রেজা কিবরিয়া, ড. কামাল হোসেন থেকে বি চৌধুরী: আদর্শহীনতাই শেষ কথা?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 11 Dec 2011, 08:49 AM
Updated : 22 Nov 2018, 01:06 PM
কতো মানুষ যে কতোভাবে শিরোনামে পরিণত হন। কেউ পজেটিভ, কেউ নেগেটিভ নানাভাবে লাইম লাইটে আসেন আমাদের সমাজে। রাজনীতি এমন বিচিত্র এক পেশা এমন এক রহস্যময় জগত যেখানে ভালো মন্দের পার্থক্য মুছে যেতে বেশি সময় লাগে না। এবার নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে তত ই দৃশ্যপট হয়ে উঠছে কৌতুহলময়। সবদেশে সবসমাজেই নির্বাচনের আগে ভালো মন্দ মিলিয়ে এক জমজমাট পরিবেশ তৈরি হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য এর পাশাপাশি এমন সব ঘটনাও দেখতে হয় যার ভেতর আছে পচে গলে একাকার হবার ঈঙ্গিত। আদর্শহীনতার রাজনীতি আজ এতটাই ভয়ংকর পিতার হত্যাকারী বলে চিহ্নিতদের সাথেও আঁতাত করতে কসুর করছেন না কেউ কেউ।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে চমক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পিলে চমকানো চমক না ভালো, না সুখকর। জোট বা ফ্রন্ট গঠিত হবে এটাও মানা যায়। কিন্তু পিতার রক্তের সাথে বেঈমানি করে কেউ এমপি হতে চান- এটাও  মানতে হবে? আমরা তো এখন মোগলযুগে বসবাস করিনা, যে রাজা-বাদশাদের সন্তানের মতো বাপকে কারাগারে রেখে ভাইকে হত্যা করে দেশান্তরী করে পদের জন্য লড়াই করতে হবে। তারপরও সেলুকাসের বিচিত্র দেশ ও সমাজে এমন ঘটনা আজো ঘটে।
বলছি রেজা কিবরিয়ার কথা। হবিগঞ্জের এমপি মূলত দল না করা অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে তুলে এনে অর্থমন্ত্রী করেছিলেন শেখ হাসিনা। ভদ্রলোক সজ্জন শাহ এ এম এস কিবরিয়া তার ভূমিকা রেখেছিলেন সঠিকভাবে। তার মতো মানুষকে নিয়মে হটানো অসম্ভব জেনে যারা তাকে পৈশাচিক কায়দায় দিনদুপুরে খুন করেছিল তাদের সাথে যেতে হবে পুত্রকে? কিবরিয়া সাহেব অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও সংস্কৃতিবোধ ছিল তার ভেতরে। ভদ্রলোক মানুষ, পরিমিত কথা বলার মানুষ। সে কারণে নিজের প্রিন্ট মিডিয়ার নামও রেখেছিলেন মৃদু ভাষণ। বিভুরঞ্জন সরকারের সুসম্পাদনায় সেই কাগজে লেখাটা আমাদের মতো অনেকের কাছে ছিলো বড় পাওয়া। তার হত্যাকাণ্ডের পর পুত্র এসেছিলেন সিডনি। এদেশে পড়াশোনা করা ছেলে আমরা যারা অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী তাদের বলে গিয়েছিলেন এর প্রকাশনা অব্যাহত থাকবে। থাকেনি।
ধরে নেয়া হচ্ছে পিতার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের বিচার বিলম্বিত হওয়ায় নাকি তার এই অদলবদল। বটে, এদেশে কোন হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত করে গেছে? এমনকি জাতির জনক ও চারজাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচারও কি ঠিক সময়ে করা গেছিল? তাহলে কি ধরে নিতে হবে শেখ হাসিনা তা চান নি? 'সবদোষ নন্দঘোষে'র মতো তার ওপর চাপানোর দায় আমাদের স্বভাব। রেজা কিবরিয়া সবুর করবেন না ঠিক আছে। তিনি তো স্বতন্ত্রভাবেও ইলেকশন করতে পারেন। সেটা করলে তার প্রতি সকলের যে সহানুভূতি বা ভালোবাসা থাকতো সেটা তিনি মনে রাখেননি। কেন রাখেননি তার উত্তর আপনি দেশের বহুল প্রচলিত দৈনিক পত্রিকা পড়লেই পাবেন। এরা যাদের উসকিয়ে দলে টানে তাদের আখের ঝরঝরে জেনেও রেজা কিবরিয়া সে ফাঁদে পা দিলেন!
