গোল্ডেন জিপিএ বনাম শিক্ষার মান এবং শিক্ষা সংস্কার প্রসঙ্গে

আশরাফুজ্জামান মিনহাজ
Published : 17 Nov 2015, 06:28 PM
Updated : 17 Nov 2015, 06:28 PM

২০১১ সালে শুরুর দিকে কানাডা সরকারের আর্থিক সহযোগিতা মূলক একটি প্রকল্পে পৃথিবীর ৪৫ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন , উন্নয়ন এবং ব্যস্তবায়ন শীর্ষক একটি প্রোজেক্ট এ আমি Project Director এবং The Honorable Liz Sandals, Minister of Education, Canada চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন ! এই প্রোজেক্ট এ কাজ করার মাধ্যমে দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থার নানান বিচিত্র সিস্টেম এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম যা পরবর্তীতে আমাকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে লিখতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আমার এই প্রবন্ধটি ২০১২ সালে National Post, Canada প্রত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বস্তরে অনেক সমাদৃত হয়ে আমাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।

গত ৭ মে ২০১২ এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। এ যাবৎকালের সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ৮৬ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী এ পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ ১০০ জন পরিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৬ জন জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় পাশ করেছে। ৬৫ হাজার ২৫২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে। দাখিল এবং কারিগরী মিলিয়ে এই সংখ্যাটা ৮২ হাজারেরও উপরে। তারমানে এরা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি মেধাবী। প্রায় ১২ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৮২ হাজার পরিক্ষার্থী হচ্ছে দুধের সর। দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ফেললে উপরে একটা আস্তরণ পরে। এটাকে সর বলা হয়। জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা হচ্ছে দুধের সর টাইপের। এদের মধ্যে আবার সব বিষয়ে এ প্লাস পাওয়াদের বলা হয় গোল্ডেন জিপিএ প্রাপ্ত। তাদেরকে দুধের ছানা বলা যেতে পারে।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় এত বিপুল পরিমাণ জিপিএ প্রাপ্তদের নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আসলেই কি এই শিক্ষার্থীরা এত মেধাবী? জিপিএ পাঁচ প্রাপ্ত এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই আত্মতৃপ্তিতে ভুগলেও ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পায় না। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ পেয়েও অনেকে প্রফেশনাল ভালো কোনো সাবজেক্টে ভর্তি পর্যন্ত হতে পারে না। সরকারের নীতি অনুযায়ীই এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী পাশ করছে। এতে দোষের কিছু নেই। জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তাদের মনোবল কমে যাবে। তাই যত বেশি সম্ভব নাম্বার দিয়ে তাদেরকে উত্তীর্ণ করে দেওয়া মনে হয় সরকারের নীতি। কিন্তু সর্বোচ্চ মেধাবী নির্ধারণে ঢালাও জিপিএ ৫ প্রদান হিতে বিপরীত হতে পারে।

১৬ কোটি জনগণের এ দেশে প্রতিবছর ১৬ লাখ (ঝরে পড়া সহ) অর্থাৎ ১% শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্য হয়। আমাদের পুরো দেশের শিক্ষার দৈন্যদশাই ফুটে উঠে এ পরিসংখ্যানে। যদিও প্রতিবছর এ সংখ্যাটা বাড়ছে কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য হারে নয়। এ বৎসর পাশ করা ৮৬ জন পরিক্ষার্থীর মধ্যে 'বি গ্রেড' 'সি গ্রেড' প্রাপ্ত অনেকেই ভর্তি হতে না পেরে কিংবা অর্থাভাবে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে দেবে। পরের উচ্চ মাধ্যমিক পাবলিক পরীক্ষায় দেখা যাবে এদের মধ্যে ৬০/৬৫ জন টিকে আছে। উচ্চতর শিক্ষায় যেতে যেতে এদের মধ্যে ২০/৩০ জন টিকে থাকবে।

১০০ জন পরিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৬ জন এসএসসি'র বৈতরণী পার হয়েছে- এটি তখনই খুশীর সংবাদ হতো যদি এই ৮৬ জনই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু তারা সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না। পারবে না কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি এবং ঘাটতি আছে। এই ত্রুটি কিংবা ঘাটতির প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের। আমাদের দেশে প্রণীত শিক্ষানীতি থেকেই সেই ত্রুটি বা ঘাটতির শুরু। শিক্ষানীতি হচ্ছে যে নীতির বলে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটা নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু থাকা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষানীতি নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু থাকে নি। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বোধ হয় বর্তমান সরকারের প্রণীত শিক্ষা কমিশন নিয়ে ৭ বার শিক্ষার উপরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থাটা লেজেগোবরে হয়ে গেছে। একেক সরকার একেক সময় শিক্ষাকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করেছে। শিক্ষার আওয়ামী কিংবা বিএনপিকরণ হয়েছে। মাঝে মাঝে ধর্মীয় টানাহেঁচড়াও হয়েছে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণও হয়েছে।

