‘গণতন্ত্র পাহারাদারিত্ব ছাড়া সুরক্ষিত নয়’

শফিক মিতুল
Published : 27 August 2015, 02:00 PM
Updated : 27 August 2015, 02:00 PM

গণতন্ত্র পাহারাদারিত্ব ছাড়া সুরক্ষিত নয়, সেটা নির্বাচন হলেও নয়, নির্বাচন না হলেও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রধান সমস্যা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গণতন্ত্র নাই। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যে পাহারাদারিত্ব প্রয়োজন সেই পাহারাদারিত্ব সৃষ্টি করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, সাহসিকতার দিক থেকে, সাংস্কৃতিকভাবে কিংবা সাংগঠনিকভাবে আমরা প্রস্তুত কিনা সেই প্রশ্ন স্বভাবতই চলে আসে।

–অধ্যাপক মানস চৌধুরী।

(গত ২৫ আগস্ট, মঙ্গলবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের উদ্যোগে আয়োজিত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন জাকসুর প্রাক্তন সাহিত্য সম্পাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী। অনুষ্ঠানে আরো আলোচনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৮-৯৯ সালের খুনি-ধর্ষক বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, জাবি ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি সৈকত শুভ্র আইচ মনন এবং ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি হাসান তারেক। আলোচকদের মধ্যে অধ্যাপক মানস চৌধুরীর বক্তৃতাটি লিখিত আকারে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-)

শুভ সন্ধ্যা, সকলকে শুভেচ্ছা। মুক্তমঞ্চে দাড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া হলো গাবতলীতে বসে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার মতো চেষ্টাকরা। আমি নিজে কখনো অপরিনামদর্শে দুষ্ট ছিলাম না। কোথায় কতটুকু বক্তৃতা দিতে হবে, আমি বক্তৃতা দিতে না পারলেও মাপটুকু খুব ভালো বুঝি। একটু আগে যে বিষয়ে আমি ভাবছিলাম সেটা হলো, যেসব শিক্ষকের তথা মাস্টারমশাইয়ের বয়স বেশি তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি করার চল আছে। আমাকে আজকে ডাকবার অন্তত চারটি কারণ আমি পেয়েছি। একটা হচ্ছে আমি বয়ষ্ক মাস্টার, দ্বিতীয়ত যেটা সিদ্ধান্ত (ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দীপাঞ্জন সিদ্ধান্ত কাজল) বললেন, আমাকে নাকি তাদের মিছিলে পাওয়া যায়। কথা হচ্ছে মিছিলটা শুধু আপনাদের না ওটা আমারই। তৃতীয়ত সম্ভবত এই যে আমাকে বেশ দয়া দাক্ষিণ্য করে সাবেক ছাত্র নেতা ক্যটাগরিতে চালানো যায়। একটু ছাড় দিতে হয়, কিন্তু চালানো যায়। আর চতুর্থত, আমি জাকসুতে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলাম। জাকসুতে আমি নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলাম যেটা সৈকত (সৈকত শুভ্র আইচ মনন) বলছিলেন সেটা সর্বশেষ জাকসু নয়, হুড়োহুড়ি করে আরেকটা জাকসু হয়েছিলো ৯২ সালে। কেউ কেউ মনে করেন সেটা ৯১'র জাকসুকে টার্মিনেট করার জন্যও। তো ৯১ তে যে জাকসু করি আমরা, আজকে অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ওটাই ছিলো ক্যাম্পাসে সর্বশেষ প্রায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণ। সে জাকসুতে আমি প্রতিনিধিত্ব করি, এগুলো সবই কিন্তু প্রেক্ষাপট। আপনারা নিশ্চয়ই জনবেন যে, ভালো ছাত্ররা এসব কদাকার কাজ করেন না, বা তারা করলে সরকারী ছাত্র সংগঠন করে। গুডবয় হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, যা কিছু প্রচলিত তাকে হ্যাঁ হ্যাঁ বলবেন। আমি খুব একটা ভালো ছাত্রের (কিন্তু বিভাগে প্রথম ছিলেন!)জীবন যাপন করতাম না। ফলত আমি নির্বাচনে দাঁড়াই। আমি আশা করি বুঝাতে পেরেছি যে ভালো ছাত্ররা কিছুতেই সকলে যা করতে চান তার বাইরে কিছু করেন না।

