ওহাবী মতবাদ-ইসলাম পন্থীদের প্রতি ইসলাম বিদ্বেষীদের গালি

মিজানুর কালিগঞ্জ
Published : 8 Dec 2014, 04:06 PM
Updated : 8 Dec 2014, 04:06 PM

আর্ন্তজাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুন্যাল কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের রায় ঘোষনার পর বিশেষ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে সংবাদ ও টকশোর মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতাদের তৎকালীন সময়ের কর্মকান্ড তুলে ধরা হয়। এ প্রজন্মের সন্তান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে জানতে আলোচনায় অংশ নেয়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গের আলোচনা মনোযোগ সহকারে শোনার চেষ্টা করি। অনুষ্ঠানে বিশেষ কয়েকজন প্রগতিশীল মুসলিম আলোচকের আলোচনায় জামায়াতকে ওহাবী ও মওদুদী মতবাদের অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাদের আলোচনা থেকে এটুকু বুঝতে পারি ওহাবী মতবাদ ও মওদুদী মতবাদ ইসলামের বৈপরীত্ব্য মতবাদ এবং এই দুই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতারা কোরআন হাদীসের অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে কায়েমী স্বার্থ হাসিল করেছিলেন। আলোচকদের মতে ওই দুই মতবাদের অনুসারী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করছে। সেই থেকে ওহাবী মতবাদ ও মওদুদী মতবাদ সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ জন্মে। পাঠক আজকের লেখায় ওহাবী মতবাদ সম্পর্কে তুলে ধরব।

মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব নজদী ১৭০৩ খ্রিঃ নজদ প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সে তিনি কোরান ও হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করেন। তৎকালীন মুসলিম সমাজে শির্ক, বেদা'তের ব্যপক চর্চা হতো। তিনি বিভিন্ন স্থানে সভা সমাবেশের মাধ্যমে ভয়াবহ এ পাপাচার থেকে মুসলমানদের ফিরে আসার আহ্বান জানান। ১৭৩৪ খ্রিঃ তিনি ইসলামী খেলাফত পূর্নরুদ্ধার আন্দোলন শুরু করেন। এশিয়াস্থ তুর্কীদের বহু প্রদেশে তিনি খেলাফত কায়েম করেন। ১৭৯২ খ্রিঃ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ওহাবী মতবাদ নিয়ে আলোচনার পূর্বে তৎকালীন সময় ও তার পূর্ববর্তী সময়ের মুসলমান বাদশাদেও শাসন ও ইসলামের প্রকৃত অনুসারীদের ওপর নির্যাতনের কিছু চিত্র তুলে ধরা দরকার। ইমাম হুসাইন (রাঃ) তৎকালীন মুসলিম স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে খেলাফত পূর্নরুদ্ধার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। জালিম শাসক তাকে ও তার সহচরদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এর পরবর্তী সময়ে হযরত যায়েদ (রাঃ) ও তার সন্তান ইয়াহিয়া (রাহঃ) সে সময়ের মুসলিম স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় তাদেরকে হত্যা করা হয়। স্বৈরাচারী সরকার হযরত যায়েদ (রাঃ) কে হত্যার পরে তার মাথা কেটে দামেস্ক নগরীর প্রধান দরজায় টাঙিয়ে রাখে এবং মস্তক বিহীন দেহ উলঙ্গ করে কুনাসা নামক স্থানে ১৪ মাস টাঙিয়ে রাখে। একই অবস্থা করা হয় তার সন্তান শহীদ ইয়াহিয়া (রাহঃ) এর মৃত দেহকে। এরপর বিকৃত ইসলামের প্রতিবাদ করায় মুহাম্মাদ নফসে যাকিয়া (রাহঃ) ও হযরত ইবরাহীম (রাহঃ) কে হত্যা করা হয়। মস্তক কেটে তাদের লাশেরও অবমাননা করা হয়। এর পরবর্তী সময়ে হানাফী মাযহাবের প্রবক্তা ইমাম আবু হানিফা (রাহঃ) খেলাফত ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার আন্দোলনকে সহযোগিতা ও তৎকালীন ইসলাম বিদ্বেষী মুসলিম বাদশাকে অসহযোগিতা করায় তাকে কারাগারে খাদ্যে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। মুসলিম স্বৈরশাসকের নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি ইমাম মালেক (রাহঃ), ইমাম শাফেয়ী (রাহঃ), ইমাম হাম্বল (রাহঃ)। ইসলামকে বিকৃত করায় মুসলিম স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হওয়ায় ৪ ইমামের সবাই তৎকালীন সরকারের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। এবার ওহাবী মতবাদ নিয়ে আলোচনা করা যায়। ওহাবী আন্দোলনের সূত্রপাত যে সময়ে হয় সে সময়ের ইসলাম বিবর্জিত মুসলিম শাসকদের কারণে মুসলিম সমাজে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন সম্পর্কিত কিছু কথা বলা দরকার। আটার শতকের গোড়ার দিকে ভারতবর্ষ, তুরস্ক ও পারস্যে মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের নামে ব্যাপক মাজার-দরগাহ্ ও পীর পূজার প্রচলন শুরু হয়। সে সময়ে এক শ্রেণির সুবিধাভোগী আলেম পার্থিব স্বার্থে কোরান হাদীসের বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করে ইসলামের বিপরীত প্রথা প্রচলন করেন। সেময়ে মুসলমানরা কবরে বাতি জ্বালিয়ে ফুল দিয়ে সজ্জিত করত। মাজারে মানত করতো, মৃত পীর পয়গম্বরদের কাছে সাহার্য পার্থনা করতো। এমনকি হজ্বে এসে মুসলমানরা মক্কা-মদীনার পবিত্র স্থানে শির্ক-বিদা'তে মগ্ন থাকতো। তুর্কি মুসলিমরা হজ্ব যাত্রাকালে সবচেয়ে অসচ্চরিত্রা রমণীদেরকে সংগে নিয়ে আসতো। তাছাড়াও তারা জঘন্যতম পাপাচারে লিপ্ত থাকতো। তারা প্রকাশ্যে মদ্য পান করতো ও আফিম খেত। মুসলমানদের এমন অধঃপতন দেখে মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহঃ) শির্ক বিদা'তের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন।

