তি হয়তো সহায়ক হতে পারে। তবে এই প্রযুক্তির অপব্যবহার যেন না হয়, তার জন্য মূল্যায়ন, পরিবীক্ষণ ও সাবধানতা জরুরি। উপযোগিতা যাচাই না করে 'অলক'-সহ কয়েকটি ভারতীয় হাইব্রিড ধানের বীজ বিগত নব্বই দশকের মাঝামঝি থেকে বাজারজাতে পরবর্তী কয়েক বছর অনেক কৃষক বেশ খেসারত দিয়েছে। একইভাবে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা নেরিকা ধানের বীজ সরবরাহের ফলে কৃষকরা বিপাকে আছে। এরমধ্যে বিশদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যতিরেকে নতুন করে বিটি শস্য চাপিয়ে দিলে কৃষকেরা আর এক বিড়ম্বনার শিকার হতে পারে।

*** In my article based on social awareness. The awareness of the need to share my article to awake consciousness and ask me about this, if you have any queries regarding the article then make comments or leave out suggestions as well***

গ্রন্থকার:
আশরাফুজ্জামান মিনহাজ
গবেষক ও পিএইচডি, ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

***আমার লেখা প্রবন্ধটি সামাজিক সচেতনতা মূলক।তাই, প্রবন্ধটি শেয়ার করে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহয়তা করুণ এবং এই বিষয়ে আপনার কোনো জিজ্ঞাসা, মতামত অথবা পরামর্শ থাকলে দয়া করে মন্তব্য করুণ***

*** In my article based on social awareness to share my article to awake consciousness. Now, you're cordially invited to read through article or comments below and share your own thoughts through the comment box.***

Penman:
Ashrafuzzaman Minhaz​
Researcher at York University​,Canada
Ph.D in Public Administration and Good Governance,York University.

https://twitter.com/A_Minhaz
www.facebook.com/Minhaz

Member of the federal executive committee of Conservative Party of Canada – Parti conservateur du Canada​