শিক্ষা একটি বিশাল খাত। ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর ৫০% শিক্ষিত ধরলে (যদিও প্রকৃত সংখ্যাটা আরও কম) স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ কোটি শিক্ষার্থী কোনো না কোনো সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছে। কোনো না কোনো শিক্ষকের কাছে পাঠ গ্রহণ করেছে। এদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়েছে। বাকি সবাই অন্যান্য পেশা বেছে নিয়েছে। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে দেশ ও সমাজ গঠনে শিক্ষা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক।

শিক্ষানীতি থাকলেও শিক্ষক নীতি নেই। শিক্ষকদের নীতি বলতে একটি সামাজিক নীতিকেই বুঝায়। কারণ শিক্ষকরা এই সমাজেরই অংশ। একজন শিক্ষক কিন্তু জন্মেই শিক্ষক হয় না। কেউ কেউ আছেন শিক্ষকতাকে ধ্যানজ্ঞান করেই এই পেশায় আসেন। আবার অনেকে অন্য কোনো পেশা গ্রহণের সুযোগ না পেয়েই শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। কারণ বিশাল এই সেক্টরটি কর্ম সৃষ্টির একটি বিশাল ক্ষেত্র। একটি আনুমানিক পরিসংখ্যান হচ্ছে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৬ লক্ষ শিক্ষক এই পেশায় নিয়োজিত। প্রাইমারি থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এই হিসাব। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে ১ জন শিক্ষক। এরা সমাজে আর দশটা পেশাজীবীর মতোই রক্তমাংসে গড়া মানুষ। এদের মধ্যেও ভাল মন্দের মিশ্রণ আছে।

বাংলাদেশে এরকম বুদ্ধিবৃত্তিক বিশাল আর কোন পেশা খাত সম্ভবত নেই। শিক্ষকতা পেশায় আসার সময় একজন শিক্ষক মানবিক গুণাবলি নিয়েই আসে। যে শিক্ষকতা পেশাতে মনপ্রাণ ঢেলে দেয় তার মধ্যে নীতি এমনিতেই স্বাভাবিক ভাবে চলে আসে। আর যে এই পেশাতে শুধু না পারতেই আসে তাকে শত নীতিমালা প্রণয়ন করেও নীতি শেখানো যাবে না। যে শিক্ষক নীতিহীন ধরে নিতে হবে শিক্ষকতা পেশাকে সে শুধু নিজের জীবিকা উপার্জনের একটি অবলম্বন হিসেবেই নিয়েছে। কিন্তু মনপ্রাণ ঢেলে দেওয়া একজন শিক্ষক যদি জীবিকা উপার্জন করে ভদ্রোচিতভাবে চলতে না পারে সেও নীতিহীন হয়ে যেতে পারে।

মানবতা একটি বিশাল গুণ। এই গুণ সবাই অর্জন করতে পারে না। যথোপযুক্ত শিক্ষিত না হয়েও অনেকের মধ্যে মানবতা থাকতে পারে। আবার যথেষ্ঠ শিক্ষিত হয়েও কারও মধ্যে এই গুণটি অনুপস্থিত থাকতে পারে। একজন শিক্ষক একজন দেশ গড়ার কারিগর। আর দেশ গড়ার কারিগর যিনি তার মধ্যে তো নীতি নৈতিকতা, মানবিকতা অবশ্যই থাকতে হবে। এর পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাও থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একজন শিক্ষক কতটুকু স্বচ্ছল? যাদের হাতে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে উঠবে- তাদের আজ বড় দুঃসময়। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক দৈন্যতা এখন প্রহসনের বিষয়। শিক্ষক মানেই ধরে নিতে হবে তার সংসারে আজীবন টানাপোড়েন। কিন্তু জীবনতো এভাবে চলে না। তাই বাধ্য হয়ে সবাই নীতিহীনতার দিকে ছুটছে। আমি মনে করি যে শিক্ষক ক্লাশে ঠিকমতো না পড়িয়ে প্রাইভেট কিংবা কোচিং এ বেশি উৎসাহী সে শিক্ষকের নীতি ঠিক নেই। কিন্তু রাষ্ট্র তো তাকে সম্মানজনক উপার্জনের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তাই সে বাধ্য হয়ে শিক্ষার মতো মহান পেশাকে কলুষিত করছে।

সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রাণোচ্ছ্বল মানুষগুলোকে শিক্ষকতা পেশায় আনতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রাণোচ্ছ্বল জাতি গঠন করা। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা কি সেই জাতি গঠনে সঠিক নেতৃত্ব তুলে আনতে পারছে? যাঁরা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছেন তাঁরা না হয় শিক্ষার সাথে জড়িত কিন্তু এই নীতিটি যারা সংসদে বাস্তবায়ন করবেন তাদের মধ্যে কতজন আছেন শিক্ষানুরাগী?

