শান্তির কাজে সমুদ্রের ঘরে…

মাইদুল মিঠুন
Published : 2 Nov 2016, 02:46 PM
Updated : 2 Nov 2016, 02:46 PM

বার্ট্রাণ্ড রাসেল তার 'ইন প্রেইস অফ আইডলনেস' গ্রন্থে জ্ঞান সমৃদ্ধ হবার তিনটি উপায়ের কথা বলেছেন। এক, নিজ সমাজ তথা দেশের সকল মানুষের সাথে উঠাবসা, চলাফেরা করা। দুই, প্রচুর বই পড়া এবং তিন, নিজ দেশের বাইরে গিয়ে নতুন সংস্কৃতির মানুষদের সাথে মেলামেশা করা।

এই তিনটির প্রথম ও তৃতীয় উপায়ের মূলকথা হলো পৃথিবী বৈচিত্র্যময়, এর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জ্ঞানের মহাসমুদ্র। ভ্রমণ করো, সকল সংস্কৃতির মানুষের সাথে মিশে যাও এবং প্রকৃতির অপার ভাণ্ডার থেকে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করো নিজেকে।

আমি ঠিক ওই পর্যায়ের জ্ঞানপিপাসু ভ্রমণকারী না হলেও প্রকৃতির বৈচিত্র্য দেখার আহ্বান কিংবা নতুন কোন জায়গায় ভ্রমণের কথা উঠলে সচেতনভাবে কখনো না করেছি বলে মনে পড়েনা। তখন খুব কষ্ট পাই যখন পরিচিত কেউ বেড়াতে গিয়েছে অথচ আমাকে জানায়নি।

বেশ কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর স্পিকারস' ফোরামের কো অর্ডিনেটর মওদুদ সুজন ভাই ইউনিভার্সাল পিস ফেডারেশনের ইয়ুথ সার্ভিস সংক্রান্ত লিডারশীপ প্রোগ্রামে অংশ নিতে নেপাল গিয়েছিলেন। ক্যাম্পাসে ফিরে স্পিকারস' ফোরামের বিশেষ অধিবেশনে নেপালের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে সাথে বর্তমান নেপালের আর্থ সামাজিক অবস্থান , শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি, সমাজনীতি সহ অন্যান্য বিষয় গুলো সম্পর্কে চমকপ্রদ ও তথ্যবহুল আলোচনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনার পর তাঁকে আমার ভ্রমণ বিষয়ে আগ্রহের কথা প্রকাশ করি।

কিছুদিন পর সুজন ভাই আমাকে জানান ইউনিভার্সাল পীস ফেডারেশন এবার বাংলাদেশে ওই ইয়ুথ লিডারশীপ সংক্রান্ত প্রোগ্রাম করতে যাচ্ছে কক্সবাজারে। জাহাঙ্গীরনগর স্পীকারস' ফোরামের দুই জন প্রতিনিধি ওই প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারবে। আমি আগ্রহী কিনা?

শুনেই লাফিয়ে উঠি, একে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ, সাথে সাথে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর ২২ অক্টোবর ২০১৬ সকাল আটটায় নেপাল ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সাথে পরিচিতি পর্ব অনুষ্ঠিত হলো কারওয়ান বাজারের হোটেল সুন্দরবনে। সেদিন সন্ধ্যা ৭ টায় আরামবাগ বাস টার্মিনাল থেকে স্পীকারস' ফোরামের অপর সদস্য শফিক মিতুল ভাই সহ নেপাল ও বাংলাদেশের ৩৯ জন প্রতিনিধির সঙ্গে রওয়ানা দিলাম বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে।

হাসি-ঠাট্রা,গান-আড্ডা আর কৌতুক-তামাশার ডুবে যেতে যেতে প্রায় মধ্যরাতে ইউনিভার্সাল পিস ফেডারেশনের দক্ষিণ এশিয়ার প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর টিকা রাজ বিশ্বকর্মার জন্মদিন পালন করা হলো কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে।

এরপর আরেক দফা হাসি তামাশায় ডুবে যেতে যেতে কখন যে ঘুমের দেশে ডুবে গেলাম।

ঘুম যখন ভাঙলো তখন আমরা কক্সবাজারের কলাতলী তে। বাস এখান থেকে আর যাবে না, কিন্তু আমাদের যাত্রার উদ্দেশ্য হলো কলাতলী থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে ইনানী সমুদ্র সৈকত। বাস থেকে নেমে উঠলাম বিখ্যাত চান্দের গাড়িতে । হু হু করে সকালের হাওয়া বইছে, একপাশে পাহাড় অপরপাশে সকালের শান্ত সমুদ্রের ঢেউ এর মৃদু গর্জন আর মাঝখানে গাছপালার আলোড়ন ভেদ করে ছুটে চলা আমাদের চান্দের গাড়ি, সে এক বর্ণনাতীত অনুভূতি।

