রাঙামাটির সাজেকের লোকজন না খেয়ে নেই, বরং তারা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য চায়

মিঠুন চাকমা
Published : 19 July 2014, 06:34 AM
Updated : 19 July 2014, 06:34 AM

কয়েকদিন আগে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় হাড় জিরজিরে বেশ কয়েকজনের ছবিসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু ছিলো- রাঙামাটির দুর্গম এলাকা সাজেকের লোকজন খাদ্যের অভাবে ভুগছে। এ নিয়ে আরো বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয় বিভিন্ন মিডিয়ায়।

খবরটি স্থানীয় সরকারী প্রশাসনকে নাড়া দিলে আমি এ বিষয়ে কৌতুহলী হয়ে পড়ি। নানাভাবে এ নিয়ে তথ্য নিতে চেষ্টা করি। কিন্তু সময়ের অভাবে এ নিয়ে লেখালেখি করা হয়ে উঠেনি। এখনো বিস্তারিত লেখার মতো সময় হয়তো পাওয়া সম্ভব নয়!
তারপরও পয়েন্ট আকারে এ নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।

সাজেকবাসী উৎপাদিত ফসলের ন্যয্য মূল্য চায়, তারা তাদের শ্রমের ন্যায্য পাওনা পেতে চায়

সাজেকের লোকজন কি আদৌ খাদ্যের অভাবে ভুগছে?

রাঙামাটির সাজেক হলো পাহাড় পর্বতময় এক এলাকা। এখানে সমতলীয় এলাকার মতো ধান্যজমি নেই। এই এলাকার লোকজনের অধিকাংশই জুমচাষের উপর নির্ভরশীল। জুমচাষ সাধারণত শুরু হয় বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রথমে পাহাড় পরিষ্কার করা হয়। তাতে আগুন দেয়া হয়। তারপর কয়েকেদিন তা রেখে দেয়া হয়। এতে আগুনে পুড়ে যা ছাই হয়ে যায় তা মাটির সাথে মিশে গিয়ে মাটির উর্বরতাশক্তি বাড়িয়ে দেয়। এরপর এপ্রিল মে মাসের দিকে বীজ রোপেনের কাজ শুরু হয়। এখন জুলাই মাসে জুমে ধানের চারা তিরতির করছে। তবে এখনো ধানে শিষ আসেনি। এছাড়া অন্য চারাও বাতাসে নাচতে থাকতে। তবে এ সময় একমাত্র মামরা-চিন্দিরে বা মরিচ জাতীয় ফসল আসতে থাকে। এবং তা বিক্রি করেই জুমচাষীদের সংসার চলে।

জুন ও জুলাই মাসের এই সময়ে সাজেকের জুমচাষী লোকজন একটু অভাবে ভোগে তা নিয়ে সন্দেহ রাখা যায় না। তবে তারা যে না খেয়ে মরে যায় বা হাড় জিরজিরে হয় তা কিন্তু নয়!

সাজেকের রুইলুই মোনের ৮ নং গ্রামের কার্বারীকে এ নিয়ে প্রশ্ন করছিলাম। তিনি বললেন- এই সময়ে প্রচুর রোদ পড়ে। বৃষ্টিতেও ভিজতে হয়। একই সাথে তাল মিলিয়ে জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তিনি জানালেন, এখন ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দিচ্ছে। এই সময়ে একবার অসুখে পড়লে লোকজন এমনিতেই কাহিল হয়ে হাড় জিরজিরে হয়ে যায়। কিন্তু সাজেকের লোকজন যে একদম না খেয়ে থাকে তা কিন্ত নয় বলে তিনি জানান।