প্রসঙ্গক্রমে একটি উদাহরণ টানি। দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলে বতসোয়ানা নামে একটি দেশ আছে। দেশটি ১৯৬৬ সালে স্বাধীনতা লাভ করেছে। স্বাধীনতা লাভ করেই তারা একটি কাজ করেছে। ভিশন-২০১৬ নামে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। ৫০ বছরের একটি ভিশন। এই ভিশনের প্রথমেই কি আছে জানেন? শিক্ষার কথা। ২০১৬ সালের মধ্যে ৮০% লোককে তারা শিক্ষিত করে তুলবে। অবাস্তব কোন পরিকল্পনা কিন্তু করেনি। বলেনি যে আমরা ১০০% ই শিক্ষিত করে ফেলবো। তাদের সমস্ত কার্যকলাপ সেই ভিশন-২০১৬ কে কেন্দ্র করেই চলছে।
আর আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরও কি করছি। শিক্ষাকে কাটছি, চিড়ছি এবং পরিশেষে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার উপর দোষারোপ করে হা-হুতাশ করছি। কেনো আমরা শুধু শিক্ষার জন্য একটি ভিশন দাঁড় করাতে পারছি না। এত এত স্থায়ী কমিশন করছি (নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, আইন কমিশন) কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে কেনো একটি স্থায়ী কমিশন করতে পারছি না? কেনো আমরা শিক্ষাকে রাজনীতির আজ্ঞাবহ করে ফেলছি? কে দেবে এই প্রশ্নের জবাব? কেনো রাজনৈতিক সরকারগুলো শিক্ষাকে উঠে আসতে দিচ্ছে না? দেশ শিক্ষিত হয়ে গেলে কি মাস্তান, চাঁদাবাজরা আইনপ্রণেতা হয়ে উঠে আসতে পারবে না এই ভয়?

শিক্ষা নিয়ে নানান সমস্যার কথা বলে শেষ করা যাবে না সত্যি। কিন্তু প্রধান কিছু সমস্যাকে তো চিহ্নিত করতে পারি। আমাদের দেশ শাসনে আদ্যোপান্ত শিক্ষিত সজ্জনদের তুলে আনতে না পারাটাই মনে হয় শিক্ষা বিস্তারে প্রধান সমস্যা। পত্রিকা খুললেই দেখা যায় একটি বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি পঞ্চম শ্রেণী-অষ্টম শ্রেণী পাশ। ঐ এলাকার সাংসদের প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতির জোরে সে এই পদ দখল করেছে। সে ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কি শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখবে? সে কি চাইবে তারচেয়ে বেশি শিক্ষিত হয়ে কেউ এলাকার মাথা হয়ে উঠুক?

সুতরাং পচনটা ধরেছে আমাদের মাথাতেই। শিক্ষকদের নীতির চেয়েও বেশি জরুরী দেশ শাসকদের নীতি, ব্যবসায়ীদের নীতি, পেশাজীবীদের নীতি প্রণয়ন করা। এরাও কিন্তু কোন না কোন সময় শিক্ষার্থী ছিল। শিক্ষার মূল নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে এরা সমাজটাকে কলুষিত করছে আরও বেশি। ভেবে দেখুন ১৬ লক্ষ শিক্ষকের মধ্যে কতজন নীতিহীন, কতজন ছাত্রী নিপীড়নকারী। যে দু'চারজন আছে তাদের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজটাকে কলঙ্ক দেওয়া হচ্ছে। আমরা শিক্ষকদেরকে পূজনীয় পর্যায়ে দেখছি বলে দু'একজনের পথভ্রষ্টতাকে আমরা বড় করে দেখি। দেখুন ডাক্তাররা, পুলিশরা, আমলারা কত কত ঘৃণ্য কাজ করছে কিন্তু আমাদের মনে ধারণা তারা তা করলে দোষের কিছু নয়। অনেক আমলা আছে সুন্দরী নারীদের যৌন হয়রানি করে কিন্তু তাতে সমাজের কাছে দৃষ্টকটু ঠেকে না। অনেক রাজনীতিবিদ আছে নারীদের ধর্ষণ করে বড় নেতা হয়েছে কিন্তু আমরা তা রাজনীতিবিদদের চরিত্রই এরকম বলে উপেক্ষা করি। সত্যি বলতে আমরা পুরো জাতির সবাই একটা কমন নীতি গ্রহণ করলে আজ জাতি হিসেবে আমরা এতটা নিচে নামতাম না।

সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের দেশে ব্যাক বেঞ্চাররা শিক্ষকতা পেশায় আসছে না। ব্যাক বেঞ্চাররা আসছে রাজনীতিতে। স্মরণ করে দেখুন তো আমাদের দেশের পলিটিশিয়ানদের মধ্যে কতজন ক্লাশের ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড বয়? ক্লাশের ব্যাক বেঞ্চাররাই পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে মাস্তানি চাঁদাবাজিতে নাম লিখিয়ে ঝুনাপাকনা হয়ে রাজনীতিবিদ হচ্ছে। আর এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি কলেজে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। নিবন্ধন পরীক্ষার মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নেওয়া হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি স্কুলে, প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সবকিছুই করা হচ্ছে কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে কিছুই কাজে আসছে না। আর সমন্বয় করার মতো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বও আমাদের নেই।