ভালো ছাত্রদের আদর্শ আচরণ হচ্ছে লেজ ধরে ঘুরে বেড়ানো, মিনি মিনি সালাম দেওয়া এবং যথাসম্ভব কোমরভাঙ্গা একটা আচরণ করা। আমাকে ক্ষমা করবেন এখানে যারা ভালো ছাত্র-ছাত্রী আছেন। আমাদের সময় অন্তত এমনই ছিলো, তাই আমি ভিন্ন কিছু বলছি না। আমি চিয়েছিলাম ভালো ছাত্র হওয়ার চেয়ে কোমর শক্ত মানুষ হব। ফলত যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন খুব অসন্তুষ্ট ছিলো আমার নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়াতে, কারণ তখন আমাদের যাবতীয় লড়াই সংগ্রাম চলে, অন্তত ক্যাম্পাসের অধিকার বিষয়ে আন্দোলন চলে তখনকার ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিরুদ্ধে। সেসময় ছাত্রলীগের একটা স্বতন্ত্র প্যানেল, ছাত্র ইউনিয়নের একটা স্বতন্ত্র প্যানেল এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টেরও একটা স্বতন্ত্র প্যানেলে লড়ে।

আমরা সতর্ক থাকলে বুঝতে পারি, একটা সংগঠনে একই ধরনের শিক্ষার্থী বিরাজ করেন না। কেউ কেউ আলাপ করতে পছন্দ করেন, কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক, কেউ যেকোন কথাতেই চড় মেরে উত্তর করেন, কেউ কেউ চায় বিভিন্ন সংকটে আলোচনায় বসতে- এরকম বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থীসমেত একটি ছাত্র সংগঠন তৈরি হয়। সেই সময় ছাত্রলীগের অনেকে চাইছিলেন যে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে একটা মৈত্রী হয়, ছাত্র ইউনিয়নেরও কেউ কেউ চাইছিলেন যেন ছাত্রলীগের সাথে মৈত্রী হয়। ফলত অনেক বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও একটা মৈত্রী শেষমেষ হয়। এই মৈত্রীর নিবাচনী দলটা প্রায় পুরো প্যানেলে পরাজিত হয়, একমাত্র আমি (সাহিত্য সম্পাদক পদে)ব্যতীত।

জাকসুর দাবি থেকে আমি আয়োজকদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, যখনই জাকসু নির্বাচন হবে, তখন কি আপনারা নিশ্চিত করে বলতে পারেন ঢাকসুতে কিংবা জাকসুতে যে ফলাফলটা হবে ওইটাই ওই সময়ের শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আচরণের বাহিঃপ্রকাশ? আমরা কি এখন ভোট দিলে তাকেই ভোট দেই না যাকে আমরা ভয় পাই? তো জাকসুকে সকল কিছুর দাওয়াই ভাবার কারণ নেই।

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটা প্রধান সমস্যা হলো রিসোর্স এর সমস্যা। সোজা বাংলায় এখানে টাকা বরাদ্দ খুবই কম। বিশ্বব্যাংকের কথায় প্রভাবিত হয়ে যখন সরকার বা যেকোন রাষ্ট্র প্রশাসন বলেন, আপনারা (বিশ্ববিদ্যালয়) স্বয়ংসম্পূর্ণ হোন, তখন এটা একটা শুভংকরের ফাঁকি ছাড়া অন্য কিছু নয়। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যে ঘোষণাপত্র নিয়ে তৈরি হয়েছে তাতে এটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বাজেট করা সম্ভব নয়। এটা নিয়ে আর লম্বা আলোচনা না করলেও চলবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি প্রধান সমস্যা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গণতন্ত্র নাই। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি থাকে ব্যুরোক্রেসির প্রশাসন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে বিশেষ বিশেষ শিক্ষার্থী সংগঠন বা তাদের ভেতর একাংশ যারা গণতন্ত্রপন্থী নন, তাদের দাপটের রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে হচ্ছে অর্থায়নের সংকট, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে হচ্ছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাব, আমরা তার মধ্যে দাঁড়িয়ে জাকসু নির্বাচনকে সকল কিছুর দাওয়াই ভাবলে সমস্যা যেটা হবে, ক্ষমতার প্রশ্নটা অমীমাংসিত থাকবে। যাদের সমস্যা হচ্ছে এই সমস্যাটাকে আমাদের ভাবতে, তারা পাশের দেশে দেখুন। বাংলাদেশের উদাহরণ খারাপ লাগলে চলুন পাশের দেশের উদাহরণ দেখি। এক বছর লাগেনি প্রায় সকল পাবলিক ক্যাম্পাসে বিজেপির ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে যা ইচ্ছা তাই করছে। এখন কিভাবে প্রশাসন সেখানে গণতন্ত্র নিশ্চিত করছে সেটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ।

