মুবিনুল হায়দার চৌধুরী: জাসদ ভাঙার কারিগর

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 17 Feb 2012, 06:52 AM
Updated : 10 Nov 2021, 11:51 AM

এ বছর ৭ জুলাই অনেকটা নিভৃতে চিরবিদায় নিলেন বাম রাজনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। বাংলাদেশে এক ভিন্নধারার বাম রাজনীতির সূচনা করেন তিনি।  

মুবিনুল হায়দারের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে আসেনি। এমনকি বাম রাজনৈতিক দলগুলোও তার মৃত্যুতে অতোটা গুরুত্ব দিয়ে শোক প্রকাশ করেনি। সারা জীবন নিভৃতে থেকে রাজনীতি করেছেন মুবিনুল হায়দার। নিজের প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার পেছনে ছোটেননি আর দশজন রাজনীতিবিদের মত। তিনি যে মতাদর্শে বিশ্বাস করেছেন, সারা জীবন সব সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন সে মতাদর্শের প্রতি তার আনুগত্যের জায়গা থেকে—ব্যক্তিগত লাভ বা সুবিধা প্রাপ্তির জায়গা থেকে নয়।

মুবিনুল হায়দারের রাজনীতির ধরন কিছুটা সিরাজুল আলম খানের মত। সিরাজুল আলম খানের মত তিনিও লাইমলাইটে আসতে চাইতেন না। জাসদ যেমন সিরাজুল আলম খানের 'ব্রেইন চাইল্ড', তেমনি বাসদও হল মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর 'ব্রেইন চাইল্ড'। সিরাজুল আলম খানের জাসদকে ভাঙার মূল কারিগরও তিনি। তবে পার্থক্যের একটি জায়গা হচ্ছে- সিরাজুল আলম খান আনুষ্ঠানিকভাবে জাসদের কোনও কমিটিতে ছিলেন না। কিন্তু মুবিনুল হায়দার বাসদের নেতৃস্থানীয় পদে ছিলেন।

ভারতীয় নাগরিক মুবিনুল হায়দার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে আসেন ভিন্ন ধাঁচের বাম রাজনীতি গড়ে তোলার জন্য। ১৯৩৫ সালে চট্টগ্রাম জেলার বাড়বকুণ্ডে জন্ম নেন তিনি। কিন্তু ব্রিটিশ ভারত ভাগের সময় তিনি তার ভাইয়ের কাছে কলকাতায় থেকে যান। 

স্বশিক্ষিত মুবিনুল হায়দারের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। দরিদ্রতার কারণে এর বেশি আর পড়াশোনা এগোয়নি। ১৯৫০ সালে তিনি যোগ দেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়াতে (এসইউসিআই)। এটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। 

সন্দ্বীপের কমরেড মুজফ্‌ফর আহমেদের নেতৃত্বে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রা শুরু হয় ১৯২১ সালে। এ ধারার বাইরে গিয়ে ভারতের রাজনীতি অর্থনীতিকে ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা  করে ১৯৪৮ সালে এসইউসিআই প্রতিষ্ঠা করেন শিবদাস ঘোষ, নীহার মুখার্জীসহ আরও কয়েকজন। ২০০৯ সালে নয়া দিল্লীর রামলীলা ময়দানে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর দলটির নামের পাশে কমিউনিস্ট শব্দটি 'ব্রাকেট বন্দি' করা হয়, দলটি যে 'বিশুদ্ধ' ধারার বামপন্থি দল, এটি বোঝার জন্য। 

এসইউসিআই প্রতিষ্ঠিত শিবদাস ঘোষের  চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে। ১৯৩৫ সালে ঢাকাতে জন্ম নেন শিবদাস। মুবিনুল হায়দারের মত তিনিও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা খুব বেশি করেননি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা শিবদাস ১৩ বছর বয়সে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নেন। প্রথমদিকে তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। 

