ঝিনাইদহ জেলখানায় ৭ দিন ও জেলখানার ডলার

মিজানুর কালিগঞ্জ
Published : 19 Dec 2014, 11:27 AM
Updated : 19 Dec 2014, 11:27 AM

সম্প্রতি একটি মামলার সুবাদে আমার জেলখানায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে হাইকার্টের আগাম জামিন শেষে চলতি ডিসেম্বর মাসের ১০তারিখে নিম্ন আদালতে হাজিরা দিই। আমার আইনজীবি এ্যাডভোকেট আশরাফুল আলম বিজ্ঞ আদালতের কাছে আমার জামিন প্রার্থনা করেন। জামিনের ব্যাপারে আমি বেশ আশাবাদি ছিলাম। কারণ যেদিন যেসময়ের ঘটনায় আমার নামে মামলা হয়, সেদিন সেসময়ে আমি আমার কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলাম। এ্যাডভোকেট সাহেব মাননীয় আদালতে ঘটনার দিন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রত্যয়ণ পত্র ও হাজিরা খাতার ফটোকপি দাখিল করেন। তার মক্কেল জামিন পাওয়ার যোগ্য এই মর্মে বিনয়ের সাথে যথেষ্ট যুক্তি-তর্ক পেশ করেন। কিন্তু এ্যাডভোকেট সাহেবের আর্জি বিজ্ঞ বিচারকের মন গলাতে পারেনি। এমনকি বিচারক মহোদয় জামিনের স্বপক্ষে আদালতে উপস্থাপিত কাগজপত্রাদি পড়ে দেখারও প্রয়োজন মনে করেননি । বিজ্ঞ বিচারক মহোদয় কলমের ছোট্ট এক খোঁচায় জামিন না মঞ্জুর করেন। ছোট ভাইয়ের জামিন না করাতে পেরে এ্যাড. আশরাফ ভাই বেশ কষ্ট পান। কাঠগড়ার সামনে এসে আমাকে বিভিন্নভাবে শান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করেন। এদিকে জামিন না পাওয়ায় বিচারকের প্রতি আমার সাময়িক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য তা প্রশমিত হলো এই ভেবে- পুলিশ যখন প্ররোচিত হয়ে অন্যায়ভাবে আমার নামে মামলা দিতে পারল, তখন বিচারক মহোদয় জামিনের পক্ষে উপস্থাপিত কাগজপত্রাদি না দেখাটা এমন কি আর অন্যায় করেছেন।
আমি গণিতের ছাত্র। আদালতের আইন-কানুন ভালো বুঝিনা। বিচারক সাহেব হয়তো আইন অনুযায়ী-ই বিচার করেছেন। কেউ আইনের উর্ধ্বে না। আর আমিতো রাষ্ট্রের একজন অতি সাধারণ নাগরিক মাত্র। পাঠক শুরুতে জেলখানায় যাওয়াকে সৌভাগ্য বলেছিলাম, তার স্বপক্ষে দু'একটি কথা না বললেই নয়। আমার জানা মতে ৩৭বছরের এই দীর্ঘ জীবনে কাউকে কোনদিন একটি চড়-থাপ্পড়ও মারিনি। অপরাধমূলক কোন ব্যবসা বানিজ্যও করিনি। ভবিষ্যতে এমন কোন কাজ করার পরিকল্পনাও নেই। এছাড়া বাজে কোন নেশাও নেই যার জন্য পুলিশের হাতে পাকড়াও হয়ে জেলে যেতে হবে। কাজেই ভবিষ্যতে জেলে যাওয়ার কোন সুযোগ সৃষ্টি হতো বলে আমার মনে হয় না। তাই জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে করা মামলায় যদি আমাকে জড়ানো না হতো, তা হলে জেলে যাওয়া আমার কপালে হয়তোবা জুটতো না।