একজন শিক্ষক পেটে ভাত না জোটাতে না পারলে শিক্ষাদানে উৎসাহী হবে না এটাই স্বাভাবিক। একজন শিক্ষার্থী সংসারে শ্রম দিলে দু'পয়সার উপকার হবে ভেবে স্কুলে যাবে না এটাই স্বাভাবিক। একজন অভিভাবক সংসারে বাড়তি খরচের ভয়ে নিজেও শিক্ষা পায়নি সন্তানকেও পেতে দেবে না- এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের কথা আগে বলা আছে তারপর হচ্ছে শিক্ষার কথা। এই নীতিতেই আমরা চলছি। জনগণকে বুঝানো হচ্ছে আমরা তোমাদের জন্য অন্নের সংস্থান করতে গিয়ে জান পেরেশান করে ফেলছি। বস্ত্র, বাসস্থান তো পরে। এগুলোই করতে পারছি না শিক্ষা তো আরও পরের মৌলিক দাবি। কিন্তু যদি অন্নের পাশাপাশি শিক্ষার ব্যবস্থাটাও করে ফেলা যেতো তাহলে কি আমরা অচিরেই একটি শিক্ষিত জাতি পেতাম না?

এখন প্রশ্ন আসে অন্ন সংস্থানের পাশাপাশি কিভাবে শিক্ষাকে নিয়ে আসা যায়। একজন ব্যক্তিকে কর্মসংস্থানমূলক শিক্ষার আওতায় এনে সহজেই এ কাজটি বাস্তবায়ন করা যায়। কর্মমুখী নয় বরং কর্মসস্থানমূলক শিক্ষাই হতে পারে একজন শিক্ষার্থীর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সুযোগ সৃষ্টির উৎস। অর্থাৎ শিক্ষার পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে থাকবে।

এবার আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানের দিকে নজর দেওয়া যাক। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে আর আমাদের জীবনমান কমছে। বাড়তি অর্থ সংস্থান করতে গিয়ে জন্ম নিচ্ছে দুর্নীতির। সমাজের একজন মিটার রিডার থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ আমলা পর্যন্ত এই দুর্নীতির বিস্তার। একজন সুইপার থেকে আরম্ভ করে একজন রাজনীতিবিদ ও এই দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের নৈতিকতাবোধের অভাব। নিজেরটা আগে বুঝে নেই এই মনোভাবই আমাদের নীতিভ্রষ্ট করেছে।
একটি দুর্নীতি শত শত দুর্নীতির জন্ম দিচ্ছে। আজ যে ব্যক্তি বাজারে গিয়ে ১০০ টাকার পণ্য ১৫০ টাকায় কিনেছে সে কাল অফিসে গিয়ে এই বাড়তি অর্থ আদায়ের জন্য ২০০ টাকা ঘুষ খাবে। আজ যে লোকটি ৫ টাকা বাস ভাড়ার জায়গায় ১০ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছে সে অবশ্যই কাল কোনো না কোনোভাবে তা কামিয়ে নিবে। যে বেকার যুবকের চাকরি বাকরি কিছুই নেই সে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রাহাজানির পথ ধরবে। যে ঠিকাদার চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছে সে ইট বালু রড সিমেন্ট কম দিয়ে একটি যেনতেন স্থাপনা গড়ে দিবে। যে শিক্ষার্থীটি অর্থের অভাবে পড়াশুনা করতে পারছে না সে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে অন্যায় যে কোনো উপার্জনের পথে পা বাড়াবে। এভাবেই দুর্নীতির চক্র চলতে থাকবে।

আমাদের প্রতিবছর শিক্ষার্থী বাড়ছে। পাশের হার বাড়ছে। আমাদের আনন্দও বাড়ছে। কিন্তু আমরা শঙ্কিত হই এই ভেবে যে, আমরা কি আসলেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি? আমরা কি আসলেই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর নীতি-নৈতিকতা বৃদ্ধি করতে পারছি?