উল্লেখ্য, ভারতীয় বাঙালি মানবেন্দ্রনাথ রায় একাধারে মেক্সিকো এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (তাসখন্দ কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠাতা। অবশ্য পরবর্তীতে তিনি আর কমিউনিস্ট থাকেননি। স্তালিনের সাথে মতাদর্শগত বিরোধের জের ধরে তিনি লিবারেলিজম এবং কমিউনিজম- এ দুটো ধারাকে সংশ্লেষ করে 'র‍্যাডিকাল হিউম্যানিজম' নামে এক ভিন্ন চিন্তাধারার জন্ম দেন। 

১৯৪২ সালে শিবদাস 'ভারত ছাড়' আন্দোলনে যোগ দেন এবং গ্রেপ্তার হন। জেলে তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক সাহিত্যের সাথে পরিচিত হন। তিন বছরের জেল জীবনে শিবদাস বিভিন্ন মার্কসবাদী সাহিত্যের ওপর ব্যাপক পড়াশোনা করেন।   

ব্রিটিশ ভারতে জেলের লাইব্ররিগুলোতে ব্রিটিশ শাসকরা মার্কস-লেনিন-স্তালিনের গ্রন্থের বড় সংগ্রহ গড়ে তুলেছিল। নিজেরা সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী উপনিবেশিক অর্থনীতির পক্ষে থাকলেও জেলখানাগুলোতে তাদের চিন্তাধারা বিরোধী মার্কসবাদী সাহিত্যের বড় সংগ্রহ কেন তারা গড়ে তুলেছিলেন এটি পরিষ্কার নয়। অনেক রাজবন্দি জেলখানাতে এসে এ মার্কসবাদী সাহিত্যের সাথে পরিচিত হয়ে পরবর্তীতে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যুক্ত হন।    

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্যের সাথে ব্যাপক পরিচয় ঘটলেও শিবদাস সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পরবর্তীতে মাও সে তুং এর গণচীন এর কোনওটা দ্বারাই প্রভাবিত হননি। তিনি এ দুই ধারার বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে ভারতে ভিন্ন আঙ্গিকে কমিউনিস্ট রাজনীতি গড়ে তোলেন। 

সোভিয়েত প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ভারত এবং বাংলাদেশের 'মস্কোপন্থি' দলগুলো 'জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের' তত্ত্ব হাজির করে। এর বিপরীতে সব ঘরানার 'পিকিংপন্থি' দল 'জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের' কথা বলে। শিবদাস মস্কো, পিকিং ধারার বাইরে গিয়ে ঘোষণা করেন (যেটিকে তারা থিসিস বলেন) ভারত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। সুতরাং শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে ভারতের বিপ্লবের স্তর হচ্ছে  সমাজতান্ত্রিক। 

১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আওয়ামী লীগ এবং তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ থেকে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে কিছু নেতাকর্মী বের হয়ে গিয়ে মেজর (অব.) আবদুল জলিলকে সভাপতি এবং আ স ম আবদুর রবকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করেন।

সময়টা তখন বিশ্ব রাজনীতিতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ারের যুগ। তাই যারা পাকিস্তান আমলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির রাজনীতি করেছেন, সে-ই তারাই রাতারাতি ভোল পাল্টে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য জাসদের ব্যানারে কমিউনিস্টদের মত কার্ল মার্কসের 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' স্লোগান দেওয়া শুরু করেন। 

উল্লেখ্য, মার্কস তার পূর্বে যারা সমাজতন্ত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন, তাদের চিন্তাধারাকে নাকচ করার জন্য, তাদের ভাবনাকে 'ইউটোপিয়' বা 'কাল্পনিক সমাজতন্ত্র' বলে আখ্যায়িত করে নিজের চিন্তাধারাকে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' বলে অভিহিত করেছেন।     