দি ইন্ডিয়ান মুসলমান্স গ্রন্থের লেখক উইলিয়াম হান্টার ওহাবী মতবাদ সম্পর্কে এভাবেই লেখেন-" তরুন আব্দুল ওহাব হজ করতে এসে সহযাত্রীদের লজ্জাকর লাম্পট্য ও হরেক রকম ভাঁড়ামি শহরটিকে কলুষিত করে ফেলেছে দেখে তিনি(মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব) অত্যান্ত ব্যথিত হন। প্রায় তিন বছর ধরে তিনি দামিশ্কবাসী মুসলমানদের দূনীতি ও দুশ্চরিত্র সম্বন্ধে গভীর চিন্তা করেন এবং শেষে এ-সবের প্রকাশ্যে নিন্দা করতে আরম্ভ করেন। তিনি প্রকাশ্যে তুর্কী আমেদের এ বলে নিন্দা করতে থাকে যে, তারা নিজেদের আচার অনুষ্ঠানের দ্বারা আল্লাহ্র লিখিত বাণীকে অকেজো করে ফেলেছেন এবং অবর্ণনীয় পাপাচারের ফলেই তুর্কী জাতটা আজ কাফেরদের ও চেয়েও ঘৃন্য হয়ে উঠেছে। তার এইসব উক্তি দ্বারা তিনি নিজেকে তরস্কের শাহী দরবারে বিষেশভাবে ঘৃণার পাত্র করে ফেলন এজন্য শহরে থেকে শহরে বিতাড়িত হয়ে অবশে তিনি দারিয়ার শাসক মোহাম্মদ ইবনে সাউদের নিকট আশ্রয় লাভ করেন। —-তার সাহায্যে একটা ক্ষুদ্র আরব জোট গঠিত করে তুর্কী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নিশান উড়ালেন।"

মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব মুসলিম সমাজ থেকে বিকৃত ইসলামকে বিতাড়িত করতে একদল মর্দ্দে মুজাহিদ তৈরী করেন এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে ইসলাম বিবর্জিত বাদশাহদের হঠিয়ে খেলাফত ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনেন। এরপর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব সুসজ্জিত মাজার ভেঙ্গে মাজার পূজা বন্ধ করেন। দুঃচরিত্রা নারী নিয়ে হজ্বে আসা নিষিদ্ধ করেন। মক্কা মদিনার পবিত্র স্থান সমূহ প্রচলিত শির্ক-বেদা'তের মুলোৎপাটন করেন। তার আমলে বিজিত প্রদেশগুলোতে তিনি ইসলামী রীতি নীতি প্রর্বতন করেন। মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাবের মৃত্যুর পরে তার অনুসারীরা ক্ষমতা হারাবার পূর্ব পর্যন্ত প্রদেশগুলোতে ইসলামী রীতি নীতি প্রচলন রাখেন।

যুগে যুগে যখনই কোন শ্রেণি বা গোষ্ঠি মানুষকে প্রকৃত ইসলামের দিকে আহ্বান করে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, তখনই তাদের ওপর তৎকালীন শাসক শ্রেণির নির্যাতন নেমে এসেছে। সে সময় কায়েমী স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে এক শ্রেণির আলেম ও প্রগতিশীল মুসলিম বুদ্ধিজীবি সরকারের পক্ষ নেয়। এই শ্রেণি ইসলামের প্রকৃত অনুসারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফতোয়া জারি করে এবং তাদের আন্দোলনকে স্তিমিত করতে নানা রকমের গালি দেয়। "ওহাবী মতবাদ" ইসলাম পন্থীদের প্রতি ইসলাম বিদ্বেষীদের তেমন-ই একটি গালি।