এতে তার ব্যক্তিগত লাভালাভ যাই হোক, মানুষ জানলো এমনকি এমপি পদের জন্য পিতার রক্তের ওপর হাঁটাও জায়েজ। সমাজে আদর্শ বা নীতি বা নৈতিকতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে এ তার নির্লজ্জ উদাহরণ। রেজা কিবরিয়া ধানের শীষে মনোনয়ন পেলে এবং জিতে আসলেও মূলত নিজের কাছে পরাজিত হবেন। রাগ ক্রোধ বা প্রলোভন থিতিয়ে এলে নিজে আর নিজের চেহারার দিকে তাকাতে পারবেন না। যেমনটা মুশতাকের ছেলেপেলেরা বলে- বাবার পরিচয়ে বাঁচতে চাইনা। রেজা কিবরিয়া কি তার সন্তান ও পরিবারের জন্য এমন নজির রেখে যেতে চান? তিনি যে ভীমরুলের চাকে ঢিল মেরেছেন তা এখন স্পষ্ট।
ইতোমধ্যে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার জীবনের অন্ধকার দিক এবং রেজা কিবরিয়ার জীবন বিষয়ে নানা অজানা তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। কতোটা সত্য-মিথ্যা জানিনা। সামাজিক মিডিয়ায় কিবরিয়া সাহেবের বিরুদ্ধে এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না। অন্যদিকে রেজাকে তার পরিবারে কালো ভেড়া বা 'ব্ল্যাকশিপ' বলার কারণও ঘুরছে মুখে মুখে। এসব হয়তো সত্য, হয়তো অর্ধসত্য। কিন্তু সব ছাপিয়ে তিনি যে কাজটি করলেন তা রাজনীতি তো বটেই সমাজের ভেতরকার পচনকে নির্লজ্জ ভাবে তুলে ধরেছে। এমপি হলেই তার সব খায়েশ পূর্ণ হবে এমন নাও হতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাবো না মাত্র ৮১ দিনের জন্য দেশের গদি আঁকড়ে থাকা মোশতাকের ভবিষ্যত। আজ আর কেউ তার নামও বলেনা। বরং ওই নামটিই এখন মীরজাফরের সমতূল্য। তিনি আপন পিতাকে না হলেও জাতির পিতাসহ তার চার প্রিয় সহকর্মীর খুনের সাথে জড়িত থাকার পাশাপাশি বেঈমানি করে এই দুর্নাম কিনেছিলেন। এর চেয়ে আর্দশে মৃত্যুবরণ শ্রেয়।
মনে রাখা প্রয়োজন এদেশে ফাঁসিতে যাওয়া সূর্যসেন থেকে বঙ্গবন্ধু, চার নেতা,  সালাম-রফিক-বরকতসহ হাজারো মুক্তিযোদ্ধা চির অমর। রাজনীতির ভোটে কখনো সুবিধা করতে না পারা ভাসানী, মনি সিংহ কিংবা হাজী দানেশকে মানুষ ভোলেনি। কারণ তারা আদর্শে থেকে আদর্শেই  মৃত্যু বরণ করেছিলেন।
আমাদের রাজনীতি কবে থেকে পিতৃহন্তারক বান্ধব হলো?