মার্কসবাদী চিরায়ত সাহিত্য সম্পর্কে অজ্ঞ কিন্তু বিপ্লবী রোমান্টিকতায় আক্রান্ত জাসদের তরুণ নেতৃত্ব বাংলাদেশের মস্কো এবং পিকিংপন্থি ধারার বাইরে একটা স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে চাইলেন। ইতিহাস, রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের ধারণা যে খুব বেশি ছিলনা, সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে তাদের দলের নামকরণ থেকে। জার্মানির নাৎসি পার্টি অর্থাৎ, 'ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির' নাম অনুকরণ করে তারা দলের নাম 'জাসদ' রাখেন। তারা যে বিষয়টা সচেতনভাবে করেছেন এমন নয়। মুবিনুল হায়দারসহ অন্যরা ধরিয়ে দেওয়ার পরেও তারা নাম পরিবর্তন করার কোন উদ্যোগ নেননি।  

মার্কসবাদী বা অন্য ধারায় মৌলিক চিন্তা করবার মত ধীশক্তি বাংলাদেশের অন্যান্য বামপন্থিদের মত জাসদ নেতৃত্বের মাঝে আরো প্রবলভাবে অনুপস্থিত ছিল। তাই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রমাণ করার প্রয়াস হিসেবে তারা শিবদাসের চিন্তাধারা হুবহু অনুকরণ করে বাংলাদেশেও বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক বলে ঘোষণা করেন। 

জাসদের সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদ আখলাকুর রহমান শিবদাসের ভারত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র—এ তত্ত্ব অনুসরণ করে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি সামন্ত কাঠামো থেকে বের হয়ে ধনতন্ত্রে উত্তরণ ঘটেছে বলে উল্লেখ করেন। 

শিবদাস চাচ্ছিলেন, তার চিন্তাধারার আলোকে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে। জাসদের রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে তার চিন্তার প্রতিফলন দেখে তিনি মুবিনুল হায়দারকে বাংলাদেশে পাঠান জাসদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য। বাংলাদেশে এসে তিনি নানা স্তরের জাসদ নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেন। সিরাজুল আলম খানের সাথে শিবদাস ঘোষের কয়েকবার বৈঠকের ব্যবস্থাও করে দেন তিনি। 

জাসদের কার্যক্রম মুবিনুল হায়দারকে হতাশ করে। তিনি বুঝতে পারেন যে, জাসদ নেতৃত্ব এসইউসিআই এর কিছু শ্লোগান এবং প্রত্যয় শুধু অনুকরণ করছে রাজনীতিতে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান প্রমাণ করার কৌশল হিসেবে। 

এসইউসিআই এর মত করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের চর্চা করা,কর্মীদেরকে চিরায়ত মার্কসবাদী সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং সেভাবে জীবন যাপন করা- এ ধরনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, যোগ্যতা- এর সবকিছুই জাসদ নেতৃত্বের মাঝে অনুপস্থিত। মার্কস-লেনিনকে না জেনে তাদের নাম ব্যবহার করে দল গঠন করা যে একটা রাজনৈতিক ভাওতাবাজি, এটা মুবিনুল হায়দারের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

সদ্য স্বাধীন দেশ মধ্য এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের মাঝে উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। শ্রেণিচরিত্রের জন্য দ্রুত অনেক কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা তাদের পেয়ে বসে। ক্ষমতাসীন দলের তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারাকে পুঁজি করে জাসদ খুব দ্রুত এ শ্রেণির মাঝে নিজেদের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলে। এদেরকে কাজে লাগিয়ে সশস্ত্র পন্থায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের কৌশল নিয়ে জাসদ এগোতে থাকে। এ লক্ষ্যে দলের সশস্ত্র শাখা হিসেবে গড়ে তোলা হয় 'বিপ্লবী গণবাহিনী'।

একই সাথে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকার পতনের লক্ষ্যে কর্নেল (অব.) তাহেরের নেতৃত্বে সেনা সদস্যদের মধ্যে গোপনে 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার' বিস্তার ঘটান হয়। উল্লেখ্য যে, তাহের 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার' সাথে শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন না। সৈনিকদের মাঝে সংগঠন গড়ে তোলার কাজ প্রথম শুরু করেন মেজর জলিল। 

১৯৭১ সালে গণহত্যায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধর্ম-নির্ভর ডান এবং দক্ষিণপন্থি দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সময় এ দলগুলোর একটিই লক্ষ্য হয়ে ওঠে- যেকোনও মূল্যে, যে কারো দ্বারা বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন ঘটান। 

