সাউদির পথে পথে- ২

তাহের আলমাহদী
Published : 10 August 2016, 05:30 AM
Updated : 10 August 2016, 05:30 AM

সাউদিতে নারী গৃহকর্মী

একবছরের বেশি সময় থেকে সাউদি আরবে নারী গৃহকর্মী প্রেরণ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে৷ যৌন ও অন্যান্য শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের কথা বলে এর বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম করে রেখেছে প্রবাসীরা৷ তবু নারী গৃহকর্মী প্রেরণ বন্ধ হয়নি, সব কিছু জেনে শুনেই নারীরা সাউদি আসছে৷

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে যাওয়ার সময়ের একটি ঘটনা প্রায়শ মনে পড়ে৷ রিয়াদের কিং খালিদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিলাম৷ সকাল পৌনে সাতটায় ফ্লাইট, স্বাভাবিক নিয়মেই কয়েক ঘণ্টা আগে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়েছে৷ ছয়টায় বাংলাদেশ থেকে আসা বিমানটিই আমাদের নিয়ে যাবে৷

ছয়টার কিছুক্ষণ পরে একজায়গায় মানুষের ঝটলা দেখে উঁকি মারলাম৷ দেখলাম, শতাধিক নারীর একটি দল একটা সিঁড়ি দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে নেমে যাচ্ছে৷ বুঝতে বাকি রইলো না, এরা বাংলাদেশ থেকে আগত নারী গৃহকর্মী৷ যে বিষয়টি আমাকে আহত করেছে, দল বেঁধে বাংলাদেশি পুরুষগুলো খুব বাজে ভাষায় মন্তব্য করছে৷ বিশ্রি গালাগালি করছে৷

আমি তামশা দেখছিলাম, আমার পাশে দাঁড়ানো এক প্রৌঢ় বললে, মাগিরা …  দিতে এসেছে, দ্যাশে কি বেটা ছেলে ছিল না! ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকানোর পর সে বললো, দ্যাখেন না, মাগি গো সৌদি আসনের কি দরকার আছিল? বললাম, ভাই দেশে যে মাগিটা রেখে এসেছেন সে কার কার সাথে শোয়া-বসা করছে সে খবর কি রেখেছেন? লোকটা তেড়ে আসছিল, বললাম, পরের মেয়েটাকে মাগি বলার আগে নিজের মেয়েটার কথা মনে পড়েনি আপনার? লোকটা থতমত খেয়ে গেল, আমি সরে পড়লাম অকুস্থল থেকে৷

পাবলিকের আলোচনা আর বাস্তব অবস্থায় বারবারই মনে পড়েছে, সাউদিতে আসা এইসব গৃহকর্মীদের চেয়ে আমাদের দেশে থাকা গৃহকর্মীরা কি বেশি নিরাপদ? আমাদের দেশে কি গৃহকর্মীদের যৌন নিপীড়ন হয় না, শারীরিক নির্যাতন হয় না? কোন নিপীড়নকেই একজন সুস্থ মানুষ সমর্থন করতে পারে না, আমিও পারি না৷ কিন্তু দেশে কোন অসহায় নারী প্রতিবেশিকে পঞ্চাশ টাকা সাহায্য করার পর তার দেহের প্রতি কি দাতা পুরুষটির লালসার নজর একবারও পড়ে না? বাংলাদেশে একটা দেহজীবি নারীর চেয়ে সাউদিতে খাদ্দামার ইনকাম কয়েকগুণ বেশি নয় কি?

আমাদের নারীরা অতি সুখের অসুখে সাউদি আসে না, বেঁচে থাকার লড়াই করতে সাউদি আসে৷ আমাদের রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা দিতে পারেনি৷ সাউদিতে নারী শ্রমিক আসাকে আমি তাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে পারি না৷

বর্তমান প্রেক্ষিতে সাউদি গমন

সাউদি আরবের ভিসা চালু হয়েছে, অনেক লোক ইতোমধ্যেই সাউদি এসেছে, অনেকেই আসার ধান্ধায় আছেন৷ সরকারীভাবে ভিসার মূল্য বেশি নয়, দুর্নীতিবাজ ভিসা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে যে ভিসার খরচ দেড় লাখের কিছু বেশি হতে পারতো তার মূল্য বারো-তেরো লাখ হয়ে গেছে৷ যারা ফ্রি ভিসায় কাজ করে অনেক ইনকামের আশা নিয়ে সাউদি আসছেন তাদের অবগতির জন্য বলছি, আপনি এসে কাজ নাও পেতে পারেন৷

সাউদি আরবের সবচেয়ে বড় নিয়োগকর্তা বিন লাদেন গ্রুফ কাজ না দিতে পেরে ইতোমধ্যে আশি হাজার বিদেশি কর্মীকে ছাঁটাই করেছে৷ সাউদি ওজের লিমিটেডের লক্ষাধিক শ্রমিক একবেলার খাবার পাচ্ছেন না৷ এগুলো বড় কোম্পানী, ছোট কোম্পানীগুলোর কথা বলার প্রয়োজন নেই৷

কাজ আছে হাউজ ড্রাইভার আর খাদ্দামার৷ বেতন আটশ থেকে এক হাজার রিয়াল৷ এই সব নতুন কর্মীরা ইচ্ছে করলেই স্পনসর (কপিল) বা পেশা পরিবর্তন করতে পারবেন না৷ এই সব ক্ষেত্রে ফ্রি ভিসার মানে হচ্ছে আপনার মালিক কখনো আপনার খবর নিবে না৷ সুতরাং ফ্রি ভিসা বলে হাউজ ড্রাইবার, কৃষি ইত্যাদি পেশায় আসার আগে অন্তত একবার ভাবুন, একহাজার রিয়াল বেতনে কাজ করে বারো লাখ টাকা আয় করতে আপনার একশত বিশ মাস সময় লাগবে৷ বর্তমানে কয়েক লাখ লোক দীর্ঘ বেকারত্বে আছেন, কাজ নেই৷

একটা ঘটনা বলে শেষ করবো৷ ২০০৭ সালের দিকে দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানী হুন্ডাই হেভি ইন্ড্রাস্টিজ বাংলাদেশ থেকে আটশ রিয়াল বেতনে একবছর মেয়াদে হাজার খানেক ননস্কিলড শ্রমিক এনেছিল৷ ভিসাসহ যাবতীয় খরচ হুন্ডাই বহন করেছে৷ কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যারা এসেছিল তাদের মোটামুটি পাঁচ লাখ টাকা করে খরচ হয়েছিল৷ ওইসব শ্রমিকেরা বাংলাদেশি ভিসা দালালদের কাছে প্রতারিত হয়ে সাউদি এসে বুঝলেন, আটশ রিয়াল বেতনে একবছরে পুঁজিই তুলতে পারবে না, লাভ তো দূরের কথা৷

পরে সকল শ্রমিক হুন্ডাই ছেড়ে পালিয়েছিল, এর ফলে হুন্ডাই আর কখনো বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা দেয়নি৷

***