শিক্ষা সংস্কার: কয়েকটি বিবেচ্য বিষয় :
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের দেশে চিন্তা-ভাবনা যে একেবারে কম হয়নি, এর একটি প্রমাণ স্বাধীনতার আগে ও পরে অন্তত ১৫টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক গঠিত হয়েছিল কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন। এ কমিশন কর্তৃক প্রণীত রিপোর্টের সুপারিশমালা এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন ও কল্যাণমুখী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে এখনো অনেকখানি প্রাসঙ্গিক। অথচ মজার ব্যাপার হলো এ রিপোর্টটিকে পাশ কাটানোর কৌশল আবিষ্কার করার জন্যই পরবর্তী সময়ে গঠিত হয়েছে প্রায় ডজনখানেক শিক্ষা কমিশন। এ প্রবন্ধে আমি সে সব বিষয়ে যাব না। আমি এখানে শিক্ষার সংস্কার বিষয়ে খুব স্পষ্টভাবে ৩-দফা একটি প্রস্তাবনা তুলে ধরতে চাই। বলাবাহুল্য, এ ৩ দফা একটি শিক্ষা ব্যবস্থার ভৌত রূপরেখার খসড়া নয়; বরং মৌলিক ধারণাগত রূপরেখার আংশিক পটভূমি মাত্র। এখানে আরো বলে রাখতে চাই, আমি এ প্রস্তাবনা তুলে ধরতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি প্রধানত এ কারণে যে, আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে সক্রিয় চিন্তা-ভাবনার কিছু উদ্যোগ আছে। 'শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ' নামে একটি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেকে এ ব্যাপারে গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা করছেন। ৩-দফা প্রস্তাবনার ভিত্তিতে আমি তাদের সামনে আরো একটি দায়িত্বই তুলে ধরতে চাই।

ক. প্রথম দফা হিসেবে যে বিষয়টিকে সামনে আনতে হয় তা হলো, বিশ্বজনীন মূল্যবোধ। আমাদের শিক্ষা সংস্কারের ভাবনায় এ বিষয়টি এখন নতুন মাত্রায়, নতুন গুরুত্বে বিবেচনায় আনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বিশ্বজনীন মূল্যবোধ মানবসভ্যতার অতিপ্রাচীন ও শীর্ষস্থানীয় মহান শিক্ষারই স্পষ্ট কথা। অনেকেই হয়তো বলবেন এটা নতুন কোনো কথা নয়, অনেক পুরনো কথা। কিন্তু না; এ বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের আরো বড় নতুন প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে। আমরা যদি এটিকে বুঝতে চেষ্টা না করি তবে পুরনো জানা বিষয় বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারব, সমস্যার আসল জায়গাটা খুঁজে বের করা কঠিনই থেকে যাবে।সহজবোধ্য বিষয় হিসেবে অনেকেই হয়তো বলছেন, সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে, মানুষের জীবনধারা বদলাচ্ছে। মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস, শিক্ষা-সংস্কৃতি আধুনিকায়িত হচ- এটি তেমন নতুন কি? আমাদের শিক্ষার মধ্যে এর প্রভাব পড়ছে এবং আরো পড়বে- এটি চলমান বিষয়। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, এর মধ্যে একটি মৌলিক গুণগত পরিবর্তনের বাস্তবতা চলে এসেছে। মানব সভ্যতায় এর আগে বিশ্বজননীতা ছিল তত্ত্বগত ও মহৎ চিন্তার বিষয়বস্তু হিসেবে; কিন্তু এখন এটি বাস্তবতা। প্রাচীন গোষ্ঠীতন্ত্র আঞ্চলিক সভ্যতা, বৃহৎ সাম্রাজ্য, আধুনিক জাতীয়তাবাদ এবং বিশ্বায়ন- এসব কিছুই সভ্যতার স্বাভাবিক গতিতে ঘটে যাচ্ছে। মূল্যবোধের ক্ষেত্রে মানুষ বদলায় এবং অনেক কিছু ফেলেও দিতে হয়। তবে অতীতকে ঝেরে-মুছে ফেলে দিয়ে কেউ অগ্রসর হয় না বরং বলিষ্ঠ উত্তরাধিকারের সূত্র থেকে গড়ে ওঠে মূল্যবোধের সমৃদ্ধি। মানব সভ্যতায় বিশ্বজনীন মূল্যবোধ কোনো অপরিচিত বিষয় নয়। উন্নততর মূল্যবোধগুলো সবসময়ই বিশ্বজনীন।

আমরা জানি আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একাধিক স্বীকৃত ও অস্বীকৃত ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে সর্বাধিক মানসম্পন্ন ধারা হিসেবে যদি মূলধারার জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামটিকে ধরি তবে এর ভেতরে অনুসন্ধান করলে বিশ্বজনীন মূল্যবোধের অনেক ঘাটতি দেখতে পাব। শুধু তাই নয়, বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরী অবস্থান, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ছড়াছড়িও এর ভেতরেই আমরা দেখতে পাই। এ ব্যাপারে খুব মোটাদাগের কিছু উদাহরণ তুলে ধরে আলোচনা করতে গেলেও আলোচনা দীর্ঘ হবে।