সশস্ত্র পন্থায় সরকার পতন ঘটানোর প্রক্রিয়ায় সেসময় জাসদ ছাড়াও সক্রিয় ছিল সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি এবং কমরেড আবদুল হক, তোয়াহা প্রমুখ 'পিকিংপন্থি' কমিউনিস্টরা। এদের মধ্যে জাসদের ভূমিকা সবচেয়ে সক্রিয় এবং অগ্রসর থাকায় ধর্মভিত্তিক দলগুলো জাসদের প্ল্যাটফর্মকে আরও শক্তিশালী করার কৌশল নেয়। ফলে, তৎকালীন সরকারবিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসের ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে জাসদ।  

বঙ্গবন্ধু সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য সেসময় যা যা করা দরকার জাসদ তার সবই করে। একদিকে তারা গণবাহিনী দ্বারা থানা আক্রমণ, ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে ব্যাংক লুট, পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, খুন ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে। অপরদিকে, 'গণকণ্ঠ'সহ অন্য প্রচার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। 

এসবের প্রতিক্রিয়ায় পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনীর পাল্টা ভূমিকায় তৃণমূল পর্যায়ে জাসদের অনেক তরুণ কর্মী প্রাণ হারান। বস্তুত এসবের মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতের ক্ষেত্র তৈরিতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে জাসদ। 

জাসদ নেতৃত্ব যখন মনে করছিল সরকার উৎখাতের প্রক্রিয়াকে তারা মোটামুটি গুছিয়ে এনেছে, ঠিক তখনই সেনাবাহিনীর কিছু দক্ষিণপন্থি জুনিয়র অফিসার ১৫ অগাস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার জন্ম দেয়। এতে পুরো জাতির সাথে জাসদ নেতৃত্বও স্তম্ভিত হয়ে যান। তাদের দাঁড় করানো ক্ষেত্র ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দক্ষিণপন্থি জুনিয়র অফিসাররা নিয়ে নেবেন, এটা তারা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তারা আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর সুযোগ খুঁজছিলেন, যার মাধ্যমে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল নিতে পারবেন। 

এ সময়টিতেই কর্নেল তাহের 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার' মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবার পরিকল্পনা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ রাজনীতির বিরোধী তাহের পাকিস্তান আমল থেকেই দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে- এরকম ভাবছিলেন। তিনিও অন্য অনেকের মত সেসময়কার প্রভাবশালী চিন্তাধারা, সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, দর্শন এসব নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা, জানাবোঝার চেয়ে বাংলাদেশের আর দশজন বামপন্থির মতই বামপন্থার 'রোমান্টিকতার' প্রতিই তিনি আকৃষ্ট হন। 

দেশ, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের অন্য বামপন্থিদের মত তাহেরও মৌলিক চিন্তা করতে পারেননি। তিনি নিজেকে মার্কসবাদী মনে করলেও মার্কস—লেনিন সম্পর্কে জানা-বোঝার ঘাটতি তার মাঝে ছিল প্রবল। 

কমিউনিস্ট আন্দোলন যে কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নয়—এটা যে আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন—এ বিষয় সম্পর্কে তাহের হয় আগ্রহী ছিলেন না। ফলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে তাহের বা জাসদের কোন যোগাযোগ ছিল না। তাহেরকে বড় জোর বলা যায় আওয়ামী লীগ বিরোধী হঠকারী জাতীয়তাবাদী। 

জানাবোঝার অভাব থেকে জনগণকে সংগঠিত করে লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন গড়ে তোলার পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সামরিক ক্যু সংগঠিত করাকেই তাহের বিপ্লব মনে করলেন। এ লক্ষ্যে তিনি যখন প্রায় গুছিয়ে আনছিলেন ঠিক তখনই ঘটে যায় আরেক বিপত্তি। 

