এডওয়ার্ড মিঠু
Published : 7 March 2015, 06:52 PM
Updated : 7 March 2015, 06:52 PM

নাইট ডিউটি থাকলে আমি একবার না একবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। এটা আমার অভ্যাস। শুরু থেকেই যতোদিন গেছে নাইট ডিউটি থাকলে আমি ঢাকা মেডিকেলে একবার যাবই যাব। কিছু ঘটুক আর নাই ঘটুক। মাঝে মাঝে ভালো নিউজ করা যায়, করেছিও। আবার, মাঝে মাঝে অদ্ভুত কান্ড দেখা যায় এই ডিএমসিএইচএ। গত বছরের মাঝামাঝির একটা ঘটনা। আর সেই ঘটনা জীবন সর্ম্পকে আমাকে আরো একবার ভাবতে শিখিয়েছে।

রাত দেড়টার কাছাকাছি। মেডিকেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে ভেতরে ঢুকে ডিউটি ডাক্তারকে জিগ্যেস করলাম, " ভাই কোনো কিছু আছে না কি? কিছু বলতে আমরা যা বোঝায় তা তারা জানে। কিছু বলতে আত্নহত্যা আছে কি না, হত্যা আছে কি না। এক কথায় নিউজি আইটেম আছে কি না। মুরব্বি মতো ডিউটি ডাক্তার বলল, তেমন কিছু নাই। ইমারজেন্সি রুমে গিয়ে আবার তার তথ্য ক্রসচেক করলাম। ভাই কিছু আছে না কি? তো বলল, না তেমন কোনো ঘটনা নাই। শেষে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় নার্সদের জন্য বরাদ্ধ করা ডেস্কে আবার ক্রসচেক করলাম। কি ভাই কিছুই নাই। বলল, না।

কি আর করা। বাইরে রাখা গাড়িতে ওঠার সময় কানে এলো পাবনা ভাষা। দিনমজুর টাইপের একজন লোক মোবাইল ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে আর মাঝে মাঝে হাসছে। হাসিটা খুব একটা জোরালো না। তারপরও হাসছে যে তা বোঝা যাচ্ছে। আমি গাড়িতে না উঠে তার কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলাম।

"বাড়ি কোনে?"
বলল, "পাবনা"
বললাম "পাবনা কোনে?"
"স্যুজিনগর" (সুজানগর)

যাইহোক পরে যা শুনলাম তা আর আমি এখনও ভুলতে পারি না। ওই লোকের রংমিত্রি ছোট ভাই, যার বয়স ২৫ থেকে ৩০ হবে। সে একটা ছয় থেকে সাততলা উঁচু দালানে রং করছিল। সেখান থেকে একটা টিনের ঘরের ওপর পড়েছে। সেখান থেকে আবার মাটিতে পড়েছে। তারপর মারা গেছে। সেই ভাইকে ঢাকায় না পাবনায় দাফন করবে; সেই বিষয়ে কথা বলছিল কারো সাথে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এই লোকের আপন ছোট ভাই দুই এক ঘন্টা আগে মারা গেছে। না তার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন না কথার টোন। কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না।

আমি কনফার্ম হওয়ার জন্য আবার জিগ্যেস করলাম,
"আপনার আপন ভাই?"
লোকটি জানালো, "হ"
দ্বিধা যায় না, "মানে আপনার মায়ের পেটের ভাই?"
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।

আমি সত্যি সত্যি আশ্চর্য। এটা হতে পারে। এখন আর আমি আমার ইমোশন ধরে রাখতে পারলাম না। জিগ্যেস করলাম, " তাহলে আপনি হাসছেন কেন?" তার সরল উত্তর, "গ্রামের থেন মা কচ্চে উয়েক বাড়ি নিয়ে য্যাবের। এহন তা কি করা সুম্ভব। যে বিল্ডিংয়ের পর থেন পড়ে মারা গেছে উয়ের মালিক বিশ হাজার ট্যাকা দেচে। বাড়ি নিবের গেলে তার অদ্দেক শ্যাষ হয়া যাবি। তাই মাক বুযাচ্ছিলেম।"

তার কথা শুনে আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগলো। জিগ্যেস করলাম কোন মর্গে লাশ রাখা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুইটা মর্গ আছে। কেউ মারা গেছে এটা একবারে নিশ্চিত হলে তাকে মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা হয়। আর কেউ বেঁচে আছে এমন ধারনা করে হাসপাতালে আনার পর মারা গেলে হাসপাতালের সাথে লাগোয়া আরেকটি মর্গে রাখা হয়। তো আমি তাকে বললাম, চলেন তো দেখি আপনার ভাইকে। তো সে আমাকে নিয়ে গেল হাসপাতালের সাথে লাগোয় মর্গে। মৃত ওই লোকটির ছেঁড়াফাঁটা দেহটার দিকে তাকানো যচ্ছিল না। প্যান্ট শার্ট ছিড়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে….।

বাইরে এসে লোকটার সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছো হলো না। তারপরও জিগ্যেস করলাম," টাকাটা কি খুব দরকার ছিল?" লোকটি কোনো উত্তর দিল না। গাড়িতে উঠে হাসপাতালের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে খেলাম আর চিন্তা করলাম, "ইজ ইট লাইফ?"