এরপর যদি আমরা দেখতে চাই আমাদের মূলধারা বহির্ভূত ধারাগুলোতে বিশ্বজনীন মূল্যবোধ পরিপোষণের অবস্থা কি, তবে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। আমার অভিমত হলো ধর্ম, ঐতিহ্য, জীবিকা, বিশ্বায়ন, বহির্গমন ইত্যাদি কোনো অজুহাতেই কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে জাতীয় কারিকুলাম মনিটরিং ব্যবস্থার বাইরে রাখা উচিত নয়। এ বিবেচনায় আমাদের আলিয়া মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা, হাফেজিয়া মদ্রাসা, নূরানী মাদ্রাসা, মক্তব, প্রি-ক্যাডেট স্কুল, প্রি-ক্যাডেট মাদ্রাসাসহ ইংরেজি মাধ্যম দেশি বা বিদেশি কারিকুলামে পরিচালিত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম বিচার করে দেখতে হবে। আমাদের মাদ্রাসাগুলো যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখতে পাব, এখানে নানা মাত্রায় বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরিতা রয়েছে। ইসলামের মর্মবাণী যদি আমরা অনুসন্ধান করি তবে দেখতে পাব এর ভেতরে দেড় হাজার বছর আগের সমাজ পটভূমিতে বিশ্বজনীতার সুর আছে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ও বলিষ্ঠভাবে। কিন্তু বাস্তবে এখন মাদ্রাসা শিক্ষার ভেতরে চরম সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধবিশ্বাস, বদ্ধচিন্তা ও বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরী শিক্ষা। সুতরাং এ শিক্ষা যতটা না ধর্মের, তার চেয়ে বেশি রক্ষণশীলতা, অজ্ঞতা ও মতলববাজির। সুতরাং ধর্মের নাম শুনে এখানে থমকে দাঁড়ানোর বা মিইয়ে যাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। মাদ্রাসা শিক্ষাকে অবশ্যই বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরী অবস্থান থেকে অনুকূল অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। আমি মনে করি, এটি সম্ভব এবং এর কোনো বিকল্প নেই।
অতএব মাদ্রাসা শিক্ষার ভেতরে বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরিতার যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে রোধ করার পদক্ষেপ নেওয়া এবং এর অনুকূল পরিবেশের বিকাশ ঘটানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিষয়টির ভেতরে গেলে আমরা দেখতে পাব মাদ্রাসা শিক্ষার বিভিন্ন ধারার মধ্যে বৈরিতার দিকগুলো বিভিন্ন মাত্রায়। আর অনুকূল শিক্ষার ঘাটতিগুলোও বিভিন্ন মাত্রায়। আলিয়া মাদ্রাসার ভেতরে এটি যথেষ্ট আধুনিকতার মোড়ক দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ পর্যাপ্ত জ্ঞানসমৃদ্ধ পাশ্চাত্য বিরোধিতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্লোগানের মোড়ক এবং যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন ফ্যাসিবাদী ধ্যান-ধারণার বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে সেখানে। আর কওমি মাদ্রাসার ভেতরে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার নামে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি শেখানো হয়..
অতএব আবার ফিরে আসি আমাদের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশ্নে। এর ওপরে আধুনিকতার একটি লেবাস থাকলেও ভেতরে সংকীর্ণতা, অন্ধবিশ্বাস, কুযুক্তি ও মিথ্যা সাম্প্রদায়িক অহমিকার বিস্তর প্রভাব রয়েছে। বিভক্ত সভ্যতার যুগ থেকে বিশ্ব সভ্যতার যুগে আসার পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা এর ভেতরে রয়ে গেছে। সুতরাং মূল শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে বিশ্বজনীন মূল্যবোধের পরিমার্জিত প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা দেখেছি প্রচলিত বিভিন্ন ব্যবস্থায় এর অভাবের মাত্রাগত তারতম্য আছে। এক্ষেত্রে প্রস্তাব হলো- এক. প্রচলিত সব শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিমার্জনের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নীতিমালাবহির্ভূত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চলতে দেওয়া যাবে না। দুই. শিক্ষা সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় এমন একটি বোর্ড গঠন করা দরকার, যে বোর্ড আমাদের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্ক্যান করে এর ভেতরে বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরিতা, অন্তরায় ও ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান করবে। এ ধরনের একটি রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের একটি দিক, অর্থাৎ মূল্যবোধের দিকটি পুনর্বিন্যস্ত করা সম্ভব হতে পারে। পরিশেষে আরেকটি কথা বোধ হয় এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, তা হলো, বিশ্বজনীন মূল্যবোধ কোনো অবস্থাতেই শেকড় ছেঁড়া মূল্যবোধ নয়। বিশ্বজনীনতার নামে মূল্যবোধকে যদি শেকড়ছেঁড়া অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় তবে তা হবে ভয়ানক বিপজ্জনক।

খ. দ্বিতীয় দফা হিসেবে যে বিষয়টি সামনে আনা দরকার তা হলো, আমাদের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে ধর্মীয় শিক্ষার অবস্থানটা কি হবে? বর্তমানে আমাদের মূলধারার জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মশিক্ষা হিসেবে একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। যেখানে মুসলমানদের জন্য ইসলাম ধর্ম শিক্ষা, হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য হিন্দু ধর্ম শিক্ষা এবং অনুরূপভাবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য যার যার ধর্ম শিক্ষার বই। তবে এর মধ্য পড়ানো হয় শুধু ইসলাম ধর্মই। এখানে উল্লেখ করে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের ভূমিকা কিন্তু কম নয়। এখনো পর্যন্ত এ দেশের উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন স্কুল-কলেজগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্র্যান্ড নাম হিসেবে খ্রিস্টান ধর্মীয় শিক্ষার প্রচলন নেই। খ্রিস্টান মূল্যবোধের প্রভাব তো অবশ্যই আছে, তবে সেসব মূল্যবোধ বিশ্বজনীন মূল্যবোধের সঙ্গে খুব বৈরী বা অসঙ্গতিপূর্ণ, এমন বলা যায় না। তবে বিশেষ ধর্মের ব্র্যান্ড নামে পরিচালিত ধর্মীয় শিক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

