গার্মেন্টেস শ্রমিকদের জীবন

মিজান
Published : 8 June 2011, 05:49 PM
Updated : 8 June 2011, 05:49 PM

আমরা ইদানিং প্রায় দেখি গার্মেন্টেসে সংঘর্ষ হয়। গত কয়েক বছর ধরে এই ধরনের বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ আমরা দেখেছি। যে মানুষগুলো মেশিন চালিয়ে , কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখে তারা কেন তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানটিতে ভাংচুর করে, তাদের হাতে তৈরি করা পোশাকে আগুন ধরিয়ে দেয় তা হয়ত আমাদের অনেকের অজানা। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে এর কিছু অংশ আপনাদের শেয়ার করতে চাই। এখানে যারা কাজ করতে আসে তাদের অধিকাংশ খুবই দরিদ্র, কেউ স্বামী পরিত্যক্তা, কেউ স্বামীর বহু বিবাহের শিকার, কেউ আসে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করে, কেউ সমাজের মাতব্বর শ্রেণীর কারণে এক ঘরে হয়ে আবার কেউ এলাকার বখাটে ছেলেদের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্যে মা বাবা অনুরোধে শহরে কোন আত্মীয়ার বাসায় আশ্রিত হয়ে। যেমনঃ (১)রুবি বড়ুয়া বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারে আর কেউ না থাকার কারনে দারিদ্রের কষাঘাতে বাধ্য হয়ে শহরে এসেছেন কাজের আশায়। (২)মনির বাবা কাজের মেয়েকে বিয়ে করার কারনে এলাকায় অপমান থেকে বাঁচতে নিজের মাকে নিয়ে শহরে এসেছে কাজ করতে (৩) দরিদ্র পিতার একমাত্র মেয়ে লাইজু এলাকার বখাটেদের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে আত্নীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়ে এখন গার্মেন্টসে কাজ করতে হচ্ছে।(৪) সুপ্তি এলাকার এক ছেলের সাথে প্রেম করার অপরাধে এলাকা ছাড়া হয়ে শহরে আশ্রয় নিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করছে। (৫) নাজমা স্বামীর বহু বিবাহের স্বীকার। এগুলো আমার চেনা কয়েক জন মেয়ের কাহিনী যারা গ্রাম ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে এসে বিভিন্ন কারখানায় কাজ করছে। এ ছাড়া আরো অনেকে নানান সমস্যার কারনে বাধ্য হয়েই কাজ করছেন এসব কারখানায়। আবার অনেকে অন্য কোন কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত গার্মেন্টসে কাজ করছে। সেই সকাল ছয়টা থেকে শুরু হয় তাদের কর্মব্যস্ততা। কারো আবার অনেক আগ থেকে শুরু হয়ে যায় ব্যস্ততা । কেননা তারা অনেকে এক জায়গায় অনেক লোক গাদাগাদি করে থাকে। হয়তো এখানে টয়লেট একটা তাই সকাল সকাল উঠেই সিরিয়াল নিতে হবে।

আবার কোথাও দেখা যায় অনেক ঘর কিন্ত গ্যাসের চুলা দেয়া হয়েছে মাত্র একটা তাই যে আগে দখল নিতে পারবে সে আগে রান্না করতে পারবে। যেমন সুপ্তি , তার কাজ সকাল আটটা থেকে কিন্তু তাকে গ্যাসের সিরিয়াল বা ওয়াসার পানি নেয়ার জন্যে ঘুম থেকে উঠতে হয় ভোর পাঁচটা অথবা কোন কোন সময় ভোর চারটায়। খাবার দাবার রেডি করে তারপর টিফিন ক্যারিয়ার হাতে ছুটে চলা কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। কেউ এক মাইল দুই মাইল হেঁটে আবার কেউবা গাদা গাদি করে বাসে কর্মস্থলে রওয়ানা হচ্ছেন।