বেঈমানি শুধু একদিকে না। অপর প্রান্তেও আছে। আমাদের বাসা ছিলো চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ থেকে হাঁটার দূরত্বে। রাতভর গোলাগুলির শব্দে ঘুমোতে না পারা আমাদের বিনিদ্র রাত ভোর হয়েছিল বিবিসির মার্ক টালির দেওয়া খবরে। তখন এত মিডিয়া ছিলোনা। সরকার নিয়ন্ত্রিত সবেধন নীলমনি  মিডিয়া ছিলো অবিশ্বাসের যন্ত্র। ফলে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা কিংবা আকাশবাণী-ই ছিলো বিশ্বাসের মাধ্যম। বিকেলে পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসলে যৌবনের কৌতুহলে ঝুঁকি নিয়েই সার্কিট হাউজে গিয়েছিলাম । মাঠ ভরা মানুষ। উৎসুক দর্শকের ভিড় ও আতঙ্কে নিহত জিয়াউর রহমানের লাশ বা তেমন কিছু দেখতে না পেলেও আমরা জেনেছিলাম তাকে  সেনাবাহিনী র ভেতরের লোকরাই হত্যা করেছে। আর পাশের রুম থেকে বেঁচে ফেরা বি চৌধুরীর গায়ে ছিলো চকচকে ফিলিপিনো হাওয়াই শার্ট। পাশের রুমের বাসিন্দা চৌধুরী সাহেব এরপর রাজনীতিতে অনেক খেল দেখিয়েছে। মনে আছে ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনের আগে তিনি টিভিতে দম্ভ করে বলেছিলেন- আওয়ামী লীগ পঞ্চাশ বছরেও দেশ শাসনে আসতে পারবেনা। তার মতো সুধিজন নামে পরিচিত মানুষ  পবিত্র কোরান, গীতা এসব নিয়ে আজেবাজে কথা বলতেন। তিনিই বলেছিলেন নৌকা জিতলে মসজিদে উলুধ্বনি হবে। সে নির্বাচনে পরাজয়ের স্বাদ লাভ করে বিএনপি। তারপরও খেলা বাকি ছিল। আবার তাদের ধানের শীষ জিতলে বি চৌধুরী হন রাষ্ট্রপতি। অত:পর নিন্দুকদের মতে তারেক জিয়া আর মাহী বি চৌধুরীর দ্বন্দ্বে তার সাথে দলের দূরত্ব বাড়ে। শেষে  তারাই তাকে রেললাইন ধরে দৌড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল ।
সেই তিনি এবারের গোড়ার দিকে ঐক্যফ্রন্টে যাবেন এমনই ঠিক করেছিলেন। ড. কামাল-রব-মান্নাসহ অনেকের সাথে ছবি আর খবরগুলো এখনো বাসী হয়নি। কিন্তু যে কারণেই হোক একশ আশি ডিগ্রি পাল্টি খেয়ে মহাজোটের শরীক হতে চলেছে তার দল। এটাও এক ধরণের বিশ্বাসঘাতকতা বৈকিৱ! মুশকিল হলো চেনা এবং পাশে থাকা মিত্ররা দুর্দিনের ভরসা আর সুদিনে নতুন নতুন পায়রা এসে ধান খাবে এটাই কি আমাদের নিয়তি?
যে কারণে ড. কামাল হোসেন বা রেজা কিবরিয়া নৌকাবিরোধী কথা বললে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বললে আমরা শঙ্কিত হবো একই কারণে বি চৌধুরী নৌকার প্রশংসা বা বঙ্গবন্ধু বিষয়ে বড় বড় কথা বললে আমরা কি আনন্দিত হতে পারবো?
এই প্রশ্নগুলো এবারের নির্বাচনে বড় বড় ফ্যাক্টর। গোপনে প্রকাশ্যে আমাদের দেশের রাজনীতিতে বিভেদ রেখা মুছে যাচ্ছে। হেফাজত-কমিউনিস্ট, ডান-বাম সব মিলেমিশে একাকার। যেন যে কোনও উপায়ে জিতে এমপি হতে পারাটাই মূখ্য কাজ। শুধু ইয়াবা বদি বা মনোনয়নপ্রত্যাশী হিরো আলমকে দোষ দিলে হবেনা। বড় স্তরে ওপরেও আজ ময়লা আর আবর্জনার স্তুপ । বিশেষত আদর্শহীনতায় ইঁদুরের মতো লাফালাফি আমাদের রাজনীতি ও দেশের ভবিষ্যত কেউ দুর্বল করছে মাত্র। তারুণ্য এমনিতেই বিভ্রান্ত। অণুকরণীয় মানুষ তাদের সামনে নাই বললেই চলে। তারমধ্যে এসব মানুষ যদি এভাবে জায়গা বদলায় আর পদলোভী হয়ে পিতা মাতা অতীতের সাথে বেঈমানি করে তবে কষ্টের শেষ থাকবেনা।
মানুষ কি এসবের উত্তর দেবে এবারের নির্বাচনে?