বিগত শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই উপমহাদেশে একটা সাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হতে থাকে। আলীগড় মুসলিম কলেজ, কলকাতার হিন্দু কলেজ, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সূচিত হওয়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এক সময় গণমানুষের শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে সম্প্রসারিত হতে থাকে। প্রাইমারি স্কুল, মাইনর স্কুল, সেকেন্ডারি স্কুল ইত্যাদির মধ্য দিয়ে শিক্ষার বুনিয়াদি স্তরগুলো মফস্বল শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত গণমানুষের নাগালের মধ্যে সম্প্রসারিত হতে থাকে। এই যে গণমানুষের জন্য সম্প্রসারিত শিক্ষা ব্যবস্থা এটা বাস্তব কারণেই হয়ে উঠতে থাকে ধর্মনিরপেক্ষ। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ছেলেমেয়ের জন্য একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিন্তু প্রত্যেক ধর্মের শিশুদের বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয় হিসেবে ধর্ম বেশ যতœসহকারেই পড়ানোর ব্যবস্থা চালু হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত করে পাকিস্তান সৃষ্টির পরও সৌভাগ্যক্রমে প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার উত্তরাধিকারের ওপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার কাঠামোটা থেকে যায় বটে, তবে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হয় শরিয়তবদ্ধ ইসলামের নামে কড়া রক্ষণশীল সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ওপর ভিত্তি করে এবং তা বাধ্যতামূলক করা হয় তৃতীয় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত। আর ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা কাঠামোর ভেতরেও প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামকে প্রাধান্য দিয়ে তথাকথিত ইসলামী মূল্যবোধের নামে কড়া সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্ম শিক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তাবনার প্রসঙ্গটা আপাতত এখানেই শেষ করা যায়। তবে এরপরও একটি বিষয় উল্লেখ করে রাখতে চাই। আমাদের সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী মহলে কারো কারো এমন মত আছে যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্ম শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন নেই। এই মতটি খুবই অগভীর এবং কার্যত বিভ্রান্তিকর। ধর্ম আমাদের সমাজ ও জীবনধারার অবিচ্ছিন্ন বাস্তবতা এবং এটা কোনো ভুঁইফোড় বাস্তবতা নয়। ধর্ম বলতে আমরা কী বুঝি সে নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য বা ভুল বোঝাবুঝি আছে; ধর্মের বহিরাঙ্গিক রূপ নিয়ে বোদ্ধা মহলে নাক সিঁটকানোর কারণ খুব সঙ্গতভাবেই আছে। কিন্তু ধর্ম শুধু এই দোয়া-কালাম, তন্ত্রমন্ত্র বা বহিরাঙ্গিক রূপটির নামই নয়। ধর্ম এর চেয়েও অনেক গভীর এবং জীবনবোধের গতি-প্রকৃতি নির্ণায়ক শক্তি। মর্মার্থের বিবেচনায় বোদ্ধা এবং না বোঝা সব মানুষের জীবনেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্মের প্রভাব ক্রিয়াশীল। মানব সভ্যতায় পেশাদারিত্বের উৎকর্ষের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্ভব ঘটেছে কয়েক শ' বছরের মধ্যে আর মানুষের ধর্ম শিক্ষার ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। ৩শ' বছর আগেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়বস্তু প্রায় সবটাই ছিল ধর্মের অথবা ধর্মাশ্রয়ী। জীবিকার জন্য শিক্ষা খুব গভীরতর অর্থে উঁচু মূল্যবোধ নয় এবং প্রাচীনকালে তা একেবারেই ছিল না। প্রাচীনকালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল মূলত মানবিক ও চিত্তবৃত্তিক উৎকর্ষের লক্ষ্যে। সঙ্গত কারণেই তা কখনো কখনো আধ্যাÍিক শিক্ষা হিসেবে অভিহিত হয়েছে এবং সাধারণভাবে ধর্মীয় শিক্ষা হিসেবে। শিক্ষার বিষয় হিসেবে ভাষায়, ব্যাকরণ, সাহিত্য, তর্কশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস, দর্শন এমনকি জ্যোতির্বিদ্যা, দেহতত্ত্ব ও চিকিৎসাশাস্ত্র ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে শিক্ষাদান করা হয়েছে। আমরা আমাদের সভ্যতার শেকড়টা খুব মোটা দাগে খুঁজতে গেলেও দেখি যে, প্রাচীন সব মহাকাব্য ও মহাগ্রন্থ ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত নায়ক ….

