ক্রোধ ব্যবস্থাপনা ও সহিঞ্চুতার সংস্কৃতি নিয়ে

মিজানুর রহমান -
Published : 15 March 2012, 02:38 AM
Updated : 15 March 2012, 02:38 AM

ক্রোধ ব্যবস্থাপনা ও সহিঞ্চুতার সংস্কৃতি নিয়ে মানবাধিকার সংগঠক ও শিক্ষাবিদ দেলোয়ার জাহিদের মুখোমুখি
—————————
সাক্ষাৎকার গ্রহণে: মিজানুর রহমান

কানাডাপ্রবাসী একজন শিক্ষক, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন লেখক, একজন সাংবাদিক, একজন মানবাধিকার সংগঠক ও সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক নাম তার দেলোয়ার জাহিদ।২০০৩ সাল থেকে ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, সেন্ট পল্স কলেজ'র রিসার্চ ফেলো, কানাডার খ্যাতনামা কনফ্লিক্ট রেজুলিউশন নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডঃ ডীন ই পীচি (বর্তমানে কানাডার গ্লোবাল কলেজের ভাইস প্রিন্সপাল) তার সাথে তদানিন্তন সময়ের একজন সহযোগি ও গবেষক। দেলোয়ার জাহিদের "সালিস-দি রুরাল মেডিয়েশান অব বাংলাদেশ" গবেষনাপত্রটি ক'টি আন্তর্জাতিকমানের প্রকাশনায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশে ট্রান্সিশনাল জাষ্টিস বা পরিবর্তনশীল বিচার ব্যবস্থা ও মানবাধিকার নিয়ে '৮০ এর দশক থেকে এ ক্ষেত্রে কর্মরত ফাদার আর ডব্লিউ টীম, জাষ্টিস কামাল উদ্দিন হোসেন, ব্যারিষ্টার নাজমূল হুদা, এডভোকেট সিগমা হুদা এর সাথে উন্নয়নের সুতিকাগার বলে খ্যাত কুমিল্লা থেকে তৃণমূলে মানবাধিকার আন্দোলনে যোগ ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দেলোয়ার জাহিদ।

তিনি বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা'র জেলা সভাপতি (১৯৮২-১৯৯২) এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
তিনি কানাডা'র দি জন হাওয়ার্ড সোসাইটি অব ম্যানিটোবা'র বোর্ড অব ডিরেক্টরসের মেম্বার এবং দি ম্যানিটোবা সেন্টার ফর সোসাল এন্ড পিস স্টাডিজ এর পরিচালক হিসাবে কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন।দি জন হাওয়ার্ড সোসাইটি সারা কানাডা ব্যাপী মোট ৬৫টি দপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজ করে। সংস্থার উত্তম পেশা পরিচালনার উল্লেখযোগ্য অনেকগুলো নজির রয়েছে এবং সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের মৌলিক ও মানবিক বিচার নিশ্চিত করতে তারা সদা সচেতন ও সজাগ।

বাংলাদেশে দ্বন্ধ বা মতবিরোধ নিরসনে কানাডা'র শিক্ষা, প্রশিক্ষন ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্নজাল বুনে চলেছেন দেলোয়ার জাহিদ। বাংলাদেশে এ বিষয়ে ভবিষ্যৎ কাজের প্রেক্ষাপট বিনির্মানে এ সাক্ষাৎকারটি নেয়া হলো।

প্রশ্নঃ ক্রোধ বা রাগ বলতে আমরা কি বুঝি?
উত্তরঃ মানুষ ও প্রাণীকুলের কিছু কিছু প্রাণীদের মধ্যে একধরনের সহজাত অনুভুতি হলো রাগ। মানুষ যখন নৈরাশ্য, অসন্তুষ্টি, অপছন্দ বা কোনরূপ সমালোচনার সন্মুক্ষীণ হয়, বা কোন ভয় বা ভীতিকর অবস্থায় পড়ে তখন রাগের সৃষ্টি হয় । এ পরিবর্তীত মানসিক অবস্থায় মানুষ উত্তেজিত হয়ে নিজ বা অপরের জন্য অনেক সময় ক্ষতিকর কাজ করে বসে।

প্রশ্নঃ মানুষ রাগান্বিত হওয়ার বিশেষ কারনগুলো কি?
উত্তরঃ মানুষ যখন কোন কারনে দুঃখ পায় বা একাকীত্ববোধ করে তখন একেকজন একেকভাবে তার প্রতিক্রিয়া, অভিব্যক্তি বা রাগকে প্রকাশ করে। রাগ মানুষের শরীরে একধরনের এডরিনালাইন হরমোন রিলিজ করে যার প্রভাবে পেশীসমূহে উত্তেজনা, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি ও ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক সমস্যা-সংকট ও সংঙ্গ বিবাদের ভয়, মাদকাসক্তি, যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয় মানসিক চাপ বাড়ায় যা কিনা রাগ বা ক্রোধের সৃষ্টি করে। রাগ সব সময় খারাপ নয় যদি তা যথাযথ ভাবে নিয়ন্ত্রন ও পরিচালিত করা যায়। এটি নির্ভর করে প্রচলিত রীতি, সংস্কৃতি ও কৌশল প্রয়োগের উপর। রাগ একটি সমস্যা নয়, বরং সমস্যা হলো তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা বা মোকাবেলা করা। আমরা জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে বিষয়গুলোক নানাভাবে আমাদের জীবনে সমাধান করে থাকি। এ বিষয়ে আরো সচেতনতা সৃষ্টি আমাদের কাজকে সহায়তা করতে পারে।