মাজালঙ বাজারে সপ্তাহ বাজারে আসা ভুওছড়ি গ্রামের শান্তি বিকাশ চাকমাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলাম। তিনি জানালেন, তাদের গ্রামে ৪০০ পরিবারের মতো বসবাস করছে। এলাকাটি দুর্গম এবং ভারতের সীমানার কাছাকাছি। গ্রামের সবার আর্থিক অবস্থা তেমন যে ভাল তা নয়। এই সময়ে অনেকেই অর্থকষ্টে ভোগে। এই সময়ে বাশ-গাছের ব্যবসা বন্ধ থাকে। ফলে লোকজন কিছুটা অসুবিধায় পড়ে। তবে সাজেকের লোকজন যে না খেয়ে থাকে তা তিনি মানেন না।

তার কাছ থেকে জানতে পারলাম তাদের গ্রাম থেকে এলাকাবাসী মামরা চিন্দিরে মরিচ নিয়ে মাজালঙ বাজারে আসে। কিন্তু ফসলের ন্যায্য দাম তারা পান না। মামরা ফলের কেজিপ্রতি দাম মাজালঙে মাত্র ১০ টাকা। কিন্তু এই ফলই এখন দীঘিনালা খাগড়াছড়িতে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজি দরে। অন্য ফসলের দামও তেমন বেশি নয়।

এরপরে মাজালঙ বাজার ঘুরে দেখলাম। দেখলাম জুম থেকে উৎপাদিত ফসল নিয়ে জুম্মনারীরা পসরা সাজিয়েছেন। কিন্তু মাজালঙ বাজার তো তেমন বড় বাজার নয়! কে কার জিনিস কিনবে!?

জুম্ম কুদুগুলো বা লাউ একটি দাম মাত্র ১০ টাকা!। বেগুন কেজিপ্রতি ৩০ টাকা! চারটি ছোটো ছোটো মুক্কে বা ভূট্টা সিদ্ধ অিাটি করে বাধা হয়েছে। দাম ১০ টাকা। ওজোন শাক নামে এক জুম্ম শাক-এর কয়েক আটির দাম এক ব্যবসায়ী হাকাচ্ছেন মাত্র ৫ টাকা! কাল্লোঙটি মাটিতে না নামাতেই জুম্ম কুমুরো বা পাহাড়ি লাউ আনা এক নারীকে বললাম, কুমুরোর দাম কতো? বললো ২৫ টাকা! দুপুর গড়াতেই এই কুমরোর দাম ১০-১৫ টাকার বেশি ঠেকবে বলে মনে হলো না!

জুমচাষীরা এত কষ্ট করে যে জিনিস উৎপাদন করলেন তার ন্যায্য দাম না পেলে তারা কিভাবে তাদের সংসার চালাবেন?!

কিন্তু এদিকে খেয়াল করলাম- প্রশাসন থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান মেম্বার ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার লোকজন চাল ডাল চান্দের গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছেন সাজেকে! তাদের উদ্যেশ্য যে তারা সাজেকবাসীকে 'সহযোগিতা' করবেন!

এ যে সাজেকবাসীকে অপমান করার সামিল!

এ যে সাজেকবাসীর কঠোর শ্রমের মূল্য না দিয়ে তাদের 'আলঝি'(অলস/কুড়ে) করে রাখার 'প্রাণান্তকর' প্রচেষ্টা!

এ যে প্রশাসন সরকার তথা 'মানবদরদীদের' ভন্ডামি!

সাজেকবাসীকে 'হাত পেতে' দিনযাপন করার জন্য কি তারা বলছেন!?

এতসব দয়া দক্ষিণা দান ত্রাণ প্রদান মানবিকতা না দেখিয়ে এই যে সাজেক এলাকার জনগণ এত কষ্ট করে জুম্ম ফসল উৎপাদন করে তার ন্যায্য দাম প্রাপ্তির নিশ্চয়তা করে দিতে কি এই সরকার প্রশাসন মানবদরদীরা কোনো উদ্যোগ নিতে পারেন না!?
তারা সেই উদ্যোগ নেবেন এই আশা রইল।

এবং লোকজনের মধ্যে ভিখারী স্বভাব জাগ্রত না করিয়ে তাদের শ্রমের মর্যাদা দিয়ে তাদের মানুষ হিসেবে নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সবাই সচেষ্ট থাকবেন এই প্রত্যাশা রইল।