গ. তিন নম্বর যে বিষয়টি এ প্রস্তাবনায় আনতে চাই হা হলো- জীবনবোধ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে উন্নততর জীবনবোধ গড়ে তোলার বিষয়টি কোন পর্যায়ে আছে তা আবার নতুন করে খতিয়ে দেখতে হবে। আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা জীবনের নানা দাবি গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্য করে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে এখানে এ শিক্ষায় উন্নততর জীবনবোধ হারিয়ে যাচ্ছে কি-না এমন একটা সন্দেহ উঁকি দেয়। জীবনবোধ বলতে কী বোঝায় তা অনুসন্ধান করার মধ্য দিয়েই এ কাজটি শুরু করা উচিত।

শিক্ষার ভেতর দিয়ে উন্নততর জীবনবোধ গড়ে তোলার বিষয়টি শুধু শিক্ষাসূচির বিষয় নয়, এটা শিক্ষা ব্যবস্থার পরিম-ল এবং শিক্ষা পরিম-লের সংস্কৃতিরও বিষয়। তবে প্রাথমিকভাবে যে জিনিসটি দেখতে হবে তা হলো শিক্ষাসূচির ভেতর দিয়ে বিষয়টি যথাযথভাবে পরিবেশিত হচ্ছে কি-না। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাসূচির ভেতরে এ পরিবেশনার ত্র"টি সীমাবদ্ধতা কিছুটা আছে। তবে সর্বাধিক মারাত্মক সমস্যা যেখানে তৈরি হচ্ছে সেটা হলো শিক্ষার পরিম-ল ও এর সংস্কৃতির ভেতরে অবক্ষয়। উন্নততর জীবনবোধের ঘাটতি এখন আমাদের শিক্ষার পরিম-লের ভেতরেই সৃষ্টি হয়েছে লজ্জাজনকভাবে। আমাদের শিক্ষা সংস্কারের প্রশ্নে ৩ দফা প্রস্তাবনার যেসব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী বিষয় বিবেচনায় আনার কথা বলা হলো এর মধ্যে এই জায়গাটা একেবারে তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের বিষয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, এমনকি সর্বোচ্চ শিক্ষার কোনো কোনো অঙ্গন পেটসর্বস্ব ও ভোগসর্বস্ব লোকদের করায়ত্ত। শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতি শুরু হয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের মাধ্যমে। এরপর তা সংক্রমিত হয়েছে শিক্ষকদের ভেতর। এখন শিক্ষাঙ্গনের নীতিনির্ধারক, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ- তাদের কে দুর্নীতিগ্রস্ত আর কি দুর্নীতিমুক্ত তার হিসাব করাই কঠিন। এমন শোচনীয় অধঃপতনের কারণটা কী! কারণ প্রধানত একটাই। জীবনবোধের অধঃপতন। জীবনের মর্মার্থ যাদের কাছে কয়েক টাকা বা কয়েক কোটি টাকার মতো তুচ্ছ প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয় এমন তুচ্ছ মানুষই এখন অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে শিক্ষা পরিম-লের কর্ণধার। এ লজ্জাষ্কর অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে খুব দ্র"ত এবং দৃঢ়তার সঙ্গে। এ জন্য আইন-আদালত, বিচার-শাস্তি ইত্যাদি আমাদের এখনকার আলোচ্য বিষয় নয়। শিক্ষাঙ্গনের ভেতরে এমন জীবনবোধ জাগ্রত হতেই হবে যেখানে নিম্নমানের এসব পেটসর্বস্ব মানুষকে ধিক্কার জানানোর লোকের অভাব না হয়। শিক্ষা পরিম-লের ভেতর থেকে সামাজিকভাবে তাদের বের করে দিতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি এর পরিম-লের ভেতরে ন্যূনতম সম্মানজনক জীবনবোধ জাগ্রত করতে ব্যর্থ হয় তবে এ শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ।*

গ্রন্থকার:
আশরাফুজ্জামান মিনহাজ
গবেষক ও পিএইচডি, ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

***আমার লেখা প্রবন্ধটি সামাজিক সচেতনতা মূলক।তাই, প্রবন্ধটি শেয়ার করে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহয়তা করুন এবং এই বিষয়ে আপনার কোনো জিজ্ঞাসা, মতামত অথবা পরামর্শ থাকলে দয়া করে মন্তব্য করুণ***

*** In my article based on social awareness to share my article to awake consciousness. Now, you're cordially invited to read through article or comments below and share your own thoughts through the comment box.***

Penman:
Ashrafuzzaman Minhaz​
Researcher at York University​,Canada
Ph.D in Public Administration and Good Governance,York University.

https://twitter.com/A_Minhaz
www.facebook.com/Minhaz

Member of the federal executive committee of Conservative Party of Canada – Parti conservateur du Canada​