৩ নভেম্বর মধ্যপন্থি জাতীয়াতাবাদী ধারার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বসেন। এ বিষয়টিও তাহের এবং জাসদ নেতৃত্বকে একই সাথে বিস্মিত এবং বিচলিত করে। অভ্যুত্থান সংগঠিত করার পূর্বেই একের পর এক অভ্যুত্থানের ঘটনা তাদেরকে দিশেহারা করে তোলে। ফলে যেকোনও মূল্যে তারা বিশেষত তাহের ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। 

তাহেরের অভ্যুত্থান পরিকল্পনার সমর্থনে জাসদ খালেদ মোশাররফকে 'discredit' করার জন্য ভারতবিরোধী 'ট্রাম্প কার্ড' ব্যবহার করে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধেও তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিবিদদের ব্যবহৃত সেই একই ভারতবিরোধী কার্ড ব্যবহার করে। অর্থাৎ কোন মৌলিক ভিন্নতার নিজস্ব জায়গা থেকে নয়, 'ইসলামপন্থি'দের ধার করা বিষয় নিয়ে জাসদ তার ভারত বিরোধিতার রাজনীতি করে। 

এ রাজনীতির অংশ হিসেবে জাসদ খালেদ মোশাররফকে ভারতের চর/দালাল ইত্যাদি হিসেবে অভিহিত করে এবং একে ভারতের পরিকল্পনার ক্যু হিসেবে প্রচার চালায়। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এ প্রচারে ব্যাপক ঘি ঢেলে তাহেরের অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। 

৭ নভেম্বর অভ্যুথান সফল করেই তাহের বুঝতে পারেন যে অভ্যুথানের নিয়ন্ত্রণ আর তার হাতে নেই। নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ডানপন্থি সামরিক অফিসারদের হাতে। ফলে জিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না।    

জিয়া ক্ষমতা পাবার পর সামরিক আদালতে গোপন বিচারে দ্রুত তাহেরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলান। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জাসদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করতে সচেষ্ট হন। 

জাসদের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জিয়া সরকারের নিষ্পেষণে দিশেহারা বোধ করেন। ঘটে যাওয়া ঘটনাবালী এবং সে প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া, এসব বিষয়ে জাসদ নেতারা তাদের কর্মীদের সামনে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হাজির করতে ব্যর্থ হন। 

অনেকটা শুরু থেকেই জাসদকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে মুবিনুল হায়দার যে বিষয়টা বুঝতে পারেন সেটা হল জাসদের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আন্তরিকভাবেই বাংলাদেশের সেক্যুলার, সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর দেখতে চান। তিনি তাদের একটা বড় অংশকে এ বিষয়টা বোঝাতে সক্ষম হন যে, তাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য জাসদ একটি ভুল প্ল্যাটফর্ম। 

মুবিনুল হায়দার এদেরকে নিয়ে তিনি যে মিশনে বাংলাদেশে এসেছিলেন অর্থাৎ শিবদাসের চিন্তার আলোকে এসইউসিআই এর 'বন্ধুপ্রতীম' দল গঠন, তা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এরই ফলে ১৯৮০ সালে 'প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশন' হিসেবে জাসদ ভেঙ্গে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) গঠন করেন।   

জাসদের ভাঙন জিয়ার জন্য স্বস্তি বয়ে আনে। যে দলের সামরিক শাখার অভ্যুত্থানের ফলে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সে দলটির রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তিশালী অবস্থান জিয়ার জন্য মানসিক শঙ্কার কারণ ছিল। মুবিনুল হায়দারের বাসদ গঠন জিয়াকে সে শঙ্কা থেকে মুক্তি দেয়। 

বাসদ গঠনের শুরুতেই ধাক্কা খায়। ১৯৮৩ সালে একজন নারী কমরেডের সাথে দুই শীর্ষ নেতার 'ত্রিভুজ প্রেম' এর বিষয়কে কেন্দ্র করে দল ভেঙে যায়। আফম মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে পৃথক বাসদ (মাহবুব) গঠিত হয়। এটিও পরে ভেঙ্গে বাসদ (রেজা) নামে ব্রাকেট বন্দি হয়। 

