অদেখা বঙ্গবন্ধু

মিন্টু চৌধুরী
Published : 15 Feb 2012, 06:19 PM
Updated : 16 August 2021, 05:42 PM

আমরা যারা একাত্তরের পরের প্রজন্ম অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি বা আশির দশকে জন্ম নিয়েছি তারা বঙ্গবন্ধুকে শিশু বা কিশোরকালে সেভাবে জানতে পারিনি বা বলা দরকার আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে সেভাবে জানতে দেওয়া হয়নি। সেসময়ে পারিবারিক আবহে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকলে আমাদের জাতির স্বপ্নদ্রষ্টাকে সেভাবে জানতে পারাটা অনেকটাই কঠিনই ছিল। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী একটা যুদ্ধ হয়েছিল, নয়মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল ততটুকুই ছিল আমাদের শিশু বা কিশোর বয়েসে জানার পরিধি। কিন্তু কার অঙ্গুলি হেলনে কখন, কে, কিভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বা বাংলার মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার গভীরে গিয়ে জানাটা অনেক কঠিন ছিল। পাঠ্যপুস্তক বা বিভিন্ন সরকারি নথিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার যোগ্যতম সম্মান দেয়ার ক্ষেত্রে একপ্রকার উপেক্ষাই করা হতো সেসময়ে। 

আমরাও সেসময় মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু নিয়ে খণ্ডিত ইতিহাস জানার মধ্যেই বড় হয়েছি। আমাদের সময়ে একাডেমিক পড়ালেখার মধ্য দিয়ে ভুল ইতিহাস জানানোর চেষ্টাই করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস কখনোই কাউকে ক্ষমা করে না। সময় পাল্টেছে, পাল্টেছে ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিও। আর প্রকৃত ইতিহাসকে কখনোই চাপা দিয়ে রাখা যায় না। বিরুদ্ধ সময়ে যখন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী শক্তির সাথে জোট করে ক্ষমতায় আসা সরকার বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস চাপা দেওয়ার চেষ্টায় রত ছিল, তখনও কিছু মানুষ তাদের একান্ত প্রচেষ্টায় প্রকৃত ইতিহাসের চর্চা করে গেছেন। 

বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক সচেতন মানুষ, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাকারী মানুষ, লেখক-সাহিত্যিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ইতিহাসের প্রকৃত ধারাটিকে চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। বিরুদ্ধ সময়েও বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের অনেক পাড়ায় মাইকে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ, দেশাত্মবোধক সঙ্গীত বাজানো হতো। কোথাও করা হতো পোস্টারিংও। তেমন সময়ে সাতই মার্চের ভাষণ শুনে বা চট্টগ্রামের শহীদ মিনারে বিভিন্ন দিবসে পুষ্পমাল্য অর্পণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর, স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামের সাথে সম্পর্ক এবং আরও বেশি বেশি করে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। বিভিন্ন জাতীয় দিবসের সকালে চট্টগ্রাম শহরের কোন কোন এলাকায় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ বাজানো হতো। মনে আছে সেই কিশোর বেলায় বঙ্গবন্ধুর ভরাট কণ্ঠের ভাষণে ভাঙ্গতো ঘুম। ভাষণ শোনার সাথে সাথেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠতো, একরকম অন্যধরনের অনুভূতির সৃষ্টি হতো। কিছু একটা করার তাগিদ তৈরি হতো ভেতর থেকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ থেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে এবং পরবর্তীতে প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে যাই। যতই বড় হয়েছি ততই বঙ্গবন্ধুকে জানার আগ্রহ বেড়েছে, সাথে জানার চেষ্টা করেছি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসও। নিজেদের চর্চা এবং নিজের ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিয়ে নিজের জানার পরিধি বাড়তে থাকে। আমার না দেখা বঙ্গবন্ধু পঠন-পাঠন এবং অগ্রজ মানুষের মাধ্যমে নিজের চোখের সামনে যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে বা হচ্ছে তা ভাবতেই অবাক লাগে। শেখ মুজিব আমাদের জাতির পিতা, বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিক পথ দেখিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশ কিভাবে এনে দিয়েছেন তা একপ্রকার বিস্ময়েরই। শেখ মুজিব সম্পর্কে যতই জানছি ততই নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে আমার কাছে। 

অনেকেই মনে করেন শুধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগেরই একার বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয়দফার আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, সাতই মার্চের ভাষণ, পরবর্তীতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধকে জনযুদ্ধে রূপ দেওয়া একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিল। একাত্তরের যুদ্ধকালীন নয়মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও কৃষক, মজুর, কিশোর, চাকরিজীবী, পুলিশ, ইপিআর, সেনা সদস্য, দলমত নির্বিশেষে সকলেই এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকেই। মুক্ত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে পাকিস্তানিদের হাতে আটক বঙ্গবন্ধুই হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতাকামী বাঙালির আরও বড় প্রেরণা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে দেশ গঠনে মনোযোগী হয়েছিলেন জাতীয় চার মূলনীতি ভিত্তিতে। যুদ্ধের বিরোধীতাকারীরা ছাড়া স্বাধীন দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের কাছেই স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে সম্মানিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শুধু বাঙালির জাতির পিতা নন একাত্তরের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রতীকে পরিণত হন। 

প্রতিটি মানুষেরই ছোট ছোট অনেক পরিচয় থাকে, সেসব পরিচয়গুলো পেছনে রেখে আস্তে আস্তে বড় পরিচয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া অনেক বড় মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। বঙ্গবন্ধু সেই সীমা তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। বাঙালি-বাংলাদেশকে তিনি তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব গুণাবলির মধ্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে বড় জায়গায় দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। অসামান্য একজন মানুষ ছাড়া এ অর্জন কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের জাতির জনক সেটা পেরেছিলেন।  

অথচ পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্টে সপরিবারে জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের মোড় ফিরিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অস্পৃশ্য। গোটা কয়েকটা প্রজন্ম বিশেষ করে আমাদের বয়েসী বা আমাদের কম বা কিছুটা বেশি বয়েসী আছেন তারা বড়ই হয়েছি বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে খন্ডিত ইতিহাস জানার মধ্য দিয়ে। তারপরও দমিয়ে রাখা যায়নি। ইতিহাস তার আপন পথ করে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে তার জায়গায় ঠিকই বসিয়েছে। 

যেকথা বলতে চাই, আমরা যারা বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি, পারিবারিক আবহ বা রাজনৈতিক আবহে, বিরুদ্ধ সময়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রামের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জেনেছি, তাদের কাছে জাতির পিতার মর্ম অনেক বেশি। আর এ প্রজন্মটাই যারা বঙ্গবন্ধুকে না দেখেই বড় হয়েছি তারাই এখন সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিশেষ করে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক বিভিন্ন স্তরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমান সময়ে বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু তার আদর্শ থেকে, চিন্তা থেকে কতটুকু আমরা নিয়ে সুখী বাংলাদেশ গড়তে পারছি সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। এ বছর আমাদের জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুরুর কাল। নতুন স্বপ্ন-নতুন আশা নিয়ে দেশ গড়ার শপথ নেয়ার গুরুত্বপূর্ণ সময়। এখন যারা কিশোর-তরুণ তারা বড় হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃতভাবে জানার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে ধর্মান্ধ-মৌলবাদি শক্তির আস্ফালন চলছে। আমাদের অদেখা বঙ্গবন্ধু যেভাবে শক্তি জুগিয়েছিল বাংলা-বাঙালি এবং জাতীয় চার মূলনীতির ভিত্তিতে জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরিতে সামিল হতে, সেভাবে নতুনদেরও এগিয়ে আসতে হবে ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।