কমরেড সিরাজ সিকদারঃ আগুনরঙা এক অধ্যায়ের প্রজ্জ্বলিত শিখার নাম

মিঠুন চাকমা
Published : 2 Jan 2013, 05:51 AM
Updated : 2 Jan 2013, 05:51 AM

২ জানুয়ারি, ২০১২ কমরেড সিরাজ সিকদারের ৩৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী

কমরেড সিরাজ সিকদারঃ আগুনরঙা এক অধ্যায়ের প্রজ্জ্বলিত শিখার নাম

কমরেড সিরাজ সিকদারকে ২ জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে তৎকালীন শেখ মুজিবের রাষ্ট্রীয় বাহিনী খুন করে। সে অনুযায়ী এ বছর তার ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।

তিনি ১৯৪৪ সালের ২৭ অক্টোবর শরীয়তপুর জেলার ভেদেরেগঞ্জে জন্ম নিয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৬১ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপরে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। তিনি কিছুদিন সিএন্ডবি বিভাগে চাকুরী করেন।

১৯৭১ সালের আগে তৎকালীন পরাধীন পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশে যে ক'জন 'সশস্ত্র লড়াই' করে দেশকে মুক্ত করার জন্য বাস্তব কাজে হাত দিয়েছিলেন তার মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন।

১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকায় সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে 'মাও সেতুঙ চিন্তাধারা গবেষণাকেন্দ্র' নামে একটি পাঠচক্র গ্রুপ গঠন করেন। প্রতিদিন তাঁরা বিকাল ৫ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত একসাথে বসে রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করতেন। এই পাঠচক্র গ্রুপে ৩ থেকে ৫ জন মাত্র অংশ নিতেন।

১৯৬৮ সালে তিনি 'পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন' নামে একটি থিসিস বা রানৈতিক প্রবন্ধ রচনা করেন। এই থিসিসকে ভিত্তি করেই ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারী ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের মীরেরবাগ গ্রামে ৪০-৫০ জন 'মাও সেতুঙ চিন্তাধারা গবেষণাকেন্দ্র' এর সদস্য মিলে গঠন করেন 'পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন'। এই মিলিত সভায় সর্বসম্মতভাবে তাঁর পেশকরা থিসিসটি তাদের সংগঠনের "রাজনৈতিক লাইন" হিসেবে গৃহীত হয়।

প্রতিষ্ঠার পরে তাঁরা প্রচারের লাইনকে বেশী গুরুত্ব দেন। এ সময় তারা ঢাকার পুরানা পল্টনের একটি অফিস থেকে একটি "সাইক্লোস্টাইল মেশিন" লুট করেন।

সিরাজ সিকদার তার থিসিসে মাও সেতুঙ প্রদর্শিত লাইন বা নীতিকে রাজনৈতিক সংগ্রামের সঠিক পথ ও মত হিসেবে যুক্তি উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি শক্তিশালী সংগঠন, সশস্ত্র বাহিনী গঠন ও যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন।

সিরাজ সিকদার এবং তার সংগঠনই প্রথম লালসবুজের পতাকা ওড়ায়।

১৯৭০ সালের ৮ জানুয়ারী সংগঠনের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকাসহ কয়েকটি জায়গায় তারা লালসুবজের সাথে তিনটি মশাল খচিত একটি পতাকা ওড়ান। এ পতাকাকে তারা স্বাধীন পূর্ববাংলা রাষ্ট্রের পতাকা হিসেবে উত্তোলন করেন।

১৯৭০ সালের ৬ মে হাত বোমার বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের সামরিক শাখার উদ্বোধন করেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষে স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়। তিনি এই সময় তার সংগঠনের কর্মীদের একত্রিত করে ৩০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে গঠন করেন "পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনী"। বরিশালের পেয়ারা বাগানের বিস্তীর্ণ এলাকাকে তাদেঁর ঘাটি এলাকা হিসেবে তিনি বেছে নেন।

১৯৭১ সালের ৩ জুন এক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করা হয় "পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি"।

দেশ ম্বাধীন হবার পরও তিনি সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে 'সশস্ত্র লড়াই' অব্যাহত রাখেন। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও এবং সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণীর শাসন কায়েম করার পথ তিনি বেছে নেন।

সংগ্রামের এক পর্যায়ে তিনি ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি তিনি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে আটক হন। পরে তাকে বিমানে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে 'ক্রসফায়ার' নাটক সাজিয়ে হত্যা করা হয়।
সমাপ্তি ঘটে এক বিপ্লব আকাঙ্খীর এবং এক প্রজ্জ্বলিত শিখার।

এই দিনে তাকেঁ লাল সালাম। স্যালুট কমরেড সিরাজ সিকদার।

শ্রমিক শ্রেনীর প্রতি বা শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতি তাঁর মহৎ আকাঙ্খার প্রতি সম্মান রেখেই তার বা তার সংগঠনের গড়া আন্দোলন বিষয়ে আমি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করতে চাচ্ছি।

মাও সেতুঙের কথায় সংগ্রাম বা বিপ্লব কোনো 'ভোজসভা নয়' এটা সত্য। বিপ্লব একটি অভ্যূত্থান বা বলপ্রয়োগের ক্ষেত্র এটাও সত্য। কিন্তু বিপ্লব বা একজন বিপ্লবী বা একটি বিপ্লবী সংগঠন "অন্যায্য" বলপ্রয়োগ করতে পারেনা । মাও সেতুঙ যখন লড়াই করছিলেন তখন তার কমরেডদের জন্য তিনি বা তাঁর সংগঠন যে নিয়ম বেঁধে দেয় তার একটি হচ্ছে, "জনগণের কাছ থেকে জোর করে একটি সুঁচ-সুতোও নেবেননা"।
কিন্তু সিরাজ সিকদার বা তার অনুসারীরা পার্টি গঠনের প্রারম্ভে প্রচার চাঙ্গা করার জন্য একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন "লূট" করেন। বিপ্লবের প্রারম্ভেই লড়াইেয়র ভুল পদক্ষেপ একটি 'টার্নিঙ পয়েন্ট' বলেই আমি মনে করি।

যারা সত্যিকারভাবে মুক্তির লড়া্ই করেন তাদের "ন্যায় যুদ্ধ" তা সশস্ত্র বা গণ অভ্যুত্থান যে ধরণেরই হোক তা অবশ্যই ন্যায়সংগত এই কথাটি মেনে নিয়ে এবং বিশ্বাস করে আমি এই ছোটো সমালোচনামূলক বক্তব্য রাখলাম।

বিপ্লব ভোজসভা নয় কিন্তু বিপ্লবের ধরণ বা পদ্ধতি বা কৌশল "নৈরাজ্য" বা "নৈরাজ্যবাদ" হতে পারেনা। বিপ্লব হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। বিপ্লব হলো একটি শিল্প। তা শ্রেনী ভিত্তিক এবং জাতিগত যেকোন লড়াইয়ের ক্ষেত্রেই সত্য বলে আমার মত।