গণতন্ত্র পাহারাদারিত্ব ছাড়া সুরক্ষিত নয়, সেটা নির্বাচন হলেও নয়, নির্বাচন না হলেও নয়। এখন আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি আমাদের ভেতরে কেউ গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যে পাহারাদারিত্ব প্রয়োজন সেই পাহারাদারিত্ব সৃষ্টি করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, সাহসিকতার দিক থেকে, সাংস্কৃতিকভাবে কিংবা আমরা সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত কিনা- তা আমাকে বলতে হবে না, আপনারা নিজেদেরকে প্রশ্ন করবেন।

গণতন্ত্র তাই যা আপনি আকাঙ্খা করেন। যখন আপনি একা থাকেন, তখন আপনি চান আরেকটু সার্বভৌম হয়ে চলতে, গণতন্ত্র এতটাই সহজ ! গণতন্ত্রের জন্যে মুক্তমঞ্চে বক্তৃতার প্রয়োজন পড়বে না, গণতন্ত্র আপনারা চেনেন।

গণতন্ত্র চেনেন যখন আপনাকেও কারো জন্যে অপেক্ষা করতে হয়, গণতন্ত্র চেনেন যখন এই ক্যাম্পাসের সবচাইতে ভীতি প্রদর্শনকারী মানুষটিকেও ঠিক ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়ে পেছনে পেছনে ঘুরতে হয়। হয়ত প্রশাসনিক কর্মকর্তার পেছনে পেছনে ঘুরতে হয়, না হয় ব্যুরোক্রেটিক কর্মকর্তার পেছনে ঘুরতে হয়, না হয় অন্তত পরবর্তী কাউন্সিলে অধিকতর বড় পদ পাওয়ার জন্য বড় নেতার পেছনে ঘুরতে হয়। আপনি তখন জানেন গণতন্ত্র কাকে বলে? আপনি যখন অন্যের স্বৈরতন্ত্রের মুখোমুখি হন, আপনি তখন জানেন গণতন্ত্র কাকে বলে? বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে আপনার গণতন্ত্রবোধ জাগ্রত কারা সম্ভব না।

 

আমি জাকসু নির্বাচনের বিপক্ষে না, কিন্তু জাকসু নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্রের রক্ষাকবজ কিনা, সংসদ নির্বাচন রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের সুরক্ষাকবজ কিনা সে প্রশ্নটা সামনে চলে আসে।

যদি আমি দাবি করি তামাম পৃথিবীতে সামরিকতন্ত্র চলছে, তবে একটুও কি অত্যুক্তি করা হবে? যে পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র উৎপন্ন হয়, সেই পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রই যাতে খরচ করা যায় তার জন্য মার্কিন পার্লামেন্টে সিনেটররা এবং কংগ্রেসরা বসেন। আমরা যে জিনিসটা পৃথিবীতে নাই তার আকাঙ্খা করি। আপনারা ভাবেন যে ছাত্রইউনিয়নের লোকজন সমাজতন্ত্র চায়, আর অন্যরা গণতন্ত্র চায়- বিষয়টি এত সরল নয়। পরিশেষে সমাজতন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্র, ব্যুরোক্রেসি মুক্ত গণতন্ত্র। আজ এই স্থান থেকে সারা বিশ্বে নাই এমন একটা শাসন ব্যবস্থা আমরা চাইতে পারি কিনা? অবশ্যই পারি। যারা ইশ্বরের আরাধনা করেন, তারা কখনো না পেয়েই আরাধনা করতে থাকেন। তাহলে যারা গণতন্ত্র আরাধনা করেন, তারা কখনো না পেয়ে আরাধনা করতে পারবেন না কেন?

গণতন্ত্রের অভিযাত্রা খোদ গণতন্ত্রের রাস্তা বাতলে দেয়। সে কারণেই যে গণতন্ত্র দেখা হয়নি, সে গণতন্ত্রের আকাঙ্খা আমরা করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে করতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে করতে পারি, সম্ভবত সারা বিশ্বেই করতে পারি। এজন্য দরকার প্রবল ইচ্ছাশক্তি। যা সম্ভব নয়, তাকে সম্ভব মনে করা। এ প্রসঙ্গে আমাদের একজন শিক্ষাগুরু একটা কথা বলেছেন, যিনি রাজনৈতিকও গুরু, যাকে একাডেমীতে পড়ানো হয়, যিনি ইতালিয় কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন, তিনি আন্তনিও গ্রামসি।

তিনি বলতেন, "Pessimisms of the intellect, optimism of the will." "আপনার বুদ্ধি আপনাকে বলবে সম্ভব না, কিন্তু আপনার ইচ্ছা বলবে সম্ভব"।

আমি আমার সেই ইচ্ছাশক্তির দাস এবং একারণেই আমি গণতন্ত্রকে সহজেই চিনি।সবাইকে ধন্যবাদ।