সবারই খুব তাড়া , এদিক সেদিক তাকানোর সুযোগ নেই। দেরি হলে হয়তো শুরু হবে সুপারভাইজার বা ম্যানেজারদের নির্যাতন। হইত গেইটে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে বা বেতন কর্তন করা হবে আর অকথ্য ভাষায় গালাগালি দরিদ্র হয়ে জন্ম নেয়ায় প্রতিদিনের পুরষ্কার তো আছেই। এই আতংকে বার বার ঘুম থেকে উঠে ঘড়ি দেখা হয় যদি দেরি হয়ে যায়! শুরু হয় কর্ম ব্যাস্ততা। সে জানে না তার কখন ছুটি হবে। সে শুধু জানে তাকে প্রতি ঘন্টায় প্রোডাকশন ঠিক রাখতে হবে। না হলে ম্যানেজারের টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। সবাই তাকে দেখবে, যেই এই পথ দিয়ে যাচ্ছে সেই তাকাচ্ছে তার দিকে। উঃ কি অপমান। অতঃপর ম্যানেজার এসে বলবে জানোয়ার প্রোডাকশন কয় ? শিপমেন্ট কি তোর বাপে দিবে? হয়ত হাতে থাকা বেল্ট দিয়ে দিবে একটা আঘাত আর সুপার ভাইজারকে ডেকে বলবে এর বেতন কাট। সেই মেয়েটি অপমান সইতে না পেরে মেশিনের নিচে মুখ লুকিয়ে কাঁদবে আর বলবে গরিবের ঘরে জন্মেছি বলে কি আমি মানুষ না। কথায় কথায় জানোয়ার বলে, মারে, বেতন কাটে আমার কি কষ্ট হয় না। না এখানে আবেগের কোন স্থান নেয়, কেউ সান্তনা দেয়ার নেয়, সবাই ব্যস্ত , প্রোডাকশন দিতে হবে। দুপুর সাড়ে বারটা বা একটার সময় টিফিন ছুটি হয় মাত্র আধ ঘন্টা সময়ের জন্যে। শিপমেন্ট থাকলে কারো কারো ভাগ্যে তাও জুটে না। কাজের ফাঁকে কিছু একটা খেয়ে নিতে হয়। এখানে অধিকাংশ কারখানায় খাবার দেয়া হয় না। আবার কোন কোন কারখানায় খাওয়ার জন্যে কোন কেন্টিন নেয়। তাই ছাঁদের উপর খোলা আকাশের নিচে প্রচন্ড রোদের মধ্যে খাবার খেতে হয়। ভিতরে খাওয়া সম্পূর্ণ ভাবে নিষেধ। অনেকে সামান্য একটা সিঙ্গারা বা দু" একটা বিস্কিট খেয়ে দিন পার করে। আমি এমনও দেখেছি, আমার কাছ থেকে এক টাকা নিয়ে পিয়াঁজু খেয়ে সন্ধা সাতটা পর্যন্ত কাজ করেছে। তবে তাদের মধ্যে আবার অনেক মিল দেখেছি। যেমন: দেখা গেল আজকে কেউ একজন খাবার আনে নি, তখন অন্যরা তাকে সাথে নিয়ে ভাগা ভাগি করে খায়।

খাবারের মেন্যু টা আশ্চর্য হবার মত। একবাটি ভাতের সাথে হয়ত একটু শাক বা আলুর ভর্তা , হয়ত আলুর বাজি বা ডাল জাতীয় কিছু। একদিন একজন বলেই ফেলল সে একবছরের মধ্যে একদিন কোরবানির ঈদে মাংস খেয়েছিল তাও আবার বাড়িওয়ালা দিয়েছিল বলে। এছাড়া কোন দিন মাংস খেতে পায়নি। আধা ঘন্টা টিফিন সময় শেষ হওয়ার আগেই বেল বাজা বা সুপারভাইজারের চিৎকার শুরু হয়ে যায় এই কাজ শুরু কর। এখানে তাদের সাথে সবাই তুঁই শব্দ ব্যবহার করে। সে বড় হোক বা ছোট হোক। একবার আমি একটা মেয়েকে আপনি করে বলছিলাম বলে সে হেসেই হয়রান। আমি জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপার কি ? আমি কি হাঁসার মত কিছু বলছি। পরে অন্য একজন বলব এখানে সবাই তুই করে বলে, তাই আমরা সাধারণত তুই শব্দটা শুনতেই অভ্যস্ত। কেউ কোনদিন আপনি বা তুমি করে বলে না। তাই হঠাৎ আপনার কাছ থেকে শুনে হাসি পায়ছে। এভাবে অবজ্ঞা অবহেলায় তাদের জীবনের সময়গুলো কেটে যায়। কখনো বা ১০ ঘন্টা ,১২ ঘন্টা, কোন কোন সময় ১৬ ঘন্টাও কেটে যায়। কোনদিন আট ঘন্টা বা দশ ঘন্টা পর ছুটি হলে সবার চোখে মুখে সেকি আনন্দ। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে যখন বাসায় যায় তখন বিনোদন হিসাবে বিটিভির নাটক দেখে বা বুকটা ফাইট্টা যায় মার্কা গান শুনে সময় কাটায় , কেউবা পরের দিনের কাজের প্রস্তুতি নিয়েও ব্যস্ত হয়ে যায়। তারা এক একটা রুমে দুই- তিন পরিবার একসাথে থাকে। একবার আমি একটা রুমে গিয়ে ছিলাম। তাদের থাকার অবস্থা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। ১৫ ফুট বাই ১৫ ফুট রুমে একটা খাট ,এটাতে তারা স্বামী- স্ত্রী দুইজন, খাটের সামনের দিকের খালি জায়গায় দুইজন মেয়ে, খাটের পিছনের খালি জায়গায় একজন ব্যাচেলর ছেলে। এদের বললাম এটা কেমন থাকা , ছোট্ট একটা রুমে এত লোক আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে। তারা বলল এটা আমাদের দারিদ্র্যতার কারণে বাধ্য হয়ে থাকছি। এত দারিদ্রতা , কষ্ট , অবহেলার মাঝেও তারা সুন্দর ভাবে বাঁচার স্ব্‌প্ন দেখে। এইসব লোকেরা এত পরিশ্রম করেও মাসের শেষে ঠিকমত বেতন পায়না। অভার টাইম দেয়ার ক্ষেত্রে সময় চুরি বা যে কোন অসিলায় বেতন কাটার পরেও কারখানার উৎপাদনের চাকা চালু রাখতে চায়। তাদের পরিশ্রমে মালিকের ভাগ্যের চাকা ঘুরে কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। তারা পরিশ্রম করেই যাচ্ছে। বিশ্রামের সময় নেয়। তারা শুধু জানে বাঁচতে হলে কাজ করতে হবে, আর ভাবে এই পৃথিবী কর্মময়, মরিলেই বিশ্রাম হয়।