প্রশ্নঃ ক্রোধ বা রাগ প্রশমনের সবচেয়ে ভাল উপায় কি?
উত্তরঃ মানুষ তার সহজাত আবেগ থেকে সুখী, দুঃখী বা কখনো ঈর্ষাকাতর হয়। এটাও একধরনের প্রাকৃতিক বোধ যা প্রকাশ বা নির্গমনের সঠিক পন্থা জানা থাকা দরকার। যখন মানুষের চাওয়া, পাওয়া তার নিজের মতো করে এগুয় না তখন তার মধ্যে একধরনের নৈরাশ্য সৃষ্টি হয়। সে ক্ষেত্রে স্ব-সচেতনতা ও আত্মসংযমই রাগ প্রশমনের ভাল উপায়। আমরা কোন কিছু বলার বা করার পূর্বে যদি তা একটু উপলদ্ধি করতে পারি তখন রাগ বা ক্ষোভ প্রশমন অনেকটা সহজ হয়।

প্রশ্নঃ রাগ প্রশমনের বা দমনের জন্য কখন পেশাদার লোকের সহায়তার প্রয়োজন হয়?
উত্তরঃ মানুষের জীবনে উত্থান পতনের সাথে সাথে একধরনের মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টি হয়। কোন কোন চাপ ক্ষণস্থায়ী কোনটা বা একটু দীর্ঘস্থায়ী হয়। সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিকভাবে কিছু কিছু মানসিক ক্ষত সেরে উঠে আবার কখনো বা ঔষধের সহায়তা নেয়ার প্রয়োজন হয়।বাংলাদেশে মানুষের মনস্তাত্বিক চাপ বয়স, পেশা ও স্থান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। এ সমস্যাটি মোকাবেলা করার জন্য আমাদের আরো অধিক জনসচেতনতা দরকার। কানাডা সহ উন্নত দেশগুলোতে এ বিষয়ে প্রচুর কাজ করার সুযোগ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ এবং প্রশিক্ষিত লোকবল রয়েছে।

প্রশ্নঃ সহিংসতার সাথে ক্রোধ বা রাগের সম্পর্ক কি? রাগ কিভাবে মানষিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে?
উত্তরঃ ক্রোধ বা রাগের বশবর্তী হয়ে কোন ব্যক্তি বিশেষ সহিংস বা উশৃংখল হয়ে উঠতে পারে। ক্রোধোন্মত্তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য স্ব-সচেতনতা খুবই জরুরী। প্রার্থনা, যোগ ব্যায়াম ছাড়াও নানাবিদ উপায় রয়েছে যার মাধ্যমে ক্রোধ বা রাগকে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রনে নেয়া যায়। যেমন- অনেক রাগান্বিত ব্যক্তি যদি দাঁড়ানো থেকে বসে বা শুয়ে পরলে বা একগ্লাস পানি পান করলে রাগকে দমন করা যায়।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্রোধ বা রাগ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমাদের কি করা উচিত এবং কিভাবে তা করা উচিত?
উত্তরঃ বাংলাদেশে এ সমস্যাটি বর্তমানে অনেকটা প্রকট আকার ধারন করেছে। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ক্রোধ বা রাগ প্রকাশের সংস্কৃতি খুবই দূর্বল ও নিম্নমানের। গণমাধ্যমের বদৌলতে বর্তমানে দেশে বেশ কিছু জনস্বার্থমূলক বিষয় জনসন্মুখে আসছে যাতে আমাদের এসকল সীমাবদ্ধতাগুলো সবারই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে এবং এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবনার ও খোরাক সৃষ্টি হয়েছে।

প্রশ্নঃ একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজগঠনে রাগ ব্যবস্থাপনা কি ভুমিকা রাখতে পারে?
রাগ ব্যবস্থাপনা আমাদের জাতীয় জীবনে একটি অতি জরুরী বিষয়। সভ্য দেশগুলোতে এর প্রতিনিয়তই চর্চা হচ্ছে এর প্রভাব আমরা প্রতিনিয়ত মিডিয়ায় দেখতে পাই। বাংলাদেশীদের নৈমিত্তিক জীবনে এর তীব্র প্রভাব পড়ছে। আমারা যত্রতত্র এগুলো লক্ষ্য করে আসছি কিন্তু বিষয়টিকে এমনভাবে কখনোই গুরুত্ব দিচ্ছি না। গত ২৮ ফেব্রয়ারি বিডিনিউজ২৪ডটকম এ পিলে চমকে যাওয়ার মতো একটি খবর প্রকাশ পেয়েছে। ঠিকমতো পড়াশুনা না করার অপরাধে একটি শিশুটিকে পায়ে শিকল আর গাছের গুড়ি দিয়ে টানা তিনদিন বেধে রেখে শাস্তি দেয়া হয়েছে । শিশুটির অভিবাবক বা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যারাই এ নেক্কারজনক কাজটি করে থাকুন তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে! বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের মারধর ও বেত্রাঘাত আইনত দন্ডনীয় অপরাধ কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি তার বাবা মা দ্বারা এ অপরাধটি সংঘটিত হয়ে থাকে? এখানেও কি শাস্তির বিধান থাকা উচিত নয়?

প্রশ্নঃ ক্রোধ বা রাগের গঠনমূলক পরিবর্তন এবং এর সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে আমাদের গণমাধ্যমগুলো কি ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?
ক্রোধ বা রাগের বিষয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারনাগুলো খুবই সনাতন এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও ইতিবাচক কোন পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশে নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার প্রতিকারে এবং একটি সহিঞ্চু, শান্তিপ্রিয় সমাজ গঠনে গণমাধ্যমগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।