সাউদির পথে পথে- ১

তাহের আলমাহদী
Published : 6 August 2016, 06:38 PM
Updated : 6 August 2016, 06:38 PM

অনেক কিছু হতে হতেও যখন কিছুই হয়ে উঠিনি তখন প্রবাসী হয়েছি৷ আমাকে খেয়ে পরে বাঁচতে হয়েছিল বাপের বিশালাঙ্কের ঋণের বোঝা মাথায় এবং পনেরজনের মৌলিক চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব পিঠে নিয়ে৷ অভিজ্ঞতা নিতান্ত ব্যক্তিগত, তবু বলছি৷ কেননা, একজন মানুষের পথে চলে যেতে যেতে, হোঁচট খেতে খেতে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতাটা কারো কাজে আসে না তা তো নয়৷ আর সব কিছু কাজে আসতে হবে তাও তো নয়৷

আমি যখন সাউদি আরব আসার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করলাম, তখন অনেক হিতাকাঙ্ক্ষী সাউদি প্রবাসী ভাই-বন্ধু নসিহত করেছিল, যাসনে, লাভ নেই, জীবনটা বরবাদ হয়ে যাবে৷ সাউদিরা আগের মতো নেই, অমানুষ হয়ে গেছে! নিতান্ত ত্যাড়া স্বভাব বলে অন্যের কথায় কান দেওয়া হয় না আমার৷ সাউদি আমি এসেছি, এই সাউদি আসতেও আমাকে জীবনটা মূল্য হিসেবে দিতে হয়েছে৷ এর থেকে পশ্চিমে যাওয়ার সাধ্য আমার ছিল না৷

আসার বারো দিন পর আমার একটা চাকরী হয়েছে৷ শরীকাহ হামুদ আসসালমী ওয়া শরীকাহ লিল হুন্দুসাহ (Hamud Al-Salmi And Partners Engineering Co.), এই নামটি আমার অনেকদিন মনে থাকবে৷ এখানে কাজ করতে এসেই সাউদি সম্পর্কে আমার শ্রুতধারণা পাল্টে গিয়েছিল৷ দশজন লোকের মধ্যে একজন ভারতীয়, টি-বয় মেহবুব; একাউন্ট্যান্ট সুদানি, পড়াশোনা বোম্বে ইউনিভার্সিটিতে; আমি বাংলাদেশি, ড্রাফটম্যান, বাকি সাতজন সাউদি নাগরিক এবং সকলেই ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশ করা প্রকৌশলী৷ এখানে এসে বুঝলাম সকল সাউদি অশিক্ষিত নয়, সাউদিরা ইংরেজি জানে না একথাও ঠিক নয়৷

তবে সাউদিরা আগের মতো নেই, এই কথা ঠিক৷ প্রায় সকলেই বললো সাউদিরা আগে দান খয়রাত করতো, এখন করে না৷ আসল ঘটনা হলো, আগে বাংলাদেশিরা আনা মিসকিন (আমি ভিক্ষুক) বলে হাত পেতে খয়রাত গ্রহন করতো, এখন সাউদিরা জেনে গেছে, বাংলাদেশিরা আসলেই মিসকিন নয়, তাই খয়রাতও দেয় না৷

অনেকেই মনে করে সাউদি এসেছি টাকা রোজগার করতে, যেভাবেই হোক টাকা রোজগার করতেই হবে৷ এরা হাতপাততেও দ্বিধা করে না৷ এই জাতীয় লোকদের কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ সাউদিরা বাংলাদেশিদের মিসকিন বা ভিক্ষুক মনে করতো৷ শহর ক্লিনিং প্রজেক্টে বাংলাদেশি ব্যতীত অন্য জাতি পাওয়া যাবে না৷

আগে বাংলাদেশিরা হাউস ড্রাইভার, দারোয়ান, কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো৷ এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে৷ এখন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানায় বাংলাদেশিরা কাজ করে, আগে এই কাজগুলো ভারতীয় ও ফিলিপিনোদের দখলে ছিল৷ বর্তমানে একজন বাংলাদেশি ননস্কিলড ওয়ার্কারও ঘণ্টায় চৌদ্দ-পনেরো রিয়াল বেতনে কাজ করে৷ এখন আর বাংলাদেশিরা আনা মিসকিন বলে হাত পাতে না৷