ঝিনাইদহ জেলখানায় ৭দিন ছিলাম। এই ৭দিন জেলে থেকে বুঝলাম, এখানে না আসলে শিক্ষার একটি অংশ অপূর্ণ থেকে যেত। এই কারণে জেলে যাওয়াকে সৌভাগ্য বলেছিলাম। পাঠক এতক্ষণে হয়তো আমার ওপর বেশ বিরক্ত হয়ে পড়েছেন এই ভেবে যে, শিরোনাম কি আর লিখছি কি। হ্যাঁ এবার ডলার সম্পর্কে লিখব। জেলখানার নিয়ম অনুযায়ী প্রথম রাতে বন্দিদের আমদানি ওয়ার্ডে রাখা হয়। পরের দিন বিভিন্ন ওয়ার্ডে রফতানী করা হয়। প্রথম রাতে আমরা আমদানিতে থাকি। পরদিন ভোর বেলায় আমার সাথে অন্যান্য বন্দীদের কেইস টেবিলে হাজির করা হয়। এখানে জেলার ফাইল ও সুপার ফাইল হয়। জেলার সাহেব আসার আগে ৩২বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামী আব্দুর রশীদ ভাই আমাদেও জেলখানার বিভিন্ন নিয়ম কানুন শিক্ষা দিলেন। জেলার আসলে কিভাবে সাবধান হতে হবে, কিভাবে সালাম দিতে হবে তাও শেখালেন। রশিদ ভাই কেন জানি আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। নিজেকে একজন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতেই তিনি বললেন, স্যার দেখলেনতো আপনাদেরও জেলে আসতে হচ্ছে। একটু থেমে রশিদ ভাই বলেন, আমরা যারা জেলে আছি সবাই কিন্তু অপরাধী না। অধিকাংশই ষড়যন্ত্রের শিকার। রশিদ ভাই অনুরাগের সুরে বলেন, আমাদের যখন বেড়ি পরিয়ে কোর্টে নেওয়া হতো তখন সাধারন মানুষ আমাদেরকে মস্তবড় সন্ত্রাসী ভেবে খুব ঘৃনার দৃষ্টিতে দেখতো। সে সময় খুব খারাপ লাগতো। তারপর কোন ধরনের বন্দিদের বেড়ি পরানো হয় তা তিনি বর্ণনা করলেন। এরপর রিহার্সেল হলো- জেলার সাহেব আসলে কিভাবে বসতে হবে এবং কিভাবে সাহেবকে সালাম দিতে হবে তার। জেলার সাহেব আসলেন। আমরা রশিদ ভাইয়ের শেখানো সব কিছু অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম। জেলার সাহেব নিজের চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা গ্লাসের পানিতে চুমুক দিয়ে স্ট্রের ওপরে রাখা সিগারেটটা ধরালেন। ভোরের কুয়াশা আর সিগারেটের ধোঁয়া একসাথে মিশে কুন্ডলী পাকিয়ে উত্তওে হাওয়ার ধাক্কায় আমাদের গায়ে আছড়ে পড়ল।

জেলার সাহেবের সিগারেট টানা দেখে আমাদের সাথে থাকা এক আসামীকে ফিসফিস করে বলতে শুনি যাক জেলে মনে হয় বিড়ি-সিগারেট খাওয়ায় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। এক ঘন্টার মধ্যে জেলার ফাইল ও সুপার ফাইলের কাজ শেষ হয়। এরপর আমাদেরকে নিজ নিজ ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো। ওয়ার্ডের মেড বিডিআর সদস্য শৈলকুপার জিল্লুর রহমান আমাদেরকে রিসিভ করলেন। ওয়ার্ডের একজন কম্বল ভাজ করে দেড় হাত চওড়ার একটি বেড তৈরী করে দিলেন। রাতে জানতে পারলাম যে আমার বেড তৈরী করে দিয়েছে তাকে এক প্যাকেট স্টার সিগারেরট দিতে হবে। দুই একদিন যেতেই বুঝলাম সিগারেট হলো জেলখানার ডলার। এটিই হলো জেল খানার একমাত্র বিনিময় মাধ্যম। ভিন দেশে যেমন বাংলাদেশী টাকার কোন মূল্য নেই, তেমনি জেলখানায় নগদ টাকার কোন মূল্য নেই। পৃথিবীর যেকোন দেশে যেমন ইউ এস ডলার বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়, জেলখানায় তেমনই সিগারেটকে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই সিগারেটের বিনিময়ে জেল খানায় সব কিছু মেলে। কয়েদীদেও তৈরী বিভিন্ন প্রকারের সোপিচ, ব্যাগ, চুড়ি, নকশা করা কলম সব কিছুই সিগারেটের বিনিময়ে পাওয়া যায়। এমনকি সিগারেটের বিনিময়ে নিজের বিভিন্ন কাজ কর্ম অন্যকে দিয়ে করিয়ে নেয়া যায়। এক ওয়ার্ড থেকে পছন্দের অন্য ওয়ার্ডেও যাওয়া যায় এই সিগারেটের বিনিময়ে। শুধু তাই নয় এই সিগারেটের বিনিময়ে গাজা থেকে শুরু করে নেশার ট্যাবলেট, স্প্রিট এমনকি মরন নেশা ইয়াবাও পাওয়া যায়-এসব কথা বন্দীদের কাছে শুনেছি।

একদিন জেলে বেশ হুলস্থুল পড়ে গেল। সবাই আতংকিত। কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারলাম। পরে জানতে পারলাম কয়েকজনের কাছ থেতে গাজা উদ্ধার করা হয়েছে। জেল অভ্যন্তরে এসব মাদক দ্রব্য কিভাবে ঢোকে তা অন্য আরেক দিন লিখব। পরিশেষে জেলের কিছু ভালো দিক তুলে ধরে শেষ করতে চাই। জেলখানায় মাদরাসা ও প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াও বিভিন্ন কারিগরী কাজ শেখার ব্যবস্থা আছে। যে কেউ ইচ্ছা করলে জেল থেকে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষা অর্জন করা ছাড়াও কারিগরী কাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারে। জেলখানায় প্রবেশের সময় প্রবেশদ্বারের ওপরের দেওয়ালে "রাখিব নিরাপদ, দেখাইব আলোর পথ" এই লেখাটা পড়েছিলাম। ভিতরে অল্পকিছুদিন থাকলেও এই টুকু অনুধাবন করতে পেরেছি- এই শ্লোগানের যথার্থতা তার জীবনেই শুধু প্রতিফলিত হবে, যে কিনা সত্যিকারে ভাল হওয়ার ইচ্ছা পোষন করে।