একজন সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাহবুবুল হক তার দলকে নিয়ে খুব বেশিদূর এগোতে পারেননি। শিবদাসের পথে নয়, তিনি মূলত জাসদের রাজনীতি-ই 'বাসদ' নামে করেছেন। শেষ জীবনে তিনি স্মৃতিশক্তি হারান এবং কানাডাতে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর আজ বিলুপ্ত প্রায় বাসদ (মাহবুব) কয়েক জন ব্যক্তি ধরে রাখবার চেষ্টা করছেন। 

মাহবুবুল হক বের হয়ে যাবার পর খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, আব্দুল্লাহ সরকার প্রমুখকে নিয়ে মুবিনুল হায়দার শিবদাসের চিন্তা বাস্তবায়নের পথ ধরেন। তার দিক নির্দেশনায় বাসদ এমন কিছু চর্চা করে, যেটি এর পূর্বে বা পরে বাংলাদেশে আর কোন রাজনৈতিক দল করেনি। 

মার্কসবাদ রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে আপাদমস্তক একটি বস্তুবাদী দর্শন হলেও শিবদাসের চিন্তার আলোকে মুবিনুল হায়দারসহ বাসদ নেতৃত্ব কমিউনিস্ট নীতি নৈতিকতা চর্চাকে ব্যাখ্যা করেন উপমহাদেশের ভাববাদী সন্ন্যাস দর্শনের আলোকে। তাদের মতে বিপ্লব করতে হলে আগে পার্টি সদস্যদের কমিউনিস্ট নৈতিকতা অর্জন করতে হবে। এটি অর্জনের অন্যতম পূর্বশর্ত হল পার্টি সদস্যদের প্রেম, বিয়ে, যৌন-জীবন সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা। শুধু তাই নয়, দলের সভ্যদের পার্টি অফিসে অন্যদের সাথে এক সাথে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে হবে—যেটিকে তারা 'কমিউন জীবন' বলে থাকে। এমনকি তাদের জন্য পড়াশোনা শেষে চাকরি বা ব্যবসা করাও কমিউনিস্ট নৈতিকতার পরিপন্থি বলে গণ্য করা হয়। ব্যক্তি জীবনে সমস্ত রকম প্রতিষ্ঠা, সুনাম, সম্মানের জন্য কাজ করাকে অনুৎসাহিত করা হয়। 

বাসদের এ ধরনের কঠোর রেজিমেন্টেড জীবন কিছু তরুণকে আকর্ষণ করে। শিক্ষার্থী থাকার সময় তারা এর মাঝে বিপ্লবী রোমান্টিকতা খুঁজে পায়। বাসদ তার ছাত্র সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টকে সারা দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

সোভিয়েত পতন পরবর্তী সময়ে সিপিবির ভাঙ্গন, ছাত্র ইউনিয়নের দুর্বলতা ফ্রন্টের বিকাশে সাহায্য করে। তবে ফ্রন্ট কোথাও মূল ধারার সংগঠন হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই এর অস্তিত্ব ছিল সাংগঠনিক শক্তির হিসেবে চতুর্থ, পঞ্চম বা আরো নিচে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে আর কোথাও উল্লেখ করার মত কোন সংগঠন বাসদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ফলে, এটি মূলত ছাত্র নির্ভর রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।  

ছাত্র রাজনীতি শেষ করে এ তরুণরা যখন মূল সংগঠনে আসে, তখন দলের চাকরি, ব্যবসা, বিয়ে না করার শর্ত তাদেরকে হতাশ করে। ফলে ব্যাপক সংখ্যায় তরুণ বাসদ রাজনীতি থেকে নানা সময়ে সরে পড়েন। এছাড়া এ তরুণদের মাঝে তাদের কোন কোন নেতার কথা ও কাজের বৈপরীত্যও স্পষ্ট হয়ে উঠে। 

দলীয় মুখপাত্র 'ভ্যানগার্ডে' কারো লেখা লেখকের নামবিহীন অবস্থায় ছাপাবার নিয়ম ছিল। সবাই তাই পালন করতেন। কিন্তু দলের আহ্বায়ক খালেকুজ্জমান সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজের নামে লেখা প্রকাশ করতে থাকেন। দল প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে তিনি দলের আহ্বায়ক পদও ধরে রাখেন। 

এ পদ ধরে রাখার স্বার্থে বাসদের কোন সম্মেলন আহ্বান করা হয়নি। এর পেছনে অদ্ভুত যুক্তি দেখিয়ে বলা হয় যে, বাসদ এখনো দল হয়ে উঠেনি। বিশ্বে আর কোনও বাম বা সমাজতান্ত্রিক দল দেখা যায় না যারা প্রতিষ্ঠা হবার পর সম্মেলন বা কংগ্রেস করেনি । এমনকি শীতল যুদ্ধের সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত বাম দলগুলোও গোপনে কংগ্রেস আহ্বান করত। পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেই এর নজির রয়েছে।

সম্মেলন না করা বাসদ- মুবিনুল হায়দার, খালেকুজ্জমান, আব্দুল্লাহ সরকার, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী- এ চার ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত দলে পরিণত হয়। এর মাঝে আব্দুল্লাহ সরকার ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন 'চির কুমার'। দলের নিয়ম অনুসারে তারা সবাই দলীয় অফিসে একই কক্ষে 'কমিউন জীবন' অনুসরণ করে থাকতেন। কিন্তু এ তিন জনের মাঝ থেকে একজনের এক নারী কমরেডের সাথে প্রণয় সম্পর্ক মুবিনুল হায়দারসহ বাকিদের ব্যথিত করে। এটাকে তারা দলীয় নৈতিকতার লঙ্ঘন হিসেবে দেখেন। 

এর সাথে উক্ত নেতার দলীয় ফান্ড, শেয়ার বাজার ইত্যাদি নিয়ে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ দলে অস্থিরতার জন্ম দেয়। এমতাবস্থায় আব্দুল্লাহ সরকার দলীয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে মুবিনুল হায়দার মার্কস, লেনিন, মাওয়ের সাথে শিবদাসকে সমমানের চিন্তক হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবি তুললে খালেকুজ্জমান এর বিরোধিতা করেন। ফলে শুভ্রাংশু চক্রবর্তীকে সাথে নিয়ে বাসদ থেকে বের হয়ে গিয়ে মুবিনুল হায়দার বাসদ (মার্কসবাদী) নামে আরেকটি দল গঠন করেন। 

তারা দুজনেও শেষ পর্যন্ত এক সাথে থাকতে পারেননি। নেতৃত্বের উত্তরাধিকারের বিরোধকে কেন্দ্র করে শুভ্রাংশু চক্রবর্তী আবার দল থেকে বের হয়ে গিয়ে গঠন করেন 'বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন'।     

ভাববাদীদের মত শিবদাস ছিলেন মুবিনুল হায়দারের কাছে গুরুর মত। 'গুরু' যা বলেছেন  মুবিনুল তার সবই সঠিক মনে করেছেন। শিবদাসের চিন্তাধারার সমস্যগুলো চিহ্নিত করার মত মেধা, প্রজ্ঞা, ইচ্ছা কোনটাই তার ছিল না। বরং একজন নীতিনিষ্ঠ শিষ্যের মত সারা জীবন তার দেখানো পথে চলতে চেষ্টা করেছেন। এ অর্থে বাংলাদেশের আরো অনেক বামপন্থি দাবীদারদের মত তিনি আসলে গুরুবাদ বা ভক্তিবাদেরই চর্চা করেছেন, বস্তুবাদী হয়ে উঠতে পারেননি।

ব্যক্তি মুবিনুল হায়দারের সততা, নিষ্ঠা এবং তার বিশ্বাসের প্রতি আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হল রাজনীতিতে সফল হবার জন্য এসব গুণাবলীই শেষ কথা নয়। রাজনীতিবিদ হিসেবে তো বটেই, এমনকি বাম রাজনীতিবিদ হিসেবেও মুবিনুল হায়দার সফল হতে পারেননি। 

ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হলো ইতিহাস ব্যর্থ মানুষদের মনে রাখে না। ইতিহাস মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকেও মনে রাখবে না।