২০০৭ সালের মার্চের কোন এক শুক্রবার সকালে আমি কিছু কেনার জন্য বের হয়েছিলাম৷ এক সাউদি এসে বললো, আমার ঘর পরিষ্কার করে দিবি, পঞ্চাশ রিয়াল দিবো৷ মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল, ইচ্ছে করছিল একটা থাপ্পড় দেই৷ তবু নিজেকে সংযত করে জিজ্ঞেস করলাম, এশ শোগল ইনতা? (তোমার পেশা কি?/তুমি কি কাজ করো?) সে বলল, আনা ফি শোগল মাকতাব৷ (আমি একটা অফিসে কাজ করি৷) বললাম, কাম রাতিব? (বেতন কত?) – আলফিন রিয়াল৷ (দুই হাজার রিয়াল৷) আমি বললাম, আনা সাবা' আলফ৷ (আমার সাত হাজার৷) সে চোখ কপালে তুলে বললো, ইনতা মুহান্দিস? (তুমি ইঞ্জিনিয়ার?)

একটা বাকালায় (মুদি দোকান) দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল৷ দোকানদার বললো, ভাই সর্বনাশ করেছেন, সে এখন আপনার পেছনে লাগবে৷ আমি বললাম, লাগবে না৷ রিয়াদের হাইয়াল মাহমুদীয়ায় আমার পাশের ফ্লাটে ত্রিশজন লোক থাকতো৷ এদের মধ্যে একজন ভারতীয় কেরলি, সে মালায়ালাম আর ভাঙা ভাঙা আরবি ছাড়া অন্য ভাষা জানতো না৷

তখন আমি সাউদি এসেছি মাস দুয়েক হয়েছে মাত্র৷ একদিন তাদের বাসায় গিয়েছিলাম, দেখলাম ঊনত্রিশজন বাঙালি একজন কেরলের সাথে আরবিতে কথা বলে৷ জিজ্ঞেস করলাম আপনারা কতদিন যাবত একসাথে আছেন? বললো, মোটামুটি পাঁচ বছর৷ এরা সকলে একটি সিরিয়ান রেস্তোরাঁয় কাজ করে, একসাথে থাকা, খাওয়া, বসবাস৷ আমি তিরস্কারের ভাষায় বললাম, এত বছর একসাথে থেকেও একজন লোককে বাংলা শেখাতে পারলেন না, আপনারা আসলেই ব্যর্থ!

আমার কথা শুনে নাদুস-নুদুস টাইপের একজন ক্ষেপে গেলেন, বললেন, তোর তো বেডা সৌদিতে অনও দুই মাস অয় ন, তুই কি বুঝবি? হেতেরে বাংলা শিখাইলে হেতে আঙ্গো সব কথা বুঝি হালাইবো৷ কোন কিছু কি আর গোপন থাকবো? সেদিন আমি অনেক আহত হয়েছিলাম, কী বলে উলুম্বুসেরা! পরে জেনেছি, বাঙালির গোপনীয়তা হচ্ছে, অন্যদের হিংসা করা, তার সম্পর্কে বাজে আলোচনা করা৷ ভাষা শিখালে প্রতিপক্ষ সব হিংসা, হাসি-মশকরা বুঝে যাবে, তাই কাউকে বাংলা শেখায় না৷

এটা আমাদের জন্য সত্যিই দূর্ভাগ্যজনক, প্রায় বাইশ লক্ষ বাংলাদেশি বসবাস করে সাউদি আরবে৷ এদের সকলেই আরবী এবং হিন্দি ভাষা জানে৷ ব্যবহারিক দিক থেকে হিন্দি সাউদি আরবের দ্বিতীয় ভাষা, সরকারি হিসেবে তৃতীয়৷ এই অবস্থানটা বাংলার হতে পারতো, যদি বাঙালি হিন্দি শেখায় গুরুত্ব না দিয়ে বাংলা শেখানোতে গুরুত্ব দিতো৷ নিজের ভাষা অন্যকে শেখানোর মধ্য ফায়দা আছে, নিজের ভাষায় মনের সব কথা, সব পরিকল্পনা যেভাবে প্রকাশ করা যায়, অন্যের ভাষায় সেটা মোটেই সম্ভব নয়৷

——- আপনাদের ভালো লাগলে আরও লিখবো৷ সাউদি আরবে আমাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে পুরোপুরি লিখতে চাই৷