প্রায় ঘন্টাখানেক এভাবে চলার পর আমরা পৌছলাম ইনানী রয়্যাল রিসোর্টে, এখানেই আমাদের রাত্রিযাপনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। হোটেলের প্রারম্ভিক আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর নির্দিষ্ট হোটেল রুমে পৌছে গোসল শেষে ঘুম, ঘুমাতে চাইছিলো না মন কিন্তু শরীর কি আর বাধা মানে? এক ঘন্টার চমৎকার একটি ঘুম শেষে সকালের নাস্তার পর শুরু হলো, তাইওয়ানের সুইলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক রত্না পিয়ার উপস্থাপনায় ইউনিভার্সাল পীস ফেডারেশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং আমাদের রিলিজিয়াস ইয়ুথ সার্ভিসের কার্যক্রম সংক্রান্ত ব্রিফিং।

উপস্থাপনা শেষে মি রত্না পিয়া আমাদেরকে ৫ টি গ্রুপ লায়ন, টাইগার, পীকক, কমপ্যাশন এবং আইস ব্রেকার এ ভাগ করে দিলেন। প্রত্যেকটি দলেই থাকলো একজন করে দলনেতা।

এরপর একটি চমৎকার খেলা হলো, দলের সদস্যরা মিলে নিজ দলের নামের পাঁচটি ইতিবাচক ও পাঁচটি নেতিবাচক দিক তুলে ধরার জন্য দলনেতাকে আহ্বান জানানো হলো। উপভোগ্য এই খেলাটির অভ্যন্তরে খুব সূক্ষভাবে গ্রুপ ওয়ার্কের দিক নির্দেশনা এবং দলনেতার প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি ফুটে ওঠে সুচারুভাবে। অতঃপর দুপুরের খাবার এবং বিশ্রামের পালা। কিসের বিশ্রাম কিসের কি?

মন তো পড়ে আছে সমুদ্র সৈকতে। একটু বিশ্রাম নিয়েই আমি আর শফিক ভাই বেড়িয়ে এলাম হোটেলের বাইরে, সামনেই ইনানী সী বীচ। সমুদ্রের লোনা জলের প্রথম স্পর্শ পেল আমার পা, রোমাঞ্চকর অনুভূতি। অতঃপর সন্ধ্যা পর্যন্ত সৈকতে দাঁড়িয়ে গোধূলি দেখলাম, চোখ জুড়ালো অনতিদূরে অশান্ত ঢেউ এর অন্তরালে সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখে।

এরপর হোটেল এবং সবাই একসাথে বসে সারাদিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনুভূতি শেয়ারিং পর্ব। সেও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা, সবাই নিজের মতো করে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করলো। একই জায়গায় প্রকাশ পেল বিচিত্র মানুষের বিচিত্র সব অনুভূতি অথচ সবাই ওই এক সমুদ্র সৈকতেই ঘুরে এলাম মাত্র। খাবার পর উন্মুক্ত আকাশের জ্যোৎস্না এবং তারকা দেখার ফাঁকে ফাঁকে চললো গল্প আড্ডা আর গান। মধ্যরাতের পর রুমমেটের নাক ডাকার আওয়াজ জানান দিলো আমারও ঘুমানোর সময় হয়ে এসেছে।

পরদিন ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে ফুটবল হাতে সৈকতে ছুটলাম সূর্যোদয় দেখার আশায়, নিরাশ করলো না সমুদ্র বরং চোখ জুড়ানো মনোরম দৃশ্য ছিল প্রত্যাশার চেয়ে বড় প্রাপ্তি।

আমরা ফুটবলও খেললাম, নেপাল বনাম বাংলাদেশের। আমরা জিতলাম ২-১ গোলে। তারপর আকন্ঠ নোনাজলে ডুবিয়ে নিলাম প্রেমের পরশ, চললো জলকেলি আর ঢেউ এর সাথে পাল্লা দিয়ে নেচে বেড়ানোর আবদার মেটানোর পালাও।

সকাল ১০ টায় বেড়িয়ে পড়লাম সোনারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় পানে, যথাসময়ে সেখানে পৌঁছে দেখি প্রধান শিক্ষক মহোদয় অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য। আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা শেষ করার পর , পূর্বে উল্লিখিত সেই গ্রুপে ভাগ হয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও নবম শ্রেণীর ক্লাসে উপস্থিত হলাম আমরা। অনুষ্ঠিত হলো ২০ মিনিট করে ৪০ মিনিটের দুইটি সেশন।

প্রথম সেশনটিতে তাৎক্ষণিক বিতর্ক শিখিয়ে তাদেরকে বিষয় নির্ধারন করে দিয়ে বলা হলো বিতর্ক করতে। চমৎকার উপস্থাপনা এবং তথ্যবহুল আলোচনা শুনে মনে হলো অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত ওই শিক্ষার্থীদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগের ব্যাবস্থা করতে পারলে তারা অকালে ঝড়ে পড়তো না নিশ্চয়ই।

পরের সেশনে ছিলো বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং সেই সমস্যার উপযুক্ত সমাধান সংক্রান্ত। উঠে এলো বাল্যবিবাহ, সুশিক্ষার অভাব, চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা, বিদ্যুৎ ঘাটতি , পরিবেশ বিপর্যয়, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মতো জাতীয় সমস্যাগুলোর কথা । তাৎক্ষণিক সমাধান ও দিল তারা। কেউ পিছিয়ে নেই, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তৃনমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে পাল্টে যেতে পারে পুরো বাংলাদেশের রূপরেখা।দরকার শুধু প্লাটফর্ম আর দক্ষ নজরদারির। পুরস্কার বিতরণী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যামে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও, শিক্ষার্থীদের 'ভাইয়া, আপনারা আবার কবে আসবেন?' ধ্বনিটি এখনো কানে বাজছে।

এবার হোটেলে দুপুরের খাবার শেষ করে ছুটলাম হিমছড়ি ঝর্না আর পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। হায় হিমছড়ি,ইট পাথর দিয়ে একটা ছোট্র পানিপ্রবাহকে আটকে রাখা হয়েছে কোনরকম। কিন্তু সেই অভাব পূরণ করলো হিমছড়ি পাহাড়ে উঠে অন্যান্য উচ্চতায় সমুদ্রে সূর্যাস্ত অবলোকন। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই রওয়ানা দিলাম বৌদ্ধ মন্দিরের উদ্দেশ্যে ।দেখলাম অপর একটি ধর্মের ধর্মীয় সংস্কৃতি, মনে হয়েছিলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সেই মহাজ্ঞানী স্বয়ং গৌতম বুদ্ধকে।শুনতে পাচ্ছিলাম সেই ধ্বনি, 'জগতের সকল প্রাণি সুখী হোক'।

অতঃপর হোটেলে ফিরে অনুভূতি শেয়ারিং এবং রাতের খাবারের পর ব্যাটমিন্টন খেলা। ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত চললো ব্যাটমিন্টন। অতঃপর ঘুম।

সকালের সৈকতের মায়া কাটতেই চায় না। ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে যায় আপনা থেকেই, উঠেই ভো দৌড়, আবার ফুটবল এবং গোছল। সকালের নাস্তার পর পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত এবং সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় ভালোবাসা নিয়ে প্রায় এক ঘন্টার আলোচনা করলেন মি রত্না পিয়া। এরপর আমরা গ্রুপ অনুযায়ী তিন দিনের কার্যপ্রনালী তে ঠিক কি শিখলাম তার আলোচনা এবং সমালোচনা।

দুপুরের খাবারের পর সনদপ প্রদান অনুষ্ঠান। মনের অজান্তেই বেজে উঠতে লাগলো বিদায়ের ঘন্টা। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চললো হৃদকম্পন। আহারে , যদি এখানেই থেকে যাওয়া যেত।

কিন্তু, প্রকৃতি নিয়মের আবর্তে ঘোরে কিনা তাই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাগ গুছিয়ে উঠতে হলো চান্দের গাড়ীতে । সবাই চুপচাপ কারো মুখে রা সরে না।

কক্সবাজার বাস টার্মিনাল পর্যন্ত নিরানন্দেই কাটলো সময় টা। অতঃপর বাসে উঠেও চুপ। নীরবতা ভাংলো ইমরান ভাই এর মজার জোক আর টিকা রাজ বিশ্বকর্মার ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা কথা বলার ভঙিতে হেসে উঠলো পুরো বাস। আর নিরানন্দ নয় বাকিটা পথ সবার অংশগ্রহণে হয়ে উঠলো চমৎকার।

সকাল সাতটা, আরামবাগ বাস টার্মিনালে নামলো চূড়ান্ত বিচ্ছেদের ঘটনা। সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে যে যার মতো ছুটলো কর্মব্যস্ততায়। ব্যস্ত ঢাকার রাজপথের মতো ব্যাস্ততায় হারিয